দেশদ্রোহ আইন থেকে রেহাই নেই লক্ষদ্বীপেরও
Lakshadweep is also not exempt

বিজেপি মানেই যে নিরবচ্ছিন্ন নিপীড়ন, অন্তহীন অশান্তি তা ভারতের জনগণ তাঁদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতায় হাড়ে-হাড়ে টের পাচ্ছেন। বিজেপির কাছে যা কিছু অসংগত মনে হয়, তার ভোল পাল্টানোর লক্ষ্যে ঝাঁপিয়ে পড়তে তারা কুণ্ঠিত হয় না। বিজেপির কাছে এখন অসংগত বলে গণ্য হচ্ছে ভারত মহাসাগরের মাত্র ৬৮০০০ জনসংখ্যার দ্বীপপুঞ্জ লক্ষদ্বীপের বৈশিষ্ট্য সমূহ। ফলে, বিজেপির রোষানলে বিদ্ধ হতে হচ্ছে এই দ্বীপপুঞ্জকে। দ্বীপপুঞ্জের বিজেপি প্রশাসক প্রফুল্ল খোড়া পটৈলের সৌজন্যে দেশদ্রোহ আইনের থাবা মূল ভূখণ্ড থেকে এবার সম্প্রসারিত হল লক্ষদ্বীপে। দ্বীপপুঞ্জের একমাত্র অপরাধ সেখানকার জনসংখ্যার সংখ্যাধিকই, প্রায় ৯৬ শতাংশই হল মুসলমান। তাদের শায়েস্তা করতে দ্বীপপুঞ্জের প্রশাসক করে উড়িয়ে আনা হয়েছে গুজরাটের এক বিজেপি রাজনীতিবিদকে। এ জন্য বরাবরের প্রথাকে, কেবল আমলাদেরই দ্বীপপুঞ্জের প্রশাসক করার প্রচলিত রীতিকে বিজেপি অবলীলায় পাল্টে দিয়েছে। প্রশাসক রূপী সেই বিজেপি রাজনীতিবিদ দ্বীপপুঞ্জে নেমেই প্রয়োগ করতে লাগলেন আর এস এস-এর এজেণ্ডাকে। নামালেন বিতর্কিত প্রাণী সংরক্ষণ আইনের খসড়া, যার পিছনে রয়েছে গোমাংস নিষিদ্ধকরণের কুটিল লক্ষ্য। স্কুলের ছাত্রদের খাবার থেকে আমিষ বাদ দেওয়ার ফরমান জারি হল। আরও বিধান দেওয়া হল – যে অভিভাবকদের দুটির বেশি সন্তান, তাঁরা গ্ৰাম পঞ্চায়েত নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। দ্বীপপুঞ্জের জনগণের আর্থিক নিরাপত্তাকে বিপর্যস্ত করতে বিভিন্ন অফিসে কর্মরত ঠিকা কর্মী, মিড-ডে মিল রন্ধন কর্মী, শারীরশিক্ষার শিক্ষকদের ছাঁটাই করা হল। দ্বীপপুঞ্জের জনগণের গুরুত্বপূর্ণ জীবিকা মাছ ধরার ওপর কোপ পড়ল। আর দ্বীপপুঞ্জে অপরাধ একরকম অনুপস্থিত হলেও অপছন্দের লোকদের বিনা বিচারে আটক করতে চালু করা হল গুণ্ডা দমন আইন। নিজের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করতে প্রফুল্ল খোড়া পটেল শিক্ষা, স্বাস্থ্য পরিষেবা, মৎস চাষ, পশুপালনের মতো দপ্তরগুলোকে পঞ্চায়েতের হাত থেকে নিয়ে এলেন নিজের কব্জায়। এরই পাশাপাশি জানিয়ে দেওয়া হল যে, প্রশাসক-বিরোধী মতামত প্রকাশ করলে তাকে সহ্য করা হবে না।

সম্প্রতি দ্বীপপুঞ্জের প্রথম চিত্র পরিচালক আয়েশা সুলতানার বিরুদ্ধে দ্বীপপুঞ্জের রাজধানী কোভারত্তি থানায় দেশদ্রোহের অভিযোগে এফআইআর দায়ের হয়েছে। এবং তার কারণ, টিভির একটি চ্যানেলে বিতর্কে অংশ নিয়ে আয়েশা প্রশাসক প্রফুল্ল খোড়া পটেলকে একটি জৈব অস্ত্রের সঙ্গে তুলনা করেন। সেই আলোচনায় আয়েশা সুলতানা বলেন, “লক্ষদ্বীপে একটিও কোভিড সংক্রমণ ছিল না। এখন রোজ একশ করে রোগী বাড়ছে। ওঁরা জৈব অস্ত্র প্রয়োগ করেছেন। আমি স্পষ্ট বলতে পারি, করোনা শূন্য একটা জায়গায় জৈব অস্ত্র প্রয়োগ করেছে কেন্দ্রীয় সরকার।” আয়েশার এই মন্তব্যের পিছনে যুক্তি হল – নতুন প্রশাসক আসার আগে (প্রফুল্ল খোড়া পটেল দ্বীপপুঞ্জের প্রশাসকের ভার নেন ২০২০-র ডিসেম্বরের গোড়ায়) লক্ষদ্বীপে কোভিড আক্রমণের কোনো ঘটনা ছিল না। কিন্তু এখন দ্বীপপুঞ্জে কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ৮৭০০ এবং কোভিডে মৃত্যু হয়েছে প্রায় ৪০ জনের। কোভিড সংক্রমণের বাড়বাড়ন্তের জন্য প্রশাসকের একটি পদক্ষেপই দায়ী বলে দ্বীপপুঞ্জের জনগণ মনে করেন। তাঁরা জানিয়েছেন, এই প্রশাসক আসার আগে মূল ভূখণ্ড থেকে কেউ দ্বীপপুঞ্জে গেলে তার ১৪ দিন কোয়রান্টিনে থাকাটা বাধ্যতামূলক ছিল এবং তা দ্বীপপুঞ্জে কোভিড সংক্রমণকে নিয়ন্ত্রিত করেছিল। নতুন প্রশাসক সেই নিয়ন্ত্রণবিধি তুলে দিয়ে শুধু সংক্রমণ না থাকার নেগেটিভ রিপোর্টকেই দ্বীপপুঞ্জে ঢোকার ও অবাধ বিচরণের ছাড়পত্র করে তোলেন। এবং এটাই দ্বীপপুঞ্জে কোভিড ছড়ানোর কারণ বলে তাঁরা মনে করেন। আয়েশা সুলতানা দ্বীপপুঞ্জের জনগণের এই অভিমতকেই ব্যক্ত করেছেন মাত্র।

কিন্তু আয়েশা সুলতানার ঐ মন্তব্যে বিজেপি দেশদ্রোহের নিদর্শন খুঁজে পেল। দ্বীপপুঞ্জের বিজেপি সভাপতি আব্দুল কাদের হাজি বললেন, আয়েশা তাঁর মন্তব্যে কেন্দ্রীয় সরকারকেই জৈব অস্ত্র বলে বুঝিয়েছেন এবং ঐ মন্তব্য “কেন্দ্রীয় সরকারের দেশপ্রেমিক ভাবমূর্তিকে কালিমালিপ্ত করেছে।” ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২৪এ ধারায় দেশদ্রোহ এবং ১৫৩বি ধারায় জাতীয় সংহতি বিরোধী সক্রিয়তার অভিযোগ এনে তাঁর বিরুদ্ধে এফ আই আর দায়ের হল কাভেরত্তি থানায়। থানার পুলিশ আয়েশা সুলতানাকে ২০ জুন তাদের কাছে হাজির হয়ে তার মন্তব্যের ব্যাখ্যা দিতে বলেছে। আয়েশার আশঙ্কা ঐ দিন তাঁকে গ্ৰেপ্তার করা হতে পারে এবং গ্ৰেপ্তারি এড়াতে তিনি কেরল হাইকোর্টে আগাম জামিনের আবেদন জানিয়েছেন।

তবে, আয়েশা সুলতানাকেই যে প্রথম এই প্রশাসকের রোষের মুখে পড়তে হল তা কিন্তু নয়। এর আগে দ্বীপপুঞ্জের কংগ্ৰেস সভাপতি এম আই আট্টাকইয়া এবং দুই সিপিআই(এম) নেতা পি পি রহিম ও আস্কার আলিকেও মামলার চোখরাঙানি ভোগ করতে হয়েছে, আর তার অছিলা হয়ে উঠেছিল একটা হোর্ডিং। সেই হোর্ডিংয়ে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের (সিএএ) বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে লেখা ছিল – “ভারত নরেন্দ্র মোদীর বাবার সম্পত্তি নয়।” এই তিন জনই হলেন লক্ষদ্বীপের সংবিধান সুরক্ষা সমিতির নেতা। সেই হোর্ডিং-এর নীচে কে বা কারা সংবিধান সুরক্ষা সমিতির নাম লিখে দিয়েছিল। হোর্ডিং এক বছর ধরে টাঙানো থাকলেও প্রফুল্ল খোড়া পটেল দ্বীপপুঞ্জে যাওয়ার পরই হোর্ডিং চর্চার বিষয় হয়ে ওঠে এবং হোর্ডিংকে কেন্দ্র করে মামলার পদক্ষেপ সক্রিয় হয়। দ্বীপপুঞ্জে অরাজকতা সৃষ্টিই যে প্রফুল্ল খোড়া পটৈলের একমাত্র এজেণ্ডা, হোর্ডিংয়ে উল্লিখিত মন্তব্যকে ছুতো করে কংগ্রেস ও সিপিআই(এম) নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের সেটাই দেখিয়ে দেয়।

আয়েশা সুলতানার বিরুদ্ধে এফ আই আর কিন্তু দ্বীপপুঞ্জে যথেষ্ট ক্ষোভ ও প্রতিবাদেরও জন্ম দিয়েছে। একের পর এক বিজেপি নেতা ও কর্মী স্বৈরাচারী প্রশাসকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে বিজেপি থেকে পদত্যাগ করেছেন, যাদের মধ্যে দ্বীপপুঞ্জে বিজেপির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল হামিদ মাল্লিপুঝাও রয়েছেন। বিজেপি সভাপতি আব্দুল কাদের হাজিকে লেখা চিঠিতে তাঁরা বলেছেন, “লক্ষদ্বীপের বিজেপি সম্পূর্ণ রূপে অবহিত যে, বর্তমান প্রশাসক পটেলের কাজ কতটা জনবিরোধী, গণতন্ত্র-বিরোধী এবং জনগণের দুর্ভোগের কারণ হচ্ছে।” অর্থাৎ, তাঁরা বলছেন যে, বিজেপি যদি জনস্বার্থ বিরোধী প্রশাসকের পাশে থাকে তবে সেই সংগঠনকে তাঁরা নিজেদের সংগঠন বলে মনে করতে পারেন না। চিঠিতে তাঁরা এটাও স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, লক্ষদ্বীপের জনগণের সঙ্গে হাত মিলিয়ে প্রশাসকের জনবিরোধী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তাঁদের প্রতিবাদ জারি থাকবে। লক্ষদ্বীপের জনগণ কালো পোশাক পরে ও বাড়িতে কালো পতাকা তুলে প্রফুল্ল খোড়া পটৈলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে ১৪ জুন কালা দিবস পালন করেন। তাঁরা প্ল্যাকার্ড ও ব্যানার তুলে ধরেন যাতে লেখা ছিল – “প্রফুল্ল খোড়া পটেলকে ফিরিয়ে নাও” এবং “প্রফুল্ল খোড়া পটেল ফিরে যাও।”

এফআইআর কিন্তু আয়েশা সুলতানাকে একটুও দমিয়ে দিতে পারেনি। এফআইআর-এর বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে আয়েশা বলেছেন, “অবাধে মত প্রকাশের জন্য যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখানো হয়েছে তাতে লেশমাত্র ভয় হচ্ছে না। এর বিপরীতে, দেশদ্রোহের অভিযোগ নিয়ে আমি একটুও উদ্বিগ্ন হব না এবং ওরা আমার মুখ বন্ধ করতে পারবে না।” তিনি লক্ষদ্বীপের জনগণের সঙ্গে কালা দিবস পালনে অংশ নিয়েছেন এবং তাঁর ফেসবুক পোস্টে মন্তব্য করেছেন, “লক্ষদ্বীপের জনগণ ফ্যাসিবাদকে আর বরদাস্ত করবেন না। আমরা স্বৈরাচারী নীতিগুলোর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবো, এবং লক্ষদ্বীপের ওপর চালানো অবরোধকে কাটিয়ে উঠব।” একটা ছোটো দ্বীপপুঞ্জের এক ব্যক্তিত্ব যখন মত প্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে ও স্বেচ্ছাচারের বিরুদ্ধে এইভাবে রুখে দাঁড়ানোর কথা বলেন, তখন তা আমাদের আশ্বস্ত করে। লক্ষদ্বীপকে আর একটা কাশ্মীরে পরিণত করার বিরুদ্ধে লড়াই জারি রাখার দ্বীপপুঞ্জের জনগণের অঙ্গীকার আমাদের অবশ্যই ভরসা যোগায়।

-- জয়দীপ মিত্র 

খণ্ড-28
সংখ্যা-22