ভারতের জিডিপি হ্রাস ও কোভিডে মৃত্যুর পরিসংখ্যান - দুটোই কম করে দেখানো
India's GDP decline and death toll in Covid

পরিসংখ্যানবিদরা উন্নত মানের সমীক্ষা ও সংখ্যাতাত্বিক পদ্ধতি প্রয়োগ করে, অর্থনীতির বিবিধ পরিসংখ্যানকে ব্যবহার করে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে ‘বস্তুনিষ্ঠ’ তথ্য পেশ করেন। সেই পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে গত বিত্ত বর্ষের শেষ ত্রৈমাসিক অর্থাৎ জানুয়ারী ২০২১ – এপ্রিল ২০২১ সময়কালে দেশের অর্থনৈতিক বৃদ্ধি বা জিডিপি বৃদ্ধির হারকে ১.৬% হিসেবে অনুমান করা হয়েছে। ফলে সামগ্রিকে ২০১৯-২০ বিত্তবর্ষে বৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে ঋণাত্মক, -৭.৩%। অর্থাৎ ২০১৯-২০ সালের জিডিপির তুলনায় ২০২০-২১ সালে জিডিপি ৭.৩% হ্রাস পেয়েছে। সামগ্রিক জিডিপির হ্রাসের জন্য সব থেকে বেশি দায়ী মোট স্থির মূলধন গঠন, যা কমেছে ১০.৮%; এর পরে দায়ী ব্যক্তিগত ভোগব্যয়ের হ্রাস, যা গত ২০১৯-২০ বর্ষের তুলনায়  ৯.১% কমেছে। উভয় ক্ষেত্রেই তা ২০১৮-১৯ সালের তুলনায়ও কম যথাক্রমে ৫.৯%  ও ৪.১%। ফলে বোঝাই যাচ্ছে যে, শিল্পপতিরা বিনিয়োগে উৎসাহী নয়, এবং গৃহস্থ ভোগ ব্যয়ে নিরুৎসাহ। কেবল জিডিপির বৃদ্ধি বা হ্রাস এই দিক গুলিকে আলোকিত করে না। তদর্থে ওই দুটি অঙ্গ যা অর্থনীতিতে ব্যক্তিসমূহের অংশগ্রহণের পরিমাণকে ইঙ্গিত করে তা প্রায় ১০% কমেছে। যেহেতু বাণিজ্য ঘাটতি প্রায় ৪০% কমেছে (বাণিজ্য ঘাটতি কমার অর্থ জিডিপি বৃদ্ধি) ও সরকারী ভোগ ব্যয় ৩% বেড়েছে, তাই জিডিপির হ্রাস তুলনায় কম হযেছে।

সরকারী পরিসংখ্যানের বাইরেও ব্যক্তির অভিজ্ঞতা যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ঘটছে তার ভিত্তিতেও দেশের অর্থনীতি ও সমাজের অবস্থা সম্পর্কে আন্দাজ করা যায়। তাছাড়াও অর্থনৈতিক পরিসংখ্যান বিষয়ে বিশেষজ্ঞ সংস্থাগুলি রয়েছে। সিএমআইই-র তথ্য অনুযায়ী গত মার্চের শেষ সপ্তাহের তুলনায় মে মাসের শেষ সপ্তাহে উপভোক্তার আবেগ ১৫% কমেছে। তাদের তথ্য অনুসারে ৯৭% ভারতীয়ের প্রকৃত আয় কমেছে। ফলে আয়ের অপেক্ষক হিসেবে ভোগ চাহিদাও কমছে। দেশ জোড়া কোভিড আক্রমণ ও আতঙ্কের পরিবেশে এই অবস্থা ঘটা আশ্চর্যের কিছু নয়। প্রশ্নমের একটি সমীক্ষা অনুসারে সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারী ১৭% মানুষের আত্মীয়-স্বজনের কেউ না কেউ মারা গেছে কোভিডের দ্বিতীয় অভিঘাতে। ফলে একদিকে মানুষ বাইরে বেরচ্ছে না, বাজার দোকানে যাচ্ছে না। ফলে অবশ্যম্ভাবীভাবে বিক্রেতার পণ্য বিক্রি কমছে, অটো, রিকশ, বাসের যাত্রী কমছে। অন্যদিকে ভবিষ্যতে অসুখের কথা ভেবেও লোকে ভোগ কমিয়ে দিয়ে সঞ্চয় করছে।

এই যে ভোগব্যয় ও মূলধন গঠনে ঘাটতির তার ফল কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হচ্ছে। এপ্রিল মাসে বেকারির হার ছিল ৮%, মে মাসে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১.৩%। কেবল মে মাসেই ১ কোটি ৫৩ লক্ষ মানুষ কাজ হারিয়েছেন। ফলে জানুয়ারী থেকে এপ্রিল পর্যন্ত কাজ হারানো ১ কোটি মানুষের সঙ্গে এই সংখ্যা জুড়ে তা আড়াই কোটি ছাড়িয়ে গেছে। এছাড়াও প্রতি বছর নুতন করে শ্রমের বাজারে কর্মপ্রার্থী হয়ে উপস্থিত হচ্ছে ১ কোটির বেশি লোক। সিএমআইই-র তথ্য অনুসারে গত ২৫ এপ্রিলের পর থেকে টানা ৪ সপ্তাহ বেকারত্বের হার বেড়েছে, মাঝে ৩০ মে শেষ হওয়া সপ্তাহে তা একটু কমে ১২.১৫% হলেও পরের ৬ জুনের সপ্তাহেই তা বেড়ে ১৩.৬২% হয়েছে। সব মিলিয়ে গত  ১৪-১৫ মাসের অতিমারী আক্রান্ত বিপর্যস্ত জনজীবন অধিকতর সমস্যায় জড়িয়ে পড়ছে। শ্লথ বা ঋণাত্মক বৃদ্ধি, ঊর্ধগামী বেকারি, সঙ্কুচিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি, অদিকতর দারিদ্র এই সবই অতিমারী সময়কার বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠছে। আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সমীক্ষা অনুসারে ২৩ কোটি মানুষ দারিদ্র সীমার নীচে নুতন করে নেমে গেছেন।

সরকারী পরিসংখ্যানের ক্ষেত্রে বহুবিধ আপত্তির কথা বিচক্ষণ ও বিশেষজ্ঞ অর্থনীতিবিদ ও পরিসংখ্যানবিদরা বারম্বার তুলেছেন। তদর্থে দেশ যখন এক ফ্যাসিস্ট শাসনের অধীন থাকে তখন পরিসংখ্যানকে মনোমত তৈরি অত্যন্ত স্বাভাবিক। দেশের সমস্ত প্রতিষ্ঠানকে যখন বশম্বদ করে তোলা হয়েছে তখন জাতীয় পরিসংখ্যান কমিশন সেই তাঁবেদারির বািরে থাকবে এমনটা ভাবাও পাপ। অতিমারীর সময়ে দেশের সব থেকে সংগঠিত ক্ষেত্র কর্পোরেট ক্ষেত্র বহুল পরিমাণে মুনাফা করেছে। বেশ কয়েকজন শিল্পপতির সম্পদ কয়েকগুণ বেড়েছে। অনলাইন ব্যবসায়, সফ্টওয়্যার সংস্থা, ওষুধের কোম্পানি, প্রভৃতি সংস্থাগুলি দ্রুত লাভ বাড়িয়েছে। ভারতে অসংগঠিত ক্ষেত্রে অন্তত ৮৫% শ্রমিক কর্মচারি কাজ করে (নীতি আয়োগের হিসাব)। সেই অসংগঠিত ক্ষেত্রের উৎপাদনের পরিমাপ করা হয় সংগঠিত বা কর্পোরেট ক্ষেত্রের উৎপাদনের উপর নির্ভর করে করা অনুমানের ভিত্তিতে। ২০১৮-১৯ সালের তুলনায় ২০১৯-২০ সালে অসংগঠিত ক্ষেত্র বহুল পরিমাণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিপরীতে, আগেই বলা হয়েছে, কর্পোরেট ক্ষেত্রের উৎপাদন ও মুনাফা বেড়েছে। এমতাবস্থায়, কর্পোরেটের উৎপাদনের পরিমাণের উপর নির্ভর করে অসংগঠিত ক্ষেত্রের উৎপাদন মাপলে তা বাস্তবের তুলনায় অনেকটাই বেশি হবে। ফলে, অনুমানের তুলনায় জিডিপির হ্রাস বেশিই। যেমন কোভিড থেকে মৃত্যুর সংখ্যা সরকারী পরিসংখ্যানের তুলনায় অনেক বেশি বলেই অনুমান করা হচ্ছে ও সংখ্যাটি প্রায় ৪ লাখের তুলনায় ৪০-৪৫ লাখও হতে পারে বলে অনুমান করছে নিউইয়র্ক টাইমস। পূর্বোক্ত প্রশ্নমের সমীক্ষার ‘১৭%’ ও সেদিকেই ইঙ্গিত করছে। যদি কোভিডে মৃত্যু সংখ্যা গত দুমাসে এই বীভৎসায় পৌঁছায় যার ছবি ভারতের মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে, তাহলে তা দেশের অসংগঠিত অর্থনীতিতে যে প্রভাব ফেলবে তা অনুমানের বাইরে।

দৈনন্দিন জীবনচর্যায় যেভাবে অতিমারীর ফলে বিপর্যস্ত নাগরিকদের দেখা যাচ্ছে তা সত্যিই চিন্তার বিষয় ও হৃদয় বিদারক। যে রিকশ চালক অটো চালকের সঙ্গে যাতায়াতের সূত্রে আলাপ, যে মাছ বিক্রেতা, সব্জি বিক্রেতা, কিংবা হকারের সঙ্গে কেনা বেচার লেনদেন করেছি, তাদের সঙ্গে দেখা হলেই আক্ষেপ ও দুঃখ ভিঢ় করে আসে। যে যুবক বা প্রৌঢ় শ্রমিক কর্মচারি কাজ হারিয়েছেন বা মাসে ১৫ দিন কাজ পাচ্ছেন দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে তার অভিজ্ঞতার উপরে ভর করে বা আমাদের ব্যক্তিজীবনের সেইসব অভিজ্ঞতার উপরে ভর করে যদি বাস্তব অর্থনীতির পরিস্থিতিকে বুঝতে চেষ্টা করি তাহলে সামনে ভেসে উঠছে এক অসহনীয় দারিদ্র বেকারি শিক্ষা স্বাস্থ্যের অবনতি (অপরদিকে কুৎসিত দালাল পুঁজির নারকীয় বৈভব), যেটাই আসলে বাস্তব। যে দারিদ্র বেকারিকে মন কি বাত মাসান্তে পরিহাস করে; আর যেগুলোকে মনে করিয়ে দিতে হবে প্রতিনিয়ত, ভবিষ্যতে ওই পরিহাসকারীকে উচিৎ শিক্ষা দেওয়ার জন্য।

-- অমিত দাশগুপ্ত 

খণ্ড-28
সংখ্যা-21