নামহীন অবয়বহীন স্বীকৃতিহীন কর্মীদের জীবন যন্ত্রণা
The life suffering of unnamed workers

(বেঙ্গালুরুর কিছু এআইসিসিটিইউ কর্মী বিভিন্ন শ্মশান, কবরস্থানে গিয়ে শ্মশান কর্মীদের জীবন-যন্ত্রণার কাহিনী লিপিবদ্ধ করেন। এই সমস্ত নামহীন, অন্তরালে থাকা কর্মীদের রিপোর্ট বেশ আলোড়ন তোলে। দ্য হিন্দু সংবাদপত্র গুরুত্ব দিয়ে তা প্রকাশ করে। এআইসিসিটিইউ কর্তৃক প্রকাশিত ওয়েভ পত্রিকা ‘ওয়ার্কার্স রেজিস্টান্স’র জুন, ২০২১ সংখ্যায় এর বিস্তারিত রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। এখানে তার অনুবাদ প্রকাশিত হল।)

কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ এবার দেশজুড়ে কেড়ে নিয়েছে অনেক নাগরিকের প্রাণ। আর, এই সমস্ত মৃত্যুর অন্তিম সৎকার করতে গিয়ে কবরস্থান ও শ্মশানের উপর চাপ অনেক বেড়েছে। আমরা জেনেছি কিভাবে স্থানীয় প্রশাসন এই সমস্ত সমস্যাকে সমাধান কর‍তে হিমশিম খাচ্ছে, কিভাবেই বা সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে গণচিতা বা গণকবরগুলোকে, অস্বাভাবিক চাপের মুখে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ছে বিদ্যুৎ চুল্লিগুলো। মৃতদেহগুলো দাহ করার জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না। কর্ণাটকে, বেঙ্গালুরুর আর্চ বিশপ বৃহৎ বেঙ্গালুরু মহানগর পালিকা (বিবিএমপি)’র কাছে কাতর আবেদন জানিয়েছেন যাতে, ক্রিশ্চান সম্প্রদায়ের মৃত ব্যক্তিদের সম্ভ্রমের সাথে কবর দেওয়া যায়। আর, সবার অলক্ষ্যে চাপা পড়ে গেছে, শ্মশান ও কবরস্থানের কর্মীদের উপর নেমে আসা অকল্পনীয় কাজের বোঝা! তাঁদের অব্যক্ত যন্ত্রণা, দুঃখ দুর্দশার করুণ কাহিনী।

জাতপাতগতভাবে দলিত সম্প্রদায়ের মানুষের উপর আরোপিত এই অন্তিম সৎকারের কাজটি তাঁরা করে চলেছেন বংশ পরম্পরাগত ভাবে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর। মৃতদেহ সৎকারের ‘প্রথাগত’ এই পেশাটি নীচু চোখে দেখা হয়, আর এজন্য এই কাজ বা পেশাটি ইনফর্মাল, তা যতই সরকার বা ব্যক্তি মালিকানাধীন সংস্থা মারফত পরিচালিত হোক না কেন। এই সমস্ত কর্মীরা সামান্যতম মর্যাদা পান না, নাগরিকদের সমস্ত অধিকার থেকে তাঁরা বঞ্চিত। বেঙ্গালুরুর প্রায় কুড়িটি শ্মশান ও কবরস্থান ঘুরে আমরা দেখলাম, এদের নেই কোনো ন্যূনতম মজুরি, সমস্ত ধরনের আইনগত, বিধিবদ্ধ সুযোগ সুবিধা থেকে তাঁরা বঞ্চিত। তাঁদের কাজটিকে নিয়মিত করা হয়নি, ইএসআই–পিএফ-পেনশন তাঁদের কাছে আজও অধরা। এদের সমস্ত অধিকার থেকে বঞ্চিত ও বর্জিত কর্মীবৃন্দ হিসাবেই গণ্য করা হয়। সাবেক শ্মশান বা কবরস্থানের পরিষেবা কর্মী হিসাবে এদের পরিচিতি।

এই কর্মীরা বছরে ৩৬৫ দিনই কাজ করেন। এদের নেই কোনো ধরনের ছুটি। নেই সাপ্তাহিক, জাতীয়, উৎসবকালীন বা ক্যাজুয়াল অথবা আপৎকালীন ছুটি। হঠাৎ, অগুন্তি শবদেহ শ্মশান বা কবরস্থানে আসতে থাকায়, বিরামহীনভাবেই এরা কাজ করে চলেছেন দিনে ১২ ঘণ্টা। প্রতিটি সরকারী বা বেসরকারী শ্মশান বা কবরস্থানে সারাক্ষণ কাজ করা কিছু কর্মী রয়েছেন, যারা কোনোদিন সময়মতো মাসিক মজুরি পান না। সময়মতো মজুরি না পাওয়াটাই যেন তাঁদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য এক আইনসিদ্ধ নিয়ম। যতজন কর্মীর সাথে আমাদের কথা হয় তাতে জানা গেল যে, অতিমারির আগেও তাঁরা পেতেন না নিয়মিত মজুরি। সরকারী শ্মশান বা কবরস্থানে যারা কাজ করেন, তাঁরা কয়েকমাস পর পর পান কিছু থোক টাকা, কিন্তু সেক্ষেত্রেও কত ঘণ্টা তাঁরা কাজ করেছেন, তার হিসাব থাকে না। তাঁদের মজুরি ঠিক কত, কিভাবেই বা তার হিসাব হয়, তা তাঁদের অজানা। মৃতদেহ সৎকারের অত্যাধিক চাপ থাকায় এই কয়মাস উদ্বৃত্ত কর্মীদের কাজে লাগানো হচ্ছে। কিন্তু তাঁরা কেউ জানেননা ঠিক কত মজুরি তাঁরা পাবেন। কয়েকটি ক্ষেত্রে দেখা গেল, অত্যাধিক কাজের চাপ সামলাতে তাঁরা কেউ কেউ নিজেদের পরিচিত লোকজনকে কাজে লাগাচ্ছে, আর নিজেদের মজুরির একটা অংশ তাঁদের দিতে হচ্ছে। এই এপ্রিল মাসে অম্বেদকার দলিত সংঘর্ষ সমিতি, রুদ্রভূমি সংঘর পতাকাতলে এই সমস্ত কর্মীরা তাঁদের বকেয়া মজুরির দাবিতে ব্যাঙ্গালোরে মুখ্যমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ সংগঠিত করেন। তাঁদের বকেয়া মজুরি প্রদানে নিশ্চয়তা দিলেও মুখ্যমন্ত্রী ওই সমস্ত কর্মীদের জ্বালা-যন্ত্রণা, অপমান, বঞ্চনাগুলো দূর করার ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপই নেননি। কোনো নির্দিষ্ট মজুরি না থাকায় তাঁদের কোনো মাসে ১,০০০ বা কখনো ১,৫০০ টাকাতেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। তাঁরা মূলত নির্ভর করেন সেই সমস্ত পরিবারগুলোর দান বা বকশিশের উপর যারা তাঁদের প্রিয় পরিজনদের শেষকৃত্য সম্পন্ন করার জন্য আসেন।

এই সমস্ত কর্মীরা পিপিই কিট পান, যেহেতু তাঁদের কোভিড মৃতদেহ নিয়ে নাড়া চাড়া করতে হয়। কিন্তু যে সমস্ত কর্মীরা শেষ কৃত্যের জন্য কাঠ ব্যবহার করেন, তাঁরা পিপিই পরেন না, কারণ, ওই কিটগুলো দাহ্য পদার্থ, দ্রুতই তাতে আগুন ধরে যায়। এরকম এক কর্মী পিপিই পরে কাজ করার সময়ে গুরুতরভাবে আহত হন। আজ পর্যন্ত কারুরই কোভিড পরীক্ষা হয়নি, নিয়োগকর্তারা তাঁদের টিকার ও ব্যবস্থা করেনি। হাতে গোনা কয়েকজন নিজেদের উদ্যোগে টিকা নিয়েছেন। কোভিডে মৃত ব্যক্তিদের দাহকাজের সাথে যুক্ত হওয়া সত্ত্বেও সরকার এদের ফ্রন্টলাইন কর্মী বলে স্বীকৃতি দিচ্ছে না।

এই সমস্ত কর্মীরা নিজ নিজ পরিবার নিয়ে বসবাস করেন শ্মশান বা কবরস্থানেই। কিছুদিন যাবৎ, বিদ্যুৎচুল্লির সাথে যুক্ত কর্মীরাও সেখানেই থাকছেন পরিবার নিয়ে, কিন্তু সেখানে নিকাশী বা পানীয় জলের বুনিয়াদি সুযোগ সুবিধা নেই। অনেকেই আবার আশপাশ এলাকায় বৈষম্যের শিকার। যেমন, মহিলারা এলাকার আশপাশে পরিচারিকার কাজ করেন। কিন্তু, তাঁদের থাকার জায়গা জানাজানি হলে কাজ থেকে ছাড়িয়ে দেওয়া হয়।

এই সমস্ত কর্মীদের ফ্রন্টলাইন কর্মী হিসাবে স্বীকৃতি দিতে হবে। তাঁদের ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের জীবনের সুরক্ষা দিতে হবে। শুধুমাত্র ন্যূনতম মজুরিই নয়, এই কাজটাকেও আইনী স্বীকৃতি দিয়ে নিয়মিত করতে হবে। সময়মতো মজুরি প্রদান, বিধিবদ্ধ সুযোগ সুবিধা, বাড়তি শ্রমের জন্য বাড়তি মজুরি প্রভৃতি বিষয়গুলো সরকারকে সুনিশ্চিত করতে হবে।

খণ্ড-28
সংখ্যা-21