স্মরণ – স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত
 Swati Lekha Sengupta

বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত একাত্তর বছর বয়সে প্রয়াত হলেন। তাঁর অভিনয় জীবনের সূত্রপাত বালিকা বয়সেই। যখন তাঁর বয়েস মাত্র সাত বছর, সেই সময়েই তিনি কারাগার নাটকে কীর্তিমান চরিত্রে অভিনয় করেন। সেই সময়ে স্বাতীলেখার পিতা রামদাস হালদার পরিবার নিয়ে থাকতেন এলাহাবাদে। সেখানেই ১৯৫০ সালে তাঁর জন্ম। ১৯৫৭-তে সাত বছর বয়সে অভিনয় জীবন শুরু করে তার পরের পনেরো বছর এলাহাবাদের নানা মঞ্চে তিনি নানা বাংলা, হিন্দি ও ইংরেজি নাটকে অভিনয় করেন। পড়াশুনো করেন স্নাতকোত্তর স্তর পর্যন্ত। এলাহাবাদ পর্বে স্বাতীলেখার অভিনীত নাটকগুলির মধ্যে রয়েছে কারাগার, নূরজাহান, মিলিয়নেয়ারস, মিড সামারস নাইট ড্রিম, ওথেলো, অ্যাজ ইউ লাইক ইট, মার্চেন্ট অব ভেনিস, বিজিবডি, দ্যা ব্যারেটস অব উইমপোল স্ট্রিট, নেফা কি এক সাম, কাঞ্জনরঙ্গ, খনা প্রভৃতি।

অভিনয়ের পাশাপাশি স্বাতীলেখা দক্ষ হয়ে ওঠেন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সঙ্গীতে। বিশেষভাবে শেখেন বেহালা ও পিয়ানো। লন্ডনের ট্রিনিটি কলেজ থেকে পাশ্চাত্য মার্গসঙ্গীতে ডিপ্লোমা রয়েছে তাঁর। ১৯৭২ সালে তিনি তাঁর প্রথম স্বামী অধীপ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে চলে আসেন কোলকাতায়। এই বিবাহ সম্পর্ক স্থায়ী না হলেও নাট্যমঞ্চের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক অব্যাহত থাকে। ‘কলকাতার ইলেকট্রা’ নাটকে স্বাতীলেখার অভিনয় দেখে মুগ্ধ হন নান্দীকারের অন্যতম সংগঠক রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত। তাঁর আহ্বানে স্বাতীলেখা নান্দীকারে যোগ দেন ১৯৮৭ সালে। রুদ্রপ্রসাদের সঙ্গে তাঁর বিবাহও হয়।

১৯৮৭ থেকে ২০২১ - নান্দীকার নাট্যগোষ্ঠীর সঙ্গে স্বাতীলেখা দীর্ঘ চৌত্রিশ বছর যুক্ত ছিলেন। এখানে তিনি অসংখ্য নাটকে অভিনয়ের পাশাপাশি নাট্য প্রযোজনার নানা ধরনের কাজ করেছেন। পোশাক পরিকল্পনা, নির্দেশনা, আবহসঙ্গীত রচনা ছাড়াও বেশ কিছু নাটকের অনুবাদও তিনি করেছিলেন। তার অনূদিত নাটকের মধ্যে আছে আকিরা কুরোসাওয়ার রসোমন অবলম্বনে মাননীয় বিচারকমণ্ডলী, টুয়েলভ অ্যাংরি মেন অবলম্বনে এক থেকে বারো (এর সহ অনুবাদক ছিলেন রুদ্রপ্রসাদ), মুনশি প্রেমচাঁদ অবলম্বনে বড়দা। তবে একের পর এক নাটকে তাঁর অসামান্য অভিনয়ই তাঁকে বাংলার সাংস্কৃতিক মহলে সুপরিচিত ও বিখ্যাত করে তুলেছে। নান্দীকারে স্বাতীলেখা সেনগুপ্তের অভিনীত নাটকগুলির মধ্যে আছে নটী বিনোদিনী, ফুটবল, খড়ির গণ্ডি, আন্তিগোনে, যখন একা, নাট্যকারের সন্ধানে ছটি চরিত্র, মুদ্রারাক্ষস, ব্যতিক্রম, মাননীয় বিচারকমণ্ডলী, হনন মেরু, নীলা, শঙ্খপুরের সুকন্যা, শেষ সাক্ষাৎকার, ফেরিওয়ালার মৃত্যু, গোত্রহীন, বেষটের খোঁজে, এই শহর এই সময়, পাতা ঝরে যায়, নগরকীর্তিন, সোজন বাদিয়ার ঘাট প্রভৃতি। শানু রায়চৌধুরী নাটকে তিনি একক অভিনয়ে দর্শকদের মাতিয়ে রাখেন।

নান্দীকার ছাড়াও অন্যান্য দলের কিছু নাটকে স্বাতীলেখা অভিনয় করেছিলেন। এর মধ্যে রয়েছে থিয়েটার ওয়ার্কশপের শোয়াইক গেল যুদ্ধে, কলকাতা নাট্যকেন্দ্রর গ্যালিলেওর জীবন, সায়কের সাঁঝবেলা ইত্যাদি। রঙ রূপ প্রযোজিত খুঁজে নাও নাটকটির পরিচালক ছিলেন তিনি।

স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত মূলত থিয়েটার জগতেরই মানুষ। তবে তাঁর অভিনয় জীবনের আরেকটি দিক তাঁর সিনেমায় অভিনয়। সত্যজিৎ রায়ের ঘরে বাইরে তে বিমলার ভূমিকায় তিনি অভিনয় করেন। এর বহুদিন পরে জীবন সায়াহ্নে এসে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে বেলাশেষে সিনেমায় আরেকবার তাঁকে ফিল্ম অভিনয়ে দর্শক দেখতে পান।

১৯৯৬-তে তিনি পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমির শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত নির্দেশকের পুরস্কার পান। ১৯৯৭ তে পান শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার। নাটকের সূত্রে বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন রাজ্য ছাড়াও তিনি গেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ইংল্যান্ড, কানাডা, নরওয়েতে। থিয়েটারের সঙ্গে সমাজকে যুক্ত করার দৃষ্টিকোণ থেকে স্বাতীলেখা ধারাবাহিকভাবে অনেক কাজ করেছেন। বিদ্যালয় স্তরের ছাত্রছাত্রীদের নাটকে আগ্রহী করে তোলার উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি লিখেছেন “থিয়েটার গেমস ফর স্কুল চিলড্রেন” নামের এক সাড়া জাগানো বই। নান্দীকারের থিয়েটার ইন এডুকেশন প্রকল্পের সহ নির্দেশক ছিলেন স্বাতীলেখা। পশ্চিমবঙ্গের নানা জেলায় স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি নিয়মিত থিয়েটার ওয়ার্কশপ করেছেন। পথশিশু, বস্তিবাসী, দৃষ্টিহীন মানুষজন বা যৌনকর্মীদের জন্যও অভিনয় শিবির আয়োজন করেছেন।

--  সৌভিক ঘোষাল  

খণ্ড-28
সংখ্যা-22