কোভিড মহামারীতে কেন্দ্রীয় সরকারের ঔদাসীন্য : ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়
the world is prone to hunger

করাল মহামারীর দ্বিতীয় তরঙ্গে সমগ্র দেশ আবারও নিমজ্জিত। ১৩০ কোটি জনসংখ্যার দেশে জনস্বার্থের দুর্বল ভিত্তিতে কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছে এই দ্বিতীয় তরঙ্গ। একদিকে সংক্রমণের হার অব্যাহত, অন্যদিকে ধর্মীয় জমায়েত এবং নির্বাচনী সমাবেশ নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের অখণ্ড নীরবতা। আর এই পরিস্থিতি ক্রমেই বাড়িয়ে চলেছে কোটি কোটি দরিদ্র ভারতীয়ের প্রাণের ঝুঁকি, অনাহার, কর্মচ্যুতি এবং নিরাপত্তাহীনতার সঙ্কট।

সম্প্রতি অধ্যাপক প্রভাত পট্টনায়েকের প্রকাশিত হাঙ্গার ওয়াচের রিপোর্ট দেখিয়েছে কীভাবে কোভিড মহামারী এবং লকডাউনের কারণে বিশেষত প্রান্তিক ও বঞ্চিত সম্প্রদায়ের পরিবারগুলির আয় এবং খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা  হ্রাস  পেয়েছে, কীভাবে তা এবং ক্ষুধা বাড়িয়ে তুলেছে।

হাঙ্গার ওয়াচ তার প্রতিবেদনে রাইট টু ফুড ক্যাম্পেইন, ইন্ডিয়া এবং সেন্টার ফর ইক্যুইটি স্টাডিজ এর যৌথ উদ্যোগে হওয়া একটি বড়ো মাত্রার সমীক্ষার ফলাফল তুলে ধরেছে। এই সমীক্ষা  মার্চ ২০২০ লকডাউনের আগের কয়েক মাস থেকে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ২০২০ পর্যন্ত খাদ্য সুরক্ষা পরিস্থিতির তুলনামূলক ছবির  উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছে। ১১টি রাজ্যের  ৩৯৯৪টি পরিবারের মধ্যে এই সমীক্ষা হয় যাদের বেশিরভাগই প্রান্তিক এবং বঞ্চিত সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করে।

সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়েছে যে ২০২০ সালের অক্টোবরে ১০ জন উত্তরদাতাদের মধ্যে ৭ জন জানিয়েছেন যে তাদের দৈনন্দিন খাদ্যের পুষ্টিগুণ নিম্নমানের হয়ে গেছে এবং প্রায় ৬৬% শতাংশ উত্তরদাতা জানিয়েছেন মার্চে দেশব্যাপী লকডাউন ঘোষণা  হওয়ার আগে তারা যে পরিমান খাদ্য খেতেন অর্থনৈতিক কারণে ততটা খাদ্য গ্রহণ করার মতো ক্ষমতা এখন আর তাদের নেই, কম খেতে হচ্ছে। মানুষ শুধু ডিম এবং মাংসের মতো বেশি দামি খাবারগুলি তাদের খাদ্যতালিকা থেকে বাদ দিতে বাধ্য হয়েছেন। শুধু তাই নয়, এর পাশাপাশি ভাত রুটির মতো প্রধান খাদ্য খাওয়াও কমাতে বাধ্য হয়েছেন। উত্তরদাতাদের মধ্যে অনেকেই অনাহারে, অনেকে ঠিকমতো খেতে না পেয়ে শয্যাশায়ী এবং কেউ কেউ এই পরিস্থিতি সামাল দিতে ধারে চাল, ডাল কিনে চালাচ্ছেন।

প্রতিবেদনে বলছে যে এই মহামারীতে শহরের দরিদ্র মানুষ গ্রামের দরিদ্রদের থেকে বেশি আক্রান্ত। তৎসহ দলিত, অস্তিত্ব সঙ্কটগ্রস্ত আদিবাসী জনগোষ্ঠী, মুসলমান জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি নিঃসঙ্গ মহিলা, বয়স্ক ও প্রতিবন্ধী মানুষের অবস্থা আরও খারাপ। তারা জানিয়েছেন তাদের দৈনন্দিন খাদ্য গ্রহণ অনেকটা হ্রাস করতে বাধ্য হয়েছেন।

শহরের দরিদ্রদের উল্লেখযোগ্য অনুপাতে রেশন কার্ড নেই। গ্রামাঞ্চলের উত্তরদাতাদের ৯০% রেশন কার্ড রয়েছে, শহরের ক্ষেত্রে তা মাত্র ৬৫%। যেহেতু উত্তরদাতাদের সকলেই অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল তাই সাধারণভাবে সকলের রেশন কার্ড থাকার কথা, তুলনামূলকভাবে গ্রামীণ দরিদ্রদের কাছে খাদ্য বন্টন ব্যবস্থা ভালো।

যদিও খাদ্য বন্টন ব্যবস্থা, মিড-ডে মিল স্কিম এবং আইসিডিএস প্রোগ্রামগুলি তাৎক্ষণিকভাবে খাদ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে এবং অপুষ্টি কাটিয়ে উঠতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নীতিগত পদক্ষেপ ছিল, কিন্তু প্রতিবেদনে হচ্ছে যে “আমরা দেখতে পেয়েছি যে খাদ্য বন্টন ব্যবস্থা সবার কাছে পৌঁছয়নি, যারা এই ব্যবস্থার বাইরে ছিল তারা বাইরেই থেকে গেছে, এই ব্যবস্থার সুযোগ তারা পাচ্ছে না। একটা ব্যাপার স্পষ্ট ছিল যে এই খাদ্য বন্টন ব্যবস্থার অন্তর্গত মানুষের কাছে  এটি  বেঁচে থাকার একমাত্র উপায় – এই ব্যবস্থা না থাকলে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার পরিস্থিতি আরও খারাপ হত। পাশাপাশি এই ব্যবস্থার সর্বাত্মক অধিকার না থাকায় এই মহামারী পর্যায়ে ব্যাপক ক্ষুধার খবর পাওয়া গেছে।” মধ্যাহ্নভোজ ও আইসিডিএসের মতো অন্যান্য প্রকল্পগুলির ক্ষেত্রে কেবলমাত্র উত্তরদাতাদের অর্ধেক পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন। নভেম্বরে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলি চালু করার অনুমতি পাওয়ায় আশা করা হচ্ছে যে পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। এই সমস্ত প্রকল্পগুলির কেবলমাত্র গুরুত্বপূর্ণই নয় পাশাপাশি সমস্ত যোগ্য জনগোষ্ঠী যাতে এই সুবিধা পায় তার ব্যবস্থা না করলে এই ক্ষুধার থাবা ক্রমশ লম্বা হতে থাকবে।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, সাম্প্রতিক সরকারি নীতিমালা এবং আইনী ঘোষণার ফলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। সদ্য চালু হওয়া চারটি শ্রম কোড অসংগঠিত খাতের কর্মীদের ক্রয় করার ক্ষমতাকে আঘাত করবে। তৎসহ, তিনটি কৃষি আইন নিয়ে কৃষক আন্দোলনের সমাধান না করতে পারলেও খাদ্য বন্টন ব্যবস্থা সংকটে পড়বে।

প্রতিবেদন আরো বলছে ২০২০-২১ থেকে ২০২১-২২-এ আইসিডিএস, মিড ডে মিল, প্রসূতি প্রাপ্য এই রকম ক্ষুধা ও অপুষ্টি হ্রাসকারী খাতগুলিতে বরাদ্দ কমিয়ে দেয়া হয়েছে। এনরেগার বাজেট বরাদ্দ গত বছরের তুলনায় ৩৪.৫% কমিয়ে দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ মহামারীতে একটা জন কল্যাণকর সরকার যা যা সিদ্ধান্ত নেয়, ঠিক তার বিপরীত জন বিরোধী সিদ্ধান্ত নিয়ে মোদী সরকার এই ক্ষুধার সাম্রাজ্যকে আরো বাড়িয়ে তুলছে।

হাঙ্গার ওয়াচ রিপোর্ট মহামারীতে উদ্ভুত খাদ্য সংকট সামলাতে সরকারের প্রতি ১২টি সুপারিশ করেছে। তারমধ্যে কয়েকটি হলো একটি সর্বজনীন খাদ্য বন্টন ব্যবস্থা যা প্রতিটি ব্যক্তিকে কমপক্ষে পরবর্তী ছয় মাসের জন্য ১০ কেজি শস্য, ১.৫ কেজি ডাল এবং ৮০০ গ্রাম রান্নার তেল সরবরাহ করে। তৎসহ দূরত্ব, স্যানিটাইজেশন ইত্যাদি সম্পর্কিত সমস্ত সুরক্ষা নির্দেশিকা অনুসরণ করে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র এবং স্কুল মিড ডে মিল ইত্যাদির মধ্য দিয়ে ডিম সহ পুষ্টিকর গরম রান্না করা খাবার বিতরণ করা, কোভিড মহামারীতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্তদের অগ্রাধিকার দিয়ে সার্বজনীন শিশু যত্ন ও তদারকি ব্যবস্থা; বৃদ্ধ, বৃদ্ধা, নিঃসঙ্গ মহিলা ও দিব্যাঙ্গদের মাসে ২০০০ টাকা ভাতা; এনরেগা প্রকল্পে পরিবার পিছু বছরে ২০০ দিনের কাজ এবং সময় মতো মজুরি প্রদান নিশ্চিত করা, শহরে অস্থায়ী শ্রমিকদের সম্মানজনক মজুরি বৃদ্ধি। জাতীয় নগর কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা প্রকল্প অবিলম্বে চালু কর দরকার যা বিভিন্ন নামে ওড়িশা ঝাড়খণ্ড ও হিমাচল প্রদেশে চলছে।

– মৃনাল 

খণ্ড-28
সংখ্যা-20