রাষ্ট্র কি নারীবাদ বিষয়ে পরোক্ষ নিষেধাজ্ঞা জারি করছে?
Is the state indirectly banning feminism_0

যে কোনো আইনের মতোই ধর্ষণ আইনের সংশোধন, সংস্কার ও উন্নতিকরণে আদৌ কোনো লাভ হয় না, যদি না ঠিক মতো সেই আইন প্রয়োগ করা যায়। আর এই প্রয়োগের ক্ষেত্রে বিচারব্যবস্থার সদিচ্ছার গুরুত্ব অপরিসীম। ২০১২ সালে দিল্লির বাসে ধর্ষণ বা তথাকথিত ‘নির্ভয়া কেস'-কে ঘিরে যে নাগরিক আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, তা ধর্ষণ আইনের সংস্কারের জন্য ভার্মা কমিটি গঠন করতে তৎকালীন সরকারকে বাধ্য করেছিল। বেশ কিছু আধুনিক পরিবর্তন এসেছিল ধর্ষণ আইনে। কিন্তু সেই আইন কীভাবে প্রযুক্ত হচ্ছে? এখানে সচেতনতা ও সদিচ্ছার প্রশ্ন বারবার উঠছে, কারণ কার্যক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, বিচারব্যবস্থার ধারক-বাহকরাই আদালতকে সনাতন পিতৃতান্ত্রিক পক্ষপাত বজায় রাখতে সাহায্য করছেন।

ধর্ষণের কেস-এ অভিযুক্তকে বাঁচাতে গিয়ে প্রতিপক্ষের উকিল, এমনকি বিচারকও, কী কী বলতে পারবেন আর কী কী বলতে পারবেন না, এবং যা যা বলতে পারবেন না, তা বললেই বা তাঁরা কোনো সাজা পাবেন কিনা, তার রূপরেখা কোথাও নেই। তরুণ তেজপাল সংক্রান্ত রায়টি শুধু এ কারণে গুরুত্বপূর্ণ নয় যে তা ধর্ষণে অভিযুক্ত তেজপালকে খালাস করল। বরং তা এ কারণেও চিন্তার উদ্রেক করছে যে আজ অবধি ভারতে ঘটা ধর্ষণ-আইনের যাবতীয় সংস্কারকে তা অগ্রাহ্য করল। আবারও একবার প্রমাণ হল, কেন মেয়েরা ধর্ষণের পর ‘ডিউ প্রসেস'-এ আস্থা রাখতে চেয়েও ব্যর্থ হয়। তেজপালের সময়ে ‘মিটু’ ছিল না। পরে কেন ‘মিটু আন্দোলন’ প্রয়োজন হয়েছে, তা আবারও একবার দেখাল এই কেসের রায়৷

গোয়ার এক সেশন কোর্ট ২১ মে তারিখে তহেলকা ম্যাগাজিনের এককালের মুখ্য সম্পাদক তরুণ তেজপালকে ধর্ষণ ও অন্যান্য অভিযোগ থেকে মুক্তি দিল। তেজপালকে ৩৭৬/২/চ ও ৩৭৬/২/ট ধারায় অভিযুক্ত করা হয়েছিল, যা একদিকে পরিচিত ও বিশ্বস্ত, এবং অন্যদিকে ঊর্ধ্বতন ও ক্ষমতাশালী ব্যক্তির দ্বারা কারও ধর্ষণের জন্য প্রয়োগার্থে ভারতীয় আইনের দুটি ধারা। সঙ্গে ছিল ৩৫৪, ৩৫৪ক, ৩৫৪খ, ৩৪১, ৩৪২ ধারাও। ২০১৩ সালের ধর্ষণ আইনের সংস্কারের পর অন্যতম হাই-প্রোফাইল কেস ছিল এই ‘স্টেট ভার্সাস তরুণজিত তেজপাল’ কেস, যার নিষ্পত্তি হল অতিরিক্ত সেশন জাজ ক্ষমা এম যোশির হাতে।

নিষ্পত্তি বলতে, দীর্ঘ আট বছর পর অভিযুক্ত ধর্ষণের অপরাধ থেকে মুক্তি পেল। একটি ‘ফাস্ট ট্র‍্যাক কোর্ট’-এর আট বছর লাগল এই রায় দিতে যে ‘ধর্ষণ হয়নি'! কোর্টের বাইরে বেরিয়ে অভিযুক্ত এমনভাবে নিজের প্রেস রিলিজ পেশ করলেন, যেন আগে থেকেই জানতেন, মুক্তি পেতে চলেছেন। কনিষ্ঠ কন্যাই পিতার হয়ে বিবৃতিটি পড়ে দিল, যেখানে পিতা জানান, ‘মিথ্যা অভিযোগে’ তাঁর পুরো পরিবার আট বছর কী কষ্টেই না কাটালো! ধর্ষকের স্ত্রী কন্যা তাঁর ‘পাশে থেকে’ ঠিক কী প্রমাণ করতে চান যুগে যুগে? ভেবে দেখুন, বহুগামিতা নাকি আধুনিক, কারণ তা প্রাচীনপন্থী পরিবার প্রথার বিরুদ্ধে যায়। তাহলে বারবার পরিবারের ‘সলিডারিটি', স্ত্রী-কন্যাদের সমর্থনই বা কেন দরকার হয় এই তেজপাল বা ফারুকি বা ক্লিন্টনদের, ক্লিনচিট পাওয়ার জন্য?

তরুণ তেজপাল ছিলেন মুক্তচিন্তক বাম মহলে বন্দিত সেলিব্রিটি সাংবাদিক৷ তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল অধস্তন সাংবাদিককে লিফটে ধর্ষণের। সেটা ২০১৩ সাল এবং নির্ভয়া-উত্তর সময়ে যোনিপথে জোর করে আঙুল সঞ্চালনা বা জোর করে ওরাল সেক্সকেও ধর্ষণ হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। সেই সময়ে বলা হয়েছিল, এসব তেজপালের ‘তহেলকা’-র সাহসী সব স্টিং অপারেশনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের ফল। অভিযোগ ছিল বিজেপির বিরুদ্ধে, কারণ এর আগে এনডিএ আমলে ‘তহেলকা’-র ‘অপারেশন ওয়েস্ট এন্ড’ প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জর্জ ফার্নান্ডেজ সহ অনেকের পর্দা ফাঁস করেছিল। গোয়া পুলিশ সুয়ো মোটু করেছিল বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী মনোহর পানিক্করের নির্দেশে৷ তাই এমন ভাব করছিল প্রগ্রেসিভ মহল, যেন পুরো ন্যারেটিভটাই তহেলকা ও বিজেপিময়৷ যেন সেখানে ধর্ষিতার কোনো বক্তব্য মান্য নয়। মেয়েটির সঙ্গে ঘটনার পর যে ইমেইল চালাচালি হয়েছিল তরুণ তেজপাল ও তহেলকার আরেক কর্ণধার সোমা চৌধুরির, তা ‘লিক’ হওয়াতেই গোয়া পুলিশ কেস করে৷ সেই সব ইমেইল কিন্তু বলে, ঘটনা ঘটেছিল৷ মেয়েটির মতে, সম্মতি ছিল না। তরুণ তেজপালের কথায়, তিনি বুঝতে পারেননি যে সম্মতি ছিল না। ঘটনাটি ২০১৩ সালের নভেম্বরে পরপর দুদিন ঘটে, যখন বিরাট পাঁচ তারা হোটেলে ‘তহেলকা’ ‘থিংক ফেস্টিভ্যাল’ নামক এলাহি বৌদ্ধিক অনুষ্ঠান আয়োজন করেছিল।

আমাদের বুদ্ধিজীবী সাংবাদিকদের চিন্তনের জন্যও কেন পাঁচতারা হোটেল আর কর্পোরেট লগ্নি লাগে, কীভাবে কর্পোরেট টাকায় ‘প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতার’ আইকন তৈরি হয়, সেসব প্রশ্ন তোলা থাক। এই প্রশ্নও তোলা থাক যে কেন ‘মুক্তচিন্তক’ বা ‘প্রগতিশীল’ পুরুষ যৌন নির্যাতনে অভিযুক্ত হলে তার পাশে অন্য সব প্রগতিশীলরা দাঁড়িয়ে পড়েন। ধর্ষক কি শুধু রাম সিং-এর মতো অশিক্ষিত বস্তিবাসীই করে? ধর্ষকের অপরায়ন আমাদের ধর্ষণের সমস্যার প্রতি আসলে অন্ধই করে রাখে।

আপাতত মেয়েটির কথায় ফেরা যাক। গোয়া সরকারের তৎপরতা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হোক বা না হোক, ধর্ষণের সংজ্ঞানুযায়ী কনসেন্টের অভাব থাকলে ঘটনাটি ধর্ষণই। আর অভিযোগকারিণী বারবার কনসেন্টের অভাবের কথাই বলেছিলেন। তিনি ঘটনার দিনই একাধিক জনকে ঘটনাটি জানিয়েছিলেন, যার মধ্যে তেজপালের বড় মেয়ে ছিল, ছিল সহকর্মীরা। তারপর তিনি সোমা চৌধুরীকে চিঠি লেখেন। তরুণ তেজপালও ক্ষমা চেয়ে চিঠি লেখেন অভিযোগকারিণীকে। তারপরেও আদালত বলল, তেজপাল সম্পূর্ণ নির্দোষ। কীভাবে? তার ব্যাখায় আদালত ৫২৭ পাতার এক রায় উপস্থাপন করে যা অভিযোগকারিণীর চরিত্রহনন, তাঁর পূর্ব-সম্পর্ক ও তাঁর নারীবাদী হওয়ার সম্ভাবনার বিশ্লেষণে ঠাসা৷ প্রশ্ন উঠবে, অভিযোগকারিণীর চরিত্রহনন বা তাঁর পূর্ব-সম্পর্ক নিয়ে কাটাছেঁড়া এর আগেও বহুবার আদালতে হয়েছে; কিন্তু নারীবাদ নিয়ে বিশ্লেষণ আবার কেন?

এইখানে পশ্চাদপদরণের এক নতুন নিদর্শন রায়টি স্থাপন করেছে। রায়টি পড়ে বোঝা যাচ্ছে না, কাঠগড়ায় কে ছিল -- তেজপাল, না ফেমিনিজম?

ধর্ষিতা যদি ঠিক ‘বেচারা’ না হন, যদি ধর্ষণের আইনি সংজ্ঞা জানেন, ২০১৩ সালে ভার্মা কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী ধর্ষণ আইনের অ্যামেনডমেন্ট জানেন, যদি তাঁর বন্ধুবৃত্তও সচেতন হয়, যদি তাঁর কিছু কাজ থাকে নারীর উপর ঘটা হিংসা নিয়ে (কিছু বইপত্তর বা লেখালেখি) এবং যদি তাঁর পরিচয় থাকে এমন কিছু উকিলের সঙ্গে যাঁরা নিজেদের নারীবাদী বলে চিহ্নিত করেন বা যৌন নির্যাতনের কেস লড়েন, তাহলে কি সেই ধর্ষিতা কোনো অসহায় ধর্ষিতা-র চেয়ে তাড়াতাড়ি সুবিচার পাবেন? না। বরং এই রায় দেখালো, উল্টোটা সম্ভব। সেক্ষেত্রে পুরো ধর্ষণটাই আদালতের চোখে হয়ে যেতে পারে এক ‘ফেমিনিস্ট ষড়যন্ত্র’।

যেকোনো ধর্ষণের ক্ষেত্রেই আদালতের সামনে দুটি প্রশ্ন থাকে : (১) অভিযোগকারিণী সঙ্গে অভিযুক্তর কোনো যৌন ক্রিয়া হয়েছিল কিনা। (২) হয়ে থাকলে অভিযোগকারিনীর সম্মতি ছিল কিনা। উক্ত মামলার ক্ষেত্রে আদালত কীভাবে এই প্রশ্নগুলির সম্মুখীন হল ও কী সিদ্ধান্তে পৌঁছাল, তা দেখা যাক।

রায়টি প্রথম প্রশ্নের উত্তরে খুব শীঘ্রই বলে দিচ্ছে যে লিফটে কোনো যৌনতা ঘটেনি। অভিযোগকারিণী মিথ্যা কথা বলছিলেন। বিচারক এও বলতে পারতেন যে সত্য প্রমাণ করার পক্ষে যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না। তার পরিবর্তে, বারবার দৃঢ়ভাবে দাবি করা হল যে অভিযোগকারিণী মিথ্যাবাদী।

খুব তাড়াতাড়ি, ৫২৭ পাতার মধ্যে ২৩তম অনুচ্ছেদেই, আদালত স্পষ্টভাবে পর্যবেক্ষণ করছে যে ‘বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় ঘটনাসমূহের বিকৃতি ঘটানোর বা ঘটনা সংযোজন হওয়ার সম্ভাবনা থাকতে পারে।’ পরবর্তী ৫০০ পৃষ্ঠায়, আদালত ধর্ষণের নয়, বরং সেই ‘চক্রান্তের’ তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে এবং ক্ষুদ্র কিছু অসঙ্গতি পেলেও ভুক্তভোগীকে সটান মিথ্যাবাদী বলছে।

যাই হোক, রায়টি তো বলল লিফটে কোনো যৌনতা হয়নি। বরং এক ধরনের মদ্যপ ‘ব্যান্টার’ হয়েছিল, যেখানে অভিযোগকারিণীই আগের বছরের তহেলকা আয়োজিত উৎসবে ভিআইপি অতিথির সাথে তাঁর যৌন মিলনের কিছু গল্প বলেছিলেন তার বস্-কে। এবং সেই প্রসঙ্গেই তেজপাল পরে অভিযোগকারিণীকে একটি মেসেজ করেন, যাতে লেখা ছিল ‘fingertips’। (অর্থাৎ তেজপাল নিজে মেয়েটির শরীরে আঙুল প্রবেশ করাননি। মেয়েটির দ্বারা বর্ণিত ঘটনারই রেফারেন্স ছিল তাঁর পাঠানো মেসেজে। এই মেসেজ এসেছিল ধর্ষণের রাতেই, যা মেয়েটি আদালতকে দেখিয়েছিল।)

কেন অভিযোগকারিণী মিথ্যা বললেন? উত্তরে আদালত বলছে, কারণ ‘তিনি নারীবাদীদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করছেন’। কী সেই ষড়, তা স্পষ্ট নয়। আদালত আরও বলে, অভিযোগকারিণী ভেবেছিলেন যে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ করলে তিনি ধর্ষণ নিয়ে একটি বই লেখার জন্য অনুদান পেয়ে যাবেন। বই-এর গ্রান্ট পেতে তিনি চাকরি খোওয়ালেন ও বসের বিরুদ্ধে মামলা করলেন, এটা বড়ই বাড়াবাড়ি কল্পনা নয়?

আদালত এও বলছে, গোয়া পুলিশের সঙ্গে আঁতাত করে রাজনৈতিক কারণে অভিযুক্তকে ফাঁসিয়েছেন অভিযোগকারিণী। অথচ পরে এক জায়গায় আদালত এই প্রশ্নও তুলছে যে, হাথরাসের ঘটনার পর অভিযোগকারিণী ইন্সটাগ্রামে কেন পোস্ট দিয়েছেন? এমন পোস্ট, যা প্রমাণ করে যে তিনি নারীবাদী! অতএব, নিজের ধর্ষণ সম্পর্কে তাঁর বক্তব্যে অতিরঞ্জন থাকতে পারে, কারণ নারীবাদীরা এরকম বাড়াবাড়ি করে। এই হাথরাসের ঘটনার বিরোধিতা মানে কিন্তু বিজেপি-বিরোধিতাও। তাহলে বিজেপির হয়ে কাজ করছেন ধর্ষিতা না বিজেপির বিরুদ্ধে? তা বোঝা গেল না।

এছাড়া আছে আরও নানা যুক্তি। তিনি বসের থেকে ধমক খেয়ে তাঁর বিরুদ্ধে প্রতিশোধপরায়ণ হয়েছিলেন, তাঁর রাশিয়ান প্রেমিক ছিল ইত্যাদি -- যার মধ্যে কোনোটিই ধর্ষণকে অপ্রমাণ করে না৷ তবু তাদের ৫০০ পাতা জুড়ে এখানে ওখানে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে সুযুক্তির অভাবে।

এবার প্রশ্ন হল, কোনো যৌন ক্রিয়া না ঘটা সত্ত্বেও আসামী তার কর্মচারীর কাছে ক্ষমা চেয়ে দুটি ইমেইল এবং একটি তাহেলকার ম্যানেজিং এডিটরের কাছে একটি ইমেইল কেন লিখলেন? এই চিঠিগুলোয় তিনি ক্ষমা-টমা চেয়েছিলেন। আদালত সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, অভিযুক্ত এই ক্ষমা চেয়েছিলেন (ক) তাহেলকার ম্যানেজিং এডিটরের জোরাজুরিতে এবং (খ) সেখানে এমন কিছু লেখা নেই যাকে ‘যৌন নির্যাতনের স্বীকারোক্তি’ বলা যায়। অভিযুক্তর এই চিঠিগুলিতে কিন্তু লিফ্টের অভ্যন্তরে যে কিছু ঘটেছিল, তা অস্বীকার করা হয়নি। ব্যবস্থাপনা সম্পাদককে লেখা অভিযুক্তের চিঠির শিরোনামই হল ‘প্রায়শ্চিত্ত’। তিনি এডিটরের পদ থেকে ইস্তফা দিতে চেয়েছিলেন কারণ তিনি ‘ভুল’ করে ফেলেছেন।

সত্যি যদি কোনো যৌনতা না ঘটে থাকে, তবে তো ‘সম্মতি’-র প্রশ্নই নেই। কিন্তু ওই চিঠিগুলির প্রসঙ্গে আদালতকে বারবার ‘সম্মতি’-র প্রসঙ্গে ফিরতে হয়েছে। আর তখনই আদালতের পক্ষপাত নগ্ন হয়েছে।

রায়টিতে বলা হয়েছে যে অভিযোগকারিণীর ইমেইল পেয়ে তহেলকার ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ক্ষুব্ধ হয়ে অভিযুক্তর থেকে ব্যাখ্যা চান। তিনি বলেছিলেন যে, তিনি অভিযোগকারিণীর সঙ্গে কেবল একটি ‘ক্ষণস্থায়ী সম্মতিযুক্ত যৌন এনকাউন্টার’ করেছেন। রায়েই এই ভাষা আছে, যা নাকি তেজপাল ইমেইলে বলেছেন। অথচ এর আগে রায় সেটিকে ‘মদ্যপ ব্যান্টার’ বলছিল, যেখানে অভিযোগকারিণীই মূলত তার যৌন অভিজ্ঞতা বর্ণনা করছিল! তাহলে বিষয়টা ‘এনকাউন্টার’ না ‘ব্যান্টার'? দুটো শব্দের মানে তো আলাদা! যৌন ‘এনকাউন্টার’ বলতে অবশ্যই যৌন ক্রিয়া বোঝায়। তাহলে কি যৌন ক্রিয়া হয়েছিল? সেক্ষেত্রে সম্মতির প্রসঙ্গ ফিরতে বাধ্য।

এইবার দেখা গেল, অভিযুক্ত দাবি করছেন যে উক্ত ‘এনকাউন্টার’ সম্মতিক্রমে হয়েছিল যদিও অভিযোগকারিণী বলছেন যে সম্মতি ছিল না। এদিকে, ক্ষমা প্রার্থনার ইমেইলে অভিযুক্ত স্বীকার করে নিয়েছিল, ‘দু’বার আপনার সাথে যৌন সম্পর্ক (‘লিয়াঁসো’) করার চেষ্টা করা আমার ভুল ছিল ... আপনার স্পষ্ট অনীহা থাকা সত্ত্বেও এবং আপনি এটা স্পষ্ট করা সত্ত্বেও যে আপনি আমার কাছ থেকে এ জাতীয় মনোযোগ চাননি …’ ইত্যাদি।

এর পরেও আদালত বলছে, স্পষ্টত ‘সেক্সুয়াল ভায়োলেন্স’, ‘সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট’ ‘রেপ’ কথাগুলি এই ইমেইলে না থাকায় নাকি কিছুই প্রমাণ হল না। আদালতের দাবি হল, অপরাধী ‘লিয়াঁসো’ বললে চলবে না। অপরাধী আইনি ভাষা ব্যবহার করে ক্ষমা চাইবে বা স্বীকারোক্তি দেবে -- তবে তাকে আদালত ‘স্বীকারোক্তি’ বলে মানবে। এমন অলীক দাবি আদালত কক্ষে আগে শোনা গেছে কি?

আমরা আরও জানতে পারি, যৌনতা চলার সময় মেয়েটি মনে করিয়েছিল ‘আপনি আমার বস্’, আর বস্ বলেছিলেন ‘দ্যাট মেকস ইট ইভন সিম্পলার’। চিঠিতে তিনি স্বীকার করেছেন যে যদিও এমনটাই তিনি বলেছেন, তবু কিছু পরে সেই কথা প্রত্যাহার করে বলেছিলেন যে, বস্ হওয়ার কারণে জোর খাটানো যায় না। একে রায়টি অভিযুক্তের ‘মহত্ত্ব’ বলে উল্লেখ করেছে এবং, বলা বাহুল্য, এত কিছুর পরেও আদালত বুঝতে পারছে না যে যৌন নির্যাতন হয়েছিল।

এরপর বিচারক বোধহয় সবচেয়ে সমস্যাজনক কথাটি বলেন। ‘যদি তাঁর (অভিযোগকারিনীর) বিবরণ অনুসারে হামলা হত, তবে স্বভাবতই তাঁর অসম্মতির কথা, আপসেট হওয়ার কথা অভিযুক্ত বুঝতে পারতেন। কিন্তু তিনি তেমন কিছুই বুঝতে পারেননি বলছেন।’ অর্থাৎ অভিযুক্তের প্রতিটি কথা বিশ্বাস করা হচ্ছে। অভিযোগকারিণীর প্রতিটি কথা মিথ্যা বলেই ধরা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, বক্তব্যটি মূলগতভাবে সমস্যাজনক। কারণ ধর্ষক অসম্মতি বুঝতে অক্ষম বলেই সে ধর্ষক। যে অনুমতির তোয়াক্কা করে না, সেই তো ধর্ষক! খোদ আদালত যখন বলে, ‘অভিযুক্ত অসম্মতি বুঝতে পারেননি মানে নিশ্চয় অসম্মতি ছিল না’, তখন বিস্ময়ের সীমা থাকে না৷ এই যুক্তিতে তো পৃথিবীর সব ধর্ষকই খালাস পেতে পারে!

প্রথম হামলার রাতেই অভিযোগকারিণী তাঁর তিন সহকর্মীকে লাঞ্ছিত হওয়ার কথা বলেছিলেন। তিনজনই আদালতে এই বিষয়ে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন। চতুর্থ একজন, যাকে তিনি সামান্য পরে ঘটনাটি বলেছিলেন, তিনিও সাক্ষ্য দেন। কিন্তু প্রথম দু’জনের সাক্ষ্য গণ্য করা হয় না এই অজুহাতে যে তারা অভিযোগকারিণীর নয়, তাঁর স্বামীর বন্ধু। তৃতীয় সাক্ষ্যটিও বরখাস্ত করা হয়, কারণ অভিযোগকারিণীর প্রতি এই সাক্ষীর নাকি ভালো-লাগা ছিল। চতুর্থ সাক্ষ্য খারিজ হয়েছে কারণ অভিযোগকারিণী তাকে ধর্ষণের গ্রাফিক বিবরণ দেয়নি। অভিযোগকারিণীর বর এবং মায়ের বয়ানও অবিশ্বস্ত বলে বিবেচিত হয়েছে আদালতের দ্বারা।

তবে রায়টি অন্য একজন পুরুষ সাক্ষীর সাক্ষ্যের উপর বিশেষ আস্থা রেখেছে। তিনি অভিযোগকারিণীর প্রাক্তন প্রেমিক। তাঁর সাক্ষ্যর ভিত্তিতেই যাবতীয় স্লাট-শেমিং-এর ন্যারেটিভ গড়ে ওঠে। তিনি বলেন যে নিশ্চয় তেজপালকে লিফটে ওঠার আগে বা পরে কোনো রগরগে গল্প অভিযোগকারিণী শুনিয়ে থাকবেন, কারণ যৌন গল্প বলতে অভিযোগকারিণী ভালোবাসেন। প্রাক্তন প্রেমিকের বয়ানের প্রতি আদালতের এই মোহ প্রণিধানযোগ্য।

এই রায়ে বারবারই এসেছে নারীর চরিত্র ও তাঁর পূর্ব-সম্পর্কের প্রসঙ্গ। অথচ ২০১৩ সালের আইন সংস্কারের সময় ভার্মা কমিটি এভিডেন্স অ্যাক্টেও কিছু বদল এনেছিল। ৫৩ক সেকশন ঢোকানো হয়েছিল, যেখানে বলা হয়েছিল ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের ক্ষেত্রে, যখন অভিযোগকারিণীর ‘কনসেন্ট’ ছিল কিনা, তা নিয়ে তর্ক হবে, তখন অভিযোগকারিণীর পূর্ব সম্পর্কের কথা আনা যাবে না। এভিডেন্স অ্যাক্টের সেকশন ১৪৬-এও বলা হয় যে অভিযোগকারিণীর চরিত্র বা পূর্ব সম্পর্ক টানা যাবে না। এমনকি আরও দশ বছর আগে ১৫৫-৪ ধারা বাদ দিয়ে বলা হয়েছিল, অভিযুক্ত অভিযোগকারিণীকে চরিত্রহীন বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করতে পারবেন না।

অথচ বর্তমান রায়ে বলা হল, ‘এই ধারাগুলি (১৪৬, ৫৩ক) এক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, কারণ উইটনেসরা সাক্ষ্য দিচ্ছে কী কী ঘটনা ঘটে থাকতে পারে, সে বিষয়ে। এখানে কনসেন্টের প্রসঙ্গ আসছেই না।’ বর্তমান লেখক এ কথার মর্মোদ্ধার করতে পারেননি। কিন্তু এই সূত্রে আলোচনা হল, আগের বছরের ‘থিঙ্ক ফেস্টিভ্যালে’ অভিযোগকারিণীর সঙ্গে কোনো ভিআইপি গেস্টের ভাবসাব হয়েছিল, তিনি কোন কোন ফিল্মস্টারকে চেনেন, কোন ক্রিকেটারের সঙ্গে তাঁর কেমন সখ্য; অভিযোগকারিণীকে জিজ্ঞাসা করা হল, সিগারেট বা মদ্যপান বা বহুগামিতা নিয়ে তাঁর কী মত। এই সবই নাকি ধর্ষণের দিন কী ঘটেছিল, তা বুঝতে আদালতকে সাহায্য করবে!

কিছু কিছু সংবাদ মাধ্যমে বলা হচ্ছে, সিসিটিভি ফুটেজ ‘ধ্বংস’ করা হয়েছে। অথচ ভালোভাবে রায় পড়লে বোঝা যায়, সরকারকে সব ফুটেজই দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু আটবছর সরকারি গুদামে থাকাকালীন হোটেলের দোতলার ফুটেজ নষ্ট হয়ে গেছে। তার দায় অভিযোগকারিণীর নয়, সরকারের। বরং এই সব ফুটেজের প্রতিলিপি অভিযুক্ত ও তার উকিলকেও দেওয়া হয়েছিল। আদালত চাইলে তাদের কাছেই তা আবার চেয়ে পাঠাতে পারত। আদালত তা করেনি। এই প্রসঙ্গে আরও মনে পড়ল, লিফট থেকে বের হওয়ার সময় অভিযুক্তকে মুখ মুছতে ও অভিযোগকারিণীকে চুল ও পোষাক ঠিক করতে দেখা গিয়েছিল নাকি সিসিটিভি ফুটেজ-এ। ওরাল সেক্সের অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও অভিযুক্তকে প্রশ্ন করা হল না, তিনি মুখ কেন মুছছিলেন৷ অন্তত রায়ে তেমন কোনো প্রশ্নোত্তরের উল্লেখ নেই। কিন্তু অভিযোগকারিণীকে প্রশ্ন করা হল, তিনি দিনে কতবার চুল ঠিক করেন!

মুক্তিপ্রাপ্ত তেজপাল যখন কন্যা মারফত প্রেস বিবৃতি দিচ্ছিলেন কোর্টের বাইরে, সেই অনামী অভিযোগকারিণী তখন ভিড়ে হয়ত মিশে যাচ্ছিলেন, যিনি ছিল ভুক্তভোগী, যিনি নিজেকে ধর্ষিতা ‘মনে করেছিলেন’। অভিযুক্তর নাকি আটটি বছর ‘নষ্ট হল’, আর অভিযোগকারিণীর?

কিন্তু শুধু ভুক্তভোগীর প্রতি সহানুভূতিতে নয়, এই রায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন কাম্য আরও বৃহত্তর কারণে। ৫২৭ পাতার এই বিশাল-বপু রায়টির যুক্তি, ভাষা ও প্রোপাগ্যান্ডা -- সবই ২০১৩ সালের ধর্ষণ আইন সংস্কারের সম্পূর্ণ বিপরীতে দাঁড়িয়ে। তা নারীর যৌন ও শারীরিক স্বায়ত্তশাসন এবং গোপনীয়তার দাবি লঙ্ঘন করে। তা বলে, ‘এ কথা চূড়ান্ত অবিশ্বাস্য যে আইন-কানুন সম্পর্কে সচেতন, বুদ্ধিমান, সজাগ এবং শারীরিকভাবে সবল (যোগ প্রশিক্ষক) এক মহিলাকে অভিযুক্ত দেওয়ালে ঠেসে ধরলেন আর সে ধাক্কা দিল না …’। রায়টির পাতায় পাতায় নির্যাতিত নারীর প্রতি এই অবিশ্বাস তো আছেই, সেই সঙ্গে তাঁর রাজনীতির বিরুদ্ধে, বিশেষভাবে তাঁর নারীবাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে, রায়টি খড়্গহস্ত।

নারীবাদীর অভিযোগ ষড়যন্ত্রমূলক, তার সাক্ষ্য মিথ্যা, তার উদ্দেশ্য অনৈতিক -- এই রায় স্পষ্টভাবে এই সব বার্তা বহন করেছে। তাহলে ভারতীয় আইন কি নারীবাদ বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা জারি করছে পরোক্ষে?

এই নারীবাদ-বিরোধী প্রবণতার বিরুদ্ধে লড়াই জরুরি। কারণ নারীবাদ-ই সেই ডিস্কোর্স যা ধর্ষিতা বা যেকোনো নির্যাতিতার জন্য সুবিচার নিশ্চিত করার পাঠ দেয়। তেজপাল সংক্রান্ত এই রায় যদি শেষ পর্যন্ত স্বীকৃতি পায়, তবে তা যৌন নির্যাতনের ভবিষৎ মামলাগুলির ক্ষেত্রেই শুধু বিপজ্জনক নজির স্থাপন করবে না, বরং রাষ্ট্রীয় নারীবাদ-বিরোধিতারও এক চরম উদাহরণ খাড়া করবে।

-- শতাব্দী দাশ 

খণ্ড-28
সংখ্যা-22