বিপর্যস্ত বিজেপির নাগরিকত্বের টোপ
The bait of citizenship

গত ২৮ মে কেন্দ্রীয় সরকার ঘোষণা করে যে পাঁচটি রাজ্যের তেরোটি জেলায় পাকিস্তান, আফগানিস্তান এবং বাংলাদেশ থেকে আসা অমুসলিম ছয়টি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষদের নাগরিকত্ব প্রদান করা হবে। এই পাঁচটি রাজ্য হল গুজরাট, ছত্তিসগড়, হরিয়ানা, পাঞ্জাব এবং রাজস্থান – গুজরাটের চারটি জেলা, ছত্তিসগড়ের দুটি, রাজস্থানের পাঁচটি, হরিয়ানা ও পাঞ্জাবের একটি করে জেলা। যে ছয়টি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে নাগরিকত্ব প্রদান করা হবে তাঁরা হলেন – হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, খ্রিস্টান এবং পার্সি। লক্ষ্যনীয় যে কেন্দ্রীয় সরকার বলছে ডিসেম্বর, ২০২০-র সিএএ (নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন) অনুযায়ী নাগরিকত্ব দেওয়া হবে না কারণ সেই আইনের নিয়মকানুন এখনো তৈরি হয়নি। এই নোটিফিকেশনে বলা হচ্ছে নাগরিকত্ব দেওয়া হবে সিটিজেনশিপ অ্যাক্ট ১৯৫৫-র সেকশন ৫, ৬ এবং সিটিজেনশিপ রুলস, ২০০৯ মোতাবেক।

১৯৫৫র আইনের ৫ নম্বর ধারায় কী আছে? সেখানে কারা নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারবেন বলা হচ্ছে? প্রথমত তিনি বেআইনি অভিবাসী অর্থাৎ ইল্লিগাল মাইগ্রেন্ট নন। দ্বিতীয়ত আবেদনকারীকে অন্তত সাত বছর ভারতে বসবাস করতে হবে। তৃতীয়ত তাঁকে জন্মসূত্রে ভারতীয় হতে হবে এবং অবিভক্ত ভারতবর্ষের বাইরে অন্য কোনও দেশের নাগরিক হতে হবে। চতুর্থত তিনি কোনও ভারতীয় নাগরিকের পতি বা পত্নী যিনি অন্তত সাত বছর এই দেশে বসবাস করেছেন। পঞ্চমত কোনও ভারতীয় নাগরিকের অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তানরা। ধারা ৬ নম্বরে ন্যাচারালাইজেশন-এর মাধ্যমে নাগরিকত্ব পাওয়ার কথা বলা আছে। ন্যাচারাইলেজশন হল রাষ্ট্র যখন স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কাউকে নাগরিকত্ব প্রদান করে অথবা যখন কেউ কোনও জটিল প্রক্রিয়া বা আইনের বাঁধা ছাড়াই শুধুমাত্র আবেদন করে নাগরিকত্ব পেতে পারেন। ২০০৯-এর সিটিজেনশিপ রুলস হচ্ছে কোন ফর্মে কীভাবে এবং কার কাছে আবেদন করতে হবে এই সংক্রান্ত নিয়মাবলী।

প্রথমেই বলা হচ্ছে ‘বেআইনি অভিবাসী’ আবেদন করতে পারবেন না। ‘বেআইনি অভিবাসী’ কারা এর ব্যাখ্যা ২০০৩-এর নাগরিকত্ব আইনে আছে। সেখানে বলা হচ্ছে যাঁরা পাসপোর্ট ছাড়া অথবা ভিসার মেয়াদ ফুরানোর পরও এ দেশে থেকে গেছেন তাঁরাই ‘বেআইনি অভিবাসী’। এর অর্থ যাঁদের পাসপোর্ট আছে কিংবা ভিসার মেয়াদ ফুরিয়ে যায়নি তাঁরাই খালি আবেদন করতে পারবেন। যাঁরা ঐ তিনটি দেশ থেকে এখানে আশ্রয়ের খোঁজে এসেছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই বিভিন্ন চাপে পড়ে এসেছেন। এর ফলে তাঁদের কাছে পাসপোর্ট নাও থাকতে পারে। নতুন দেশে সরকারি আইনকানুন সম্পর্কে পরিচিত না হওয়ার কারণে অনেকেই ভিসার মেয়াদ না বাড়িয়ে থাকতে পারেন। সুতরাং এই সব মানুষ তাঁরা অমুসলিম হলেও কিন্তু নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারছেন না। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ১৯৫৫-র আইনের ৫ ও ৬ নম্বর ধারা দুটিতে কোনও বিশেষ দেশ (পড়ুন পাকিস্তান, আফগানিস্তান, বাংলাদেশ) থেকে আসা মানুষদেরই শুধু নাগরিকত্ব দেওয়া হবে এটা কোথাও বলা হয়নি। তেমনি অমুসলিম সংখ্যালঘুদেরই শুধু নাগরিকত্ব দেওয়া হবে এটাও বলা হয়নি। ঐ আইনে কারা আবেদন করতে পারেন এবং মূলত কী কী শর্তে তার সারমর্ম ওপরে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। তিনটি দেশ থেকে আগত মানুষ এবং ছয়টি অমুসলিম জনগোষ্ঠির কথা শুধুমাত্র ২০১৯-এর কুখ্যাত সিএএতেই আছে। এর থেকে এটা পরিষ্কার কেন্দ্রীয় সরকার মুখে ১৯৫৫-র আইন এবং ২০০৯র নিয়মাবলী বললেও বাস্তবে তারা ২০১৯-এর কুখ্যাত আইনই অনুসরণ করছে, যে আইনের নিয়মাবলী তাদের কথাতেই এখনো তৈরি হয়নি। এর জন্য বিরোধীরা সংগত ভাবেই আওয়াজ তুলেছে যে এটা ঘুর পথে সিএএ চালু করার চেষ্টা। আমরা এটাও জানি যে আসামে আসু এবং অন্যান্য সংগঠন এই প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে ইতিমধ্যেই আন্দোলনে নেমে পড়েছে।

তাহলে হঠাৎ সরকার ঝুলি থেকে এই বিড়ালটা বার করলো কেন? তারা বলেছিলো বাংলায় নির্বাচনে জিতলে মন্ত্রীসভার প্রথম মিটিংয়েই তারা সিএএ লাগু করবে। তা বাংলার মানুষ তো মুখে ঝামা ঘষে দিয়েছে। কিছু পেটোয়া লোক নাকি কান্না গাইছে যে ১৩টি জেলার মধ্যে, বাংলার একটিও জেলা নেই যেখানে নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। বুদ্ধুরা এটা জানেনা যে যেই মুহূর্তে যিনি আবেদন করবেন, ঠিক তখন থেকেই এতদিন তিনি যে ভারতবর্ষে বসবাস করেছেন, চাকরি-বাকরি করেছেন, ভোট দিয়েছেন সমস্ত কিছুই তিনি বেআইনি বলে স্বীকার করে নেবেন। তিনি তাঁর এতদিনের বসবাস ও কর্মসূত্রে স্বাভাবিকভাবেই নাগরিক, তাঁকে আবার নতুন করে আবেদন করতে হবে কেন? দেশটা কী কারো বাপের সম্পত্তি! দাবি হবে এটাই যে দেশের প্রতিটি মানুষকে নিঃশর্তে নাগরিকত্ব দিতে হবে।

২০১৮-র অক্টোবর মাসেও কেন্দ্রীয় সরকার সাতটি রাজ্যের ষোলোটি জেলায় নাগরিকত্ব দেওয়ার নোটিশ জারি করেছিল। তখন দু-মাসের মধ্যেই রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিসগড়, তেলেঙ্গানা এবং মিজোরামে বিধানসভা নির্বাচন ছিল। হিন্দুদের নাগরিকত্ব দেওয়ার ধুয়ো তুলে একটা মেরুকরণ করার চেষ্টা হয়েছিলো যদিও চারটি প্রধান রাজ্যেই বিজেপি বিপর্যস্ত হয়েছিল। এখন তো সামনে কোনও নির্বাচন নেই কিন্তু গত সাত বছরে বিজেপি কখনো এরকম গভীর সংকটের সম্মুখীন হয়নি। কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর সাঙ্গপাঙ্গদের অকর্মণ্যতাকে বেআব্রু করে দিয়েছে। বিদেশে ছত্রিশ ইঞ্চির ভাবমুর্তি কলুষিত, কৃত্তিমভাবে ফুলিয়ে তোলা তাঁর ফানুশ চুপসে গেছে, দেশে তাঁর জনপ্রিয়তা তলানীতে, অর্থনীতি অভুতপূর্বভাবে বেহাল। এই অবস্থায় মানুষের দৃষ্টি অন্যত্র ঘোরানো আবশ্যক। আগামী মার্চের মধ্যে উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখন্ড, পাঞ্জাব সহ পাঁচটি রাজ্যে নির্বাচন। সঙ্ঘীদের সবচেয়ে চিন্তা ইউপি নিয়ে। পঞ্চায়েতে বিপর্যয়ের ফলে তাঁরা ত্রস্ত। তার ওপর অতিমারীর ফলে ঐ রাজ্যের মানুষের অবস্থা শোচনীয়। নির্বাচনের দশ মাস আগে থেকেই তারা ২০০০০ গ্রামে প্রচার শুরু করে দিয়েছে। মুখে তারা বলছে এটা করোনা সেবা প্রকল্প কিন্তু আসলে এটা নির্বাচনি প্রচারের শুরুয়াত ছাড়া আর কিছু নয়।

এই অভুতপূর্ব সংকট থেকে সাময়িক ভাবে রেহাই পাওয়ার জন্য বিজেপি এখন যে কোনও ইস্যুকে ঢাল করতে চাইছে। নাগরিকত্ব প্রদান করার এই নোটিশ এরকমই একটা জুমলা।

- সোমনাথ গুহ 

খণ্ড-28
সংখ্যা-20