টিকাকরণে ভারতের ভরাডুবির জন্য দায়ী মোদী সরকার
Modi Government Is Responsible

ভারতে টিকার ঘাটতি যে চরম মাত্রায় পৌঁছেছে তা গোপন কোনো ব্যাপার নয়, সকলেই সে সম্পর্কে অবহিত। মোদী সরকার ১৮ থেকে ৪৪ বছর বয়সীদের টিকাকরণের আওতায় নিয়ে আসায় অনেক বিশেষজ্ঞই এব্যাপারে সহমত পোষণ করছেন যে, ভারতের টিকা তৈরির সামর্থ্য এবং আনুষঙ্গিক প্রতিকূলতা যেমন রয়েছে, তাতে খুব বেশি হলেও ভারত ২০২২’র মাঝামাঝি সময়ের আগে তার সব প্রাপ্ত বয়স্কদের টিকাকরণ সম্পূর্ণ করে উঠতে পারবে না। টিকাকরণে এই বিলম্ব ভারতের কাছে সর্বনাশা হয়েই দেখা দিতে পারে, কেননা, দুনিয়ায় এবং তারসাথে ভারতেও যে কোভিড১৯-এর পরবর্তী পর্যায়ের তরঙ্গগুলো দেখা দেবে তা একরকম অবধারিত। অন্ততপক্ষে সমস্ত প্রাপ্ত বয়স্কদের টিকাকরণে এই বিলম্বের দায় সরাসরি বর্তাচ্ছে মোদী সরকারের ওপর। বিমুদ্রাকরণের মতো মোদী-সৃষ্ট অধিকাংশ বিপর্যয়ের ক্ষেত্রে যা দেখা গেছে, টিকাকরণ কর্মসূচীর ক্ষেত্রেও সেটাই দেখা যাচ্ছে। টিকা নিয়ে বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্যে একাকার হয়ে আছে হামবড়া ভাব, ধৃষ্টতা ও প্রশাসনিক অপাদর্থতা।

বিহার বিধানসভা নির্বাচনকে নজরে রেখে মোদী ২০২০ সালের আগস্ট মাসে ঘোষণা করেছিলেন যে, ভাইরাসের বিরুদ্ধে ভারতীয় টিকা ২০২০’র ১৫ আগস্টের মধ্যে তৈরি হয়ে যাবে। এটা একটা মিথ্যা বলেই প্রতিপন্ন হল এবং এটার মধ্যে দিয়ে এই সংকেতই সর্বপ্রথম মিলল যে, টিকাকরণের মতো গুরুত্বপূর্ণ সর্বজনীন স্বাস্থ্য উদ্যমের চেয়ে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করাতেই মোদী সরকারের যাবতীয় সুখ। ভাইরাস প্রতিরোধী টিকা ২০২১’র জানুয়ারীতেই  মিলবে, এই কথাটা সর্বজনবিদিত ব্যাপার হলেও মোদী সরকার টিকার জন্য প্রথম দফার বরাতটা দিল ২০২১’র ১৭ জানুয়ারী ভারতের টিকাকরণ কর্মসূচী শুরু হওয়ার মাত্র এক সপ্তাহ আগে। ততদিনে বাংলাদেশের মতো দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশিরা সহ বিশ্বের অনেক দেশই টিকার জন্য বরাত দিয়ে রেখেছে। অপর দিকে, মোদী সরকার কিন্তু দেশের রাষ্ট্রায়ত্তক্ষেত্রের টিকা প্রস্তুকারক সংস্থাগুলোকে পুনরিজ্জীবিত করে টিকা তৈরিতে সক্ষম করে তুলল না। ফলে, আমরা এক পূর্ণাঙ্গ সংকটে নিমজ্জিত হয়েছি, যেখানে কোভিড১৯-এর দ্বিতীয় ঢেউ ভারতকে বিধ্বস্ত করেছে এবং টিকার তীব্র আকালের মধ্যে আমরা পড়ে গেছি।

অর্থমন্ত্রী বাজেটে শুধুমাত্র টিকাকরণের জন্যই ৩৫,০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছিলেন। সমস্ত প্রাপ্ত বয়স্কদের দু’ডোজ করে টিকা দিয়ে টিকাকারণ সম্পূর্ণ করার পক্ষে এই পরিমাণ টাকা প্রয়োজন মিটিয়েও বাড়তি হবে, কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার হল, ১৮ থেকে ৪৪ বছর বয়সীদের টিকাকরণের আর্থিক দায় মোদী সরকার চাপিয়ে দিয়েছে রাজ্য সরকারগুলোর ঘাড়ে। ভারতই হল একমাত্র দেশ যেখানে কোভিড-১৯ টিকাকরণ কর্মসূচীর আর্থিক ভারকেন্দ্র সম্পূর্ণত বহন করছে না। নতুন টিকানীতি বেসরকারী হাসপাতাল, ইত্যাদিদের টিকা প্রস্তুতকারকদের কাছ থেকে সরাসরি টিকা কেনার অনুমতিও দিয়েছে। এরফলে, দেশে টিকদানের ক্ষেত্রে আমরা এক বড় আকারের বিভাজন উদ্ভূত হতে দেখছি, যেখানে বেসরকারী হাসপাতাল এবং আবাসিক কল্যাণ সমিতিগুলো সরাসরি টিকা কিনে ডোজ প্রতি একেবারে ১,৫০০ টাকা পর্যন্ত নিয়ে টিকা প্রদান করছে, আর সরকার চালিত টিকাদান কেন্দ্রগুলোতে টিকা অমিল হচ্ছে।

মোদী সরকার কিন্তু উদ্ভূত এই বিভাজনের দিকে চোখ বুজে থাকছে এবং এই তালগোল পাকানো অবস্থার দায়কে পাশ কাটানোর যথাসাধ্য চেষ্টা করছে। সে টিকার ঘাটতির মোকাবিলায় উদ্ভট এবং বিপজ্জনক উপায় হাজির করছে। হরিয়ানার বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী মনোহর লাল খট্টর বলেন, দিল্লীতে অল্প সময়ে টিকা নিঃশেষ হয়েছে, কারণ, সেখানে “অতি দ্রুত হারে টিকা দেওয়া হয়েছে!” সরকার এমনকি কোভিশিল্ড টিকার দ্বিতীয় ডোজ তুলে দেওয়ার কথাও বিবেচনা করছে, যাতে টিকাকরণের লক্ষ্যমাত্রা দ্রুত সম্পন্ন করা যায়। এই পদক্ষেপের কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই এবং তা মানুষের জীবনকে বিপন্ন করে তুলবে – সরকারের কিন্তু কোনো হেলদোল নেই। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রকাশ জাভড়েকর দাবি করেছেন যে, ২০২১’র ডিসেম্বরের মধ্যেই সরকার ভারতের সমস্ত জনগণের টিকাকরণের কাজ সম্পূর্ণ করবে, কিন্তু এরজন্য যে ২০০ কোটি ডোজ টিকার প্রয়োজন সেটা কোথা থেকে পাওয়া যাবে সে কথা তিনি  প্রকাশ করছেন না। বিদেশমন্ত্রী সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরে গিয়েছিলেন টিকা জোগাড়ের উদ্দেশ্যে, কিন্তু তাঁকে খালি হাতে ফিরতে হয়েছে, কেননা, বিশ্বের টিকা প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলো অন্যান্য দেশকে টিকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে রেখেছে।

সরকারের কাছে কোনো প্রশ্ন করলেই বিরোধীপক্ষকে দোষী সাব্যস্ত করে সেই প্রশ্নকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া হচ্ছে এবং এমন সমস্ত বিবৃতি দেওয়া হচ্ছে, যাতে বাস্তব ঘটনার তেমন পরোয়া করা হচ্ছে না। তার টিকা-নীতির সমর্থনে মোদী সরকার যা কিছু বলেছে তাতে বুনিয়াদি এই প্রশ্নটার কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি, আমাদের প্রতিবেশিরা সহ অন্যান্য দেশের মতো মোদী সরকার গত বছরেই টিকার বরাত দেয়নি কেন এবং টিকা প্রস্তুতকারক দেশীয় সংস্থাগুলোকে টিকা তৈরির উপযোগী করে তোলেনি কেন? সরকার যখন টিকা সম্পর্কে অবিশ্বাস তৈরির জন্য বিরোধীপক্ষকে দোষারোপ করছে, তখন তারা কিন্তু হাতুড়ে রামদেবের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না, যিনি টিকা না নেওয়ার জন্য প্রকাশ্যেই জনগণের কাছে আবেদন জানিয়েছেন!

মোদী সরকার যে টিকা-নীতি নিয়ে চলছে তাকে অবিলম্বে শোধরাতে হবে। বর্তমান নীতিকে যেমন পাল্টাতে হবে, সেরকমই টিকাও সংগ্ৰহ করতে হবে কেন্দ্রীয়ভাবেই। অনেক বেসরকারী কোম্পানিই সরাসরি রাজ্যগুলোকে টিকা বিক্রি করতে অসম্মত হয়েছে, কাজেই, সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করে কেন্দ্রকেই টিকা কিনতে হবে। বাস্তবসম্মত নীতির ভিত্তিতেই রাজ্যগুলোকে টিকা বরাদ্দ করতে হবে এবং রাজ্যগুলো যাতে সমাজের অসহায় ও শ্রমজীবী দরিদ্র অংশগুলোকে চিহ্নিত করে অগ্ৰাধিকারের ভিত্তিতে তাদের টিকাকরণ করতে পারে সেই নমনীয়তা গ্ৰহণের অধিকার তাদের দিতে হবে। ভারত বিনাখরচে সকলের টিকাকরণের সফল যে নীতি বরাবর অনুসরণ করে এসেছে, সরকারকে সেই নীতিতে ফিরে যেতে হবে এবং ডিজিটাল প্রযুক্তির সুবিধা নিতে না পারা এবং আধার না থাকা যেন টিকা নেওয়ার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে না দাঁড়ায়। এবং রামদেব ও অন্যান্য হাতুড়েরা যে সমস্ত দায়িত্বজ্ঞানহীন বিবৃতি দিয়েছেন, সেগুলোকে ধিক্কার জানিয়ে সরকারকে প্রকাশ্য বিবৃতি দিতে হবে।

মোদী সরকারের নিকৃষ্ট পরিকল্পনা এবং ঔদ্ধত্যের জন্য দেশের নাগরিকদের অকল্পনীয় দুর্দশা ভোগ করতে হয়েছে। তৃতীয় তরঙ্গের জন্য তারা প্রস্তুত হয়ে আছে, সরকারের পক্ষে দর্প-তাড়িত এমন বিবৃতি বন্ধ করার এটাই প্রকৃষ্ট সময়; মোদীর ভাবমূর্তির সুরক্ষায় ব্যস্ত না থেকে টিকাকরণ ক্ষেত্রে কাজকে তাদের অবিলম্বে গুছিয়ে নিতে হবে।
(এম-এল আপডেট সম্পাদকীয়, ১ জুন ২০২১)

খণ্ড-28
সংখ্যা-21