“পেটেন্ট বলে কোনো বস্তু হয় না, আপনি কি সূর্যের পেটেন্ট নিতে পারেন”। কেন তিনি তাঁর উদ্ভাবিত টিকার পেটেন্ট নেননি, এই প্রশ্নের উত্তরে পোলিও টিকার আবিষ্কারক জোনাস সক এই মন্তব্য করেন।
ভারতে যে শম্বুকগতিতে টিকাকরণ চলছে তা সারা বিশ্বে উদ্বেগের সৃষ্টি করছে। তার কারণ শুধু এই নয় যে, এড়ানো যেত এমন হাজার-হাজার, হয়ত বা লক্ষ-লক্ষ মৃত্যু ঘটবে মাঝে-মাঝেই হানা দেওয়া কোভিড তরঙ্গের কারণে এবং তার কারণেই বিপর্যস্ত হবে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। ঐ উদ্বেগের আরও কারণ হল, সংক্রমণের ছড়িয়ে যাওয়ার ফলে হয়ত ভাইরাসের রূপান্তরণ ঘটবে যা টিকাকে সম্পূর্ণরূপে অকার্যকরী করে তুলবে। বিশ্বের বিজ্ঞানীরা এবং চিকিৎসক সম্প্রদায় সুবিপুল আত্মত্যাগের মধ্যে দিয়ে যে সাফল্য অর্জন করেছেন, এর মধ্যে দিয়ে তার পুরোপুরি বিলুপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, ফলে যে তিমিরে আমরা ছিলাম সেই তিমিরেই আমাদের ফিরে যেতে হতে পারে। দ্রুত টিকাকরণের পথে একটা বাধা হল মেধাসত্ব নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা যা প্রযুক্তিজ্ঞানের অবাধ চলাচলে বাধা দেয় এবং যা এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার লক্ষ-কোটি দরিদ্রদের স্বার্থের বিনিময়ে ধনী কর্পোরেট সংস্থাগুলোর সুবিধা করে দেয়।
বাণিজ্য সম্পর্কিত মেধাসত্ব (ট্রিপস) এবং বিশ্ব মেধাসত্ব ব্যবস্থা গতবছর অক্টোবর মাসে ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকা এবং তারসাথে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থাভুক্ত ৫৭টি সদস্য দেশ ট্রিপস চুক্তির কয়েকটি বিধান ছাড় দেওয়ার প্রস্তাব করে, যাতে কোভিড-১৯’কে প্রতিহত করা, প্রশমিত করা ও তার চিকিৎসা করা সম্ভব হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, গ্ৰেট ব্রিটেন, জাপান এবং অন্য কয়েকটি দেশের বিরোধিতায় গত সাতমাসে এই বিষয়ে কোনো অগ্ৰগতি হতে পারেনি। মোদীর বহু বিজ্ঞাপিত বিদেশনীতি, যা ২০১৯ সালে তাঁর দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, এই বিরোধিতার মুখে তাসের ঘরের মতো ভেঙ্গে পড়ে। মোদী কানাডার মতো বিশ্বের ধনী দেশগুলোকে টিকা বিলিয়ে, টিকা কূটনীতিতে চীনকে টেক্কা দিতে চাইলেও মৈত্রীর ধারা দুদিক থেকেই বইল না, দেখা গেল, আমাদের প্রয়োজনের সময় কোনো প্রতিদানমূলক প্রতিক্রিয়া অপর দিক থেকে এলো না।
অতিমারী শুরুর প্রথম দিকের মাসগুলোতে বিশ্বের নেতৃবৃন্দ এবং কর্পোরেট কর্তারা সামাজিক সহযোগিতার ভাষায় কথা বলতে লাগলেন, কিন্তু অল্প কিছুদিনের মধ্যেই দেখা গেল, পুঁজিবাদের অধীনে জনগণের স্বার্থের চেয়ে পুঁজির স্বার্থই সর্বদা বেশি গুরুত্ব পায়। বিশ্বের সমাজতন্ত্রীরা টিকা বিক্রি থেকে মুনাফা করার কর্পোরেট সংস্থাগুলোর প্রচেষ্টার সমালোচনা করলেন, কিন্তু প্রচলিত ব্যবস্থার সমর্থকরা দাবি করলেন, ‘মুনাফা’ আছে বলেই ওষুধ প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলো দ্রুতই টিকা বার করতে সক্ষম হয়েছে। এই দাবি একটা নির্ভেজাল মিথ্যা, কেননা, যথেষ্ট পরিমাণে সরকারী অনুদান এবং সরকারী অর্থপুষ্ট গবেষণার মধ্যে দিয়েই টিকার উদ্ভব সম্ভব হয়েছে। টিকা তৈরিতে ভারতীয় নৈপুণ্যের পোস্টার বয় হিসাবে আবির্ভূত হওয়া আদার পুনাওয়ালা এইজন্যই উৎপাদনে গতি আনতে পেরেছিলেন যে, দ্রুতগতিতে উৎপাদন করার উদ্দেশ্যেই তিনি ২০০৬ সাল থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আর্থিক সহায়তা পেয়ে এসেছেন।
তথ্যের যে অবাধ আদান-প্রদানের ভিত্তিতে টিকার উদ্ভব সম্ভব হয়েছিল, দ্রুতই তাকে পরিত্যাগ করে এমন একটা মডেল নিয়ে আসা হল যাতে টিকা তৈরির উদ্যোগে পুঁজিবাদী মুনাফাকেই অগ্ৰাধিকার দেওয়া হল। সকলে নিখরচায় টিকা পেতে পারে এমন ফলপ্রসূ রাস্তা ধনী দেশগুলো আটকে দিয়েছে। আমরা সবাই জানি, এবছরের এপ্রিল মাসে কোভিড-১৯’র দ্বিতীয় তরঙ্গ ভারতে যখন আছড়ে পড়ল, সেই সময় জীবনদায়ী ওষুধ তৈরির কাঁচামাল আমদানিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিভাবে আটকে দিয়েছিল। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে আমেরিকা অবশ্য টিকা তৈরির ক্ষেত্রে মেধাস্বত্বের অধিকারে কিছুটা ছাড় দিতে সম্মত হয়েছে। তবে, ভারত এবং দক্ষিণ আফ্রিকা প্রথমে যে প্রস্তাব দিয়েছিল, যাতে চিকিৎসা, রোগ নির্ণয়ের কিট, ভেন্টিলেটর ইত্যাদি সহ কোভিড-১৯’র মোকাবিলায় অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্যে ছাড়ের যে প্রস্তাব ছিল, তার তুলনায় মেধাসত্বের ছাড়ে মার্কিনের এই আংশিক সম্মতি প্রদান নেহাতই কম।
সকলের জন্য টিকা
ধনী দেশগুলোর সম্মিলিত জনসংখ্যা যেখানে বিশ্বের জনসংখ্যার ১৪ শতাংশ, সেখানে তাদের হাতে রয়েছে মোট টিকার ৫৩ শতাংশ, যার অনেকটাই মজুত করা হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকায় অনুমোদন না দিলেও তারা ঐ টিকার লক্ষ-লক্ষ ডোজ নিজেদের কব্জায় রেখেছে, আর অন্যান্য দেশ মরিয়া হয়ে এর প্রয়োগে সম্মতি দিলেও ঐ টিকা আমদানি করতে পারেনি। দক্ষিণ আফ্রিকাকে টিকার জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের আড়াই গুণ দাম দিতে হয়েছে। এগুলো সবই পুঁজিবাদ চালিত টিকা কর্মসূচীর বুনিয়াদি সমস্যাকে দেখিয়ে দেয়।
মেধাসত্বে ছাড় টিকা তৈরির প্রক্রিয়ায় গতি আনতে সহায়তা করলেও তা কিন্তু অভিপ্রেত সমাধানের থেকে অনেক দূরে থাকছে। এই অভিমত পোষণ করা হয়েছে যে, “তাদের লব্ধ জ্ঞানকে ভাগ করে নেওয়া এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোতে উৎকৃষ্ট গুণমানের, শ্রেণীগত সংস্করণের টিকা তৈরির লক্ষ্যে উৎপাদনক্ষমতা নির্মাণের জন্য ওষুধ কোম্পানিগুলোকে আর্থিক প্রণোদনা জোগানোর দরকার হতে পারে।” এই ব্যাপারটা মেধাসত্ব নিয়ন্ত্রণের একটা বুনিয়াদি সমস্যাকে দেখিয়ে দেয় যার কেন্দ্রে রয়েছে উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করার চেয়ে মুনাফাকে সুরক্ষিত করার তাড়না। মুনাফাই উদ্ভাবনকে চালিত করে, এই ধারণা বারবারই মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়েছে।
পরিস্থিতির প্রতিকারে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সংস্থাগুলোকে নিয়ে গঠিত পিপলস ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্স এই আবেদনগুলো জানিয়েছে।
স্বাস্থ্য পরিষেবার বেসরকারীকরণের দরুণ গুরুতর সংকটের মোকাবিলা দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছে এবং দীর্ঘমেয়াদে এই ক্ষতিকে পূরণ করতে হবে। জনগণের স্বাস্থ্য এবং মুনাফা কখনই একসাথে চলতে পারে না এবং এই দুটিকে পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্ন করার এটাই প্রকৃষ্ট সময়।
(লিবারেশন, জুন ২০২১ সংখ্যা থেকে)
-- ঐশিক সাহা