প্রত্যাহার কর! বাতিল কর!
Withdraw!

সর্বোচ্চ আদালতে কোভিড সংক্রান্ত রাষ্ট্রদ্রোহের একটি মামলা খারিজ হয়ে গেল। অভিযুক্ত করা হয়েছিল কয়েক দশকের বহুল পরিচিত প্রবীণ সাংবাদিক বিনোদ দুয়াকে। তার এফ আই আর দায়ের করেছিলেন হিমাচল প্রদেশের এক বিজেপি নেতা। তাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে সুপ্রীম কোর্টে গিয়েছিলেন দুয়া। অভিযোগ নস্যাৎ করা প্রসঙ্গে ডিভিশন বেঞ্চের দুই বিচারপতি একসুরে বলেছেন, সরকারের সমালোচনা বা বিরোধিতা মানেই রাষ্ট্রদ্রোহ নয়। ভারতের সংবিধানে ১৯(১)(ক) ও ২১ ধারায় নাগরিকের স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার এবং মানবাধিকার রক্ষার সংস্থান আছে। সুতরাং সংবাদ মাধ্যম সংস্থা থেকে সংবাদ কর্মী – প্রত্যেকের আইনানুগ অধিকার রয়েছে যে কোনো মতামত প্রকাশের। ঠিক-বেঠিক ভালো-মন্দ যার যা মনে হোক, সরকার-পুলিশ-প্রশাসন-সেনাবাহিনী বা বিচারব্যবস্থার বিরুদ্ধে মতপ্রকাশ হলেও, তাকে কোনোভাবেই রাষ্ট্রদ্রোহ আইনে অভিযুক্ত করা যায় না। শ্রীযুক্ত দুয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি কোভিড মোকাবিলার প্রশ্নে মোদী সরকারের শোচনীয় ব্যর্থতা-অপদার্থতা-স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন।

কোভিড প্রশ্নে আজ দেড়বছরে দেশ কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে? সংক্রমণের প্রথম ঢেউয়ে উন্মোচিত হয়েছে মোদী সরকার ও বিজেপির নানা চতুরামি। লক ডাউন, পরিযায়ী শ্রমিকদের অবর্ণনীয় দুর্দশা, নগদ অর্থ না মেলা, অনাহার-অর্ধাহার-মৃত্যুর ক্ষয়ক্ষতির পরেও ভাব দেখানো হয়েছিল করোনাকে নিয়ন্ত্রণ করা গেছে, শেষ বিদায় জানানো বাকি। তারপর পাঁচ রাজ্যের আসন্ন নির্বাচনে ঝাঁপানোর উদ্দেশ্যে স্বাস্থ্যবিধিকে শিথিল করা হল। আর তারপরের মর্মান্তিক পরিণতি হল সংক্রমণের প্রবল দ্বিতীয় ঢেউয়ে আক্রান্ত হল লক্ষ লক্ষ মানুষ, শহর-শিল্পাঞ্চল থেকে গ্রাম-গ্রামান্তর, পার্বত্য অঞ্চল-নদীতট, কোথাও সংক্রমণের থেকে নিস্তার পাওয়ার নিশ্চয়তা রইল না! ভেঙ্গে পড়ল সরকারী-বেসরকারী স্বাস্থ্য ব্যবস্থা! সরকারী হাসপাতালকে সর্বস্তরে সম্প্রসারিত না করে তিন দশক যাবত মোহ ছড়ানো হয়েছিল বেসরকারী হাসপাতাল ব্যবস্থার। কোভিডের ধাক্কায় আজ তার কল্পনাতীত নিষ্ঠুরতা ভোগ করছে মানুষ। “হেলথ্ ওয়ার্কার”- “ফ্রন্টলাইনার”রা উজাড় করে দিচ্ছেন নিজেদের। কিন্তু চারিদিকে শুধু হাহাকার। টেস্ট, ওষুধ, সেফ হোম, এ্যাম্বুলেন্স, বেড, ডাক্তার, নার্স, অন্যান্য স্বাস্থ্য সহায়িকা, এ্যাডমিশন, অক্সিজেন, ভেন্টিলেশন, ভ্যাকসিন – সবকিছুরই ব্যাপক অভাব, তীব্র সংকট। সরকারী হাসপাতালে ভর্তি হলে ফতুর হতে হচ্ছে না। কিন্তু স্থান সংকুলানের সমস্যা থাকছে প্রবল। বেসরকারী হাসপাতাল, নামীদামী ‘স্পেশ্যালিটিগুলো’ নাজেহাল ও সর্বস্বান্ত করে ছাড়ছে। কোভিড চিকিৎসার ওষুধ মিলছে না খোলা দোকানে, তার চোরাকারবার চলছে আট-দশ গুণ বেশি দামে অন লাইনে, নানা ডেরায়। এবার মোদী সরকার শুরু করল ইতরামি। সবকিছু ঘটছে কেন্দ্রের নাকের ডগায়। অথচ আটকাতে কোনো ভিজিল্যান্স নেই, কোনো সিবিআই-ইডির নাম নেই। বাংলার দখল পেতে মরীয়া হয়ে গোটা নির্বাচনী প্রচারে বিজেপি ‘আয়ুষ্মান ভারত’ থেকে শুরু করে ‘আত্মনির্ভর ভারত’ নির্মাণের নামে চালায় সস্তা প্রচার, মিথ্যাচার। ভ্যাকসিনের প্রশ্নে মানুষকে রাখা হচ্ছে অনিশ্চয়তায় অন্ধকারে। দেশের মধ্যে টিকার উৎপাদন বৃদ্ধি, বিদেশ থেকে আমদানি, সংরক্ষণের ব্যবস্থা, বিনা মূল্যে দেওয়া, সব বয়সীদের সর্বজনীনভাবে দেওয়া, ডোজের মূল্য নির্ধারণ – সমস্ত বিষয়ে চলেছে চূড়ান্ত অমানবিকতা, শঠতা, নির্মমতা, বৈষম্য, প্রতারণা। ব্যবহার করা হচ্ছে এমন এক ‘অতিমারী আইন’ যা পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণের নামে সাধারণ মানুষের ওপর দমন চালানোর অস্ত্র হিসেবেই প্রমাণিত সত্য। এই সবকিছু যখন উন্মোচন, প্রতিবাদ, বিরোধিতার সম্মুখীন হতে শুরু করল, তখন বিজেপি-মোদী সরকার যোগসাজশ করে ভয় দেখাতে চুপ করাতে রাষ্ট্রদ্রোহ আইনে ফাঁসাতে লাগল। তার শিকার সবচেয়ে বেশি হয়েছেন সংবাদ কর্মীরা, যারা জীবনের ঝুঁকি নিয়েও মানুষের চোখ-কান খুলে দেন। এই কারণেই ফাঁসানো হয়েছিল সাংবাদিক বিনোদ দুয়াকে। কেবলমাত্র তাঁকে যে অন্যায়ভাবে অভিযুক্ত করা হয়েছিল তা নয়। এহেন অপচেষ্টা চালিয়ে আসা হচ্ছে আরও বহু ক্ষেত্রে। রাষ্ট্রদ্রোহ আইন প্রয়োগ করা হয়েছে ছাত্র আন্দোলন, মানবাধিকার আন্দোলন, পরিবেশ আন্দোলন, কৃষক আন্দোলন, এনআরসি- সিএএ বিরোধী আন্দোলন-সংগঠন-কর্মীদের বিরুদ্ধে। বিভিন্ন তকমা লাগিয়ে দিয়ে, অজুহাত দেখিয়ে। কোভিড প্রশ্নেও প্রয়োগ হচ্ছে ঐ জনবিরোধী আইন।

গত ফেব্রুয়ারীতে সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় তুলে ভাইরাল হওয়ার কারণে কর্ণাটক থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল সমাজকর্মী দিশা রবিকে, তবে তার সুপ্রীম কোর্ট থেকে জামিন পাওয়া আটকাতে পারেনি সরকার। মার্চ মাসে রাষ্ট্রদ্রোহ আইনে অভিযোগের হাত থেকে রেহাই পান ফারুখ আবদুল্লা। মে মাসের শেষে সুপ্রীম কোর্ট ভর্ৎসনা করে অন্ধ্র পুলিশকে দুটি টিভি চ্যানেলকে রাষ্ট্রদ্রোহ আইনে অভিযুক্ত করার দায়ে। এরকম মামলা গড়িয়েছে প্রচুর। এটা ঘটনা ও প্রবণতা যে, ভারতের শাসকশ্রেণীর দলগুলোর এই আইনে ঐকমত্য থাকছে। তারা অবস্থা বুঝে ভিন্ন ভিন্ন কৌশল নেয়, গরজ থাকলে কিছুটা সরব সক্রিয় হয়, নয়তো নীরব নিষ্ক্রিয় থাকে। তবে ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস্ ব্যুরোর তথ্য বলছে, কেন্দ্রে মহামহিম মোদীরাজের আমল শুরু হওয়া থেকেই রাষ্ট্রদ্রোহ আইনে দমন অনেক বেড়েছে। এই আইনে ২০১৪ সালে কেস ছিল ৪৭টি, চার্জশীট পেশ হতে পেরেছিল ১৬টি, আর সাজা ঘোষণা হয়েছিল মাত্র ১টি ক্ষেত্রে। তারপর থেকে প্রত্যেক বছরে লাফ দিয়ে দিয়ে বাড়ানো হয়েছে অভিযুক্তের, গ্রেপ্তার করার ও মামলার সংখ্যা, কিন্তু সাজা দেওয়া সম্ভব হয়েছে মাত্র দু’চারজন করে। ২০১৬-১৯ পাঁচ বছরে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলার বৃদ্ধি ঘটানো হয়েছিল ১৬০ শতাংশ, আর দোষী সাব্যস্ত করা গেছিল মাত্র ৩ শতাংশ। এই পরিসংখ্যান বুঝিয়ে দেয়, রাষ্ট্রদ্রোহ আইন প্রয়োগের পলিসি-প্রবণতার ভিত্তিটাই ভূয়ো। এই আইন গণতন্ত্র বিরোধী। যে জনবিরোধী আইন ব্রিটিশ আমলে ১৮৭০ সালে তৈরি করা হয়েছিল ঔপনিবেশিক শাসনের স্বার্থে, সেই আইন দূর্ভাগ্যবশত আজও স্বাধীন ভারতের সংবিধানে রেখে দেওয়া হয়েছে, যা আদৌ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সঙ্গতপূর্ণ নয়, কিছুতেই থাকতে পারে না। ইতিমধ্যে যেখানে অনেক আগেই ব্রিটেনে এহেন আইনের অবলুপ্তি ঘটানো হয়েছে, আরও বহু দেশেই বিলোপ করা হয়েছে, সেখানে সিডিশন আইন উপনিবেশমুক্ত স্বাধীন গণতান্ত্রিক ভারতে থাকবে কেন? প্রশ্ন উঠছে অবিরত আদালতের ভেতরে-বাইরে। আইনটি প্রত্যাহারের দাবির চাপের মুখে ২০১৮ সালে একবার আইন কমিশন বসেছিল পর্যালোচনায়। কিন্তু ঐ পর্যন্তই। এই অবস্থা দাবি জানায়, দেশবাসীকে গণতান্ত্রিক অধিকার ও নাগরিক স্বাধীনতার স্বার্থে সচেতন ও সংগঠিত হতে হবে; নামতে হবে আন্দোলনের রাস্তায়। দাবি তুলতে হবে একজোড়া – রাষ্ট্রদ্রোহ আইনে দায়ের করা সমস্ত মামলা প্রত্যাহার কর! রাষ্ট্রদ্রোহ আইন বাতিল কর!

খণ্ড-28
সংখ্যা-21