কৃষক বন্ধু প্রকল্প সম্পর্কে
About Farmer Friend Project_0

কৃষক বন্ধু প্রকল্পে পাঁচ হাজার টাকা বাড়ানো হল, কিন্তু চাষিদের সংকট বা লোকসান আদৌ কমল না।

ভাগচাষি ও কৃষি শ্রমিকদের প্রতি থাকছে সীমাহীন বঞ্চনা ও প্রতারণা।

রাজ্যের তৃণমূল সরকার ‘কৃষক বন্ধু’ প্রকল্পে চাষিদের বছরে পাঁচ হাজারের বদলে দশ হাজার টাকার সাহায্য ঘোষণা করেছে। এক একরের ঊর্ধ্বে জমি থাকলে দশ হাজার, আর তার নীচে থাকা সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রায় ৮০ ভাগ ক্ষুদ্র চাষিরা পাবেন মাত্র চার হাজার টাকা বা তার সামান্য বেশি! এই যৎসামান্য সহায়তার মধ্য দিয়ে সরকার আসলে স্বীকার করে নিল এরাজ্যের চাষিদের ব্যাপক লোকসান চলছে, চাষিরা মোটেই ভালো নেই। চাষিদের আয় ‘তিনগুন’ হয়ে গেছে – এই সরকারি প্রচারের আদৌ কোনো বাস্তবতা নেই। এই প্রকল্পের মধ্য দিয়ে চাষিদের সংকট আদৌ কমল না, উল্টে বছরের পর বছর চাষিরা ফসলের ন্যায্য দাম না পেয়ে অভাবী বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে কেন, সেখান থেকে নজর ঘুরিয়ে দেওয়া হল। যেমন বর্তমানে গ্রামাঞ্চলে এক কুইন্টাল ধান বিক্রি হচ্ছে ১,১০০ থেকে ১,২০০ টাকায়, অথচ সরকারি দর ১,৮৬৫ টাকা, আগামী মরশুম থেকে আরও ৭০ টাকা বাড়ছে। অর্থাৎ চাষিদের লোকসান কুইন্টাল পিছু ৬৫০ টাকারও বেশি। বিপরীতে সার, বীজ, বিদ্যুতের দাম অর্থাৎ চাষের খরচের বিপুল বৃদ্ধি হয়ে চলেছে। তাহলে চাষিদের আয় বাড়ছে কোথায়? দেশব্যাপী চাষিদের যে দাবি আজ সর্বস্তরে স্বীকৃতি পেয়েছে তা হল উৎপাদিত ফসল উৎপাদন খরচের দেড়গুণ দামে কিনতে হবে। কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকার সেই গ্যারান্টি করার আইন বা বিধি তৈরি করছে না কেন? রাজ্য সরকারের অর্থসাহায্যের টাকা বাস্তবে যারা পাবেন তাদের বড় অংশই অ-কৃষক জমির মালিক।

মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করলেন বর্গাদার অথবা ভাগচাষি এমনকি যারা নথীভুক্ত নয়, তারাও নাকি এই সহায়তা পাবেন। যে সব ভাগচাষিদের জমির কাগজপত্র নেই তাঁরা একটা হলফনামা দিলেই প্রকল্পের সুবিধা পাবেন –  সাংবাদিক সম্মেলনে মুখ্যমন্ত্রী একথা বলেছেন। বাস্তবে ‘কাগজহীন’ কৃষকদের কাছে প্রকল্পটি সম্পূর্ণ প্রতারণামূলক। সরকারি নির্দেশিকার প্রথমেই বলা হয়েছে, আরওআর (রাইটস অফ রেকর্ডস) / পরচা সংগ্রহে অসুবিধা হয় বলে কৃষকদের স্বঘোষিত হলফনামা গ্রাহ্য হবে। অর্থাৎ জমির মালিকানা অথবা দখলিসত্ব থাকতেই হবে। স্বেচ্ছাপ্রদত্ত নথি যাচাই করে ব্লকের ভূমি আধিকারিকরা ব্যবস্থা নেবে। যার জমিই (বা দখলিসত্ব) নেই তার তদন্ত রিপোর্ট তো নেতিবাচক হবেই। সরকারি আদেশনামার এক জায়গায় পরিষ্কার লেখা রয়েছে, “যারা এখনও নথিভুক্ত হননি ... তারা জমির মালিকানা বা দখলনামার তথ্য দিয়ে আবেদন করতে পারবেন।” সুতরাং কাগজহীন ঠিকা বা চুক্তি চাষিরা এই প্রকল্প থেকে বঞ্চিত থেকে যাবেন, দরখাস্ত ফর্মে লেখা রয়েছে ‘স্বঘোষণা পত্র সহ নথি’। নথি বলতে সেইতো মালিকানা বা দখলনামার কথা বলা হয়েছে। এছাড়া জমির দাগ নং সহ অন্যান্য তথ্য অনথীভূক্ত ভাগচাষিরা পাবে কোথায়? জমির মালিকরা বিনাস্বার্থে কি তা দেবে? বর্গা হয়ে যেতে পারে এই আশংকা থেকে মালিকরা কি চাইবে যে ভাগচাষিরা সরকারি স্বীকৃতি লাভ করুক! একমাত্র সরকার যদি সরেজমিন তদন্ত করে এদের তালিকা তৈরি করে কেবল তাহলেই অনথিভূক্ত ভাগচাষিরা যোগ্য বলে বিবেচিত হতে পারবে। তাই অবিলম্বে সরকারকে অনথীভূক্ত ভাগচাষি-চুক্তিচাষিদের তালিকা তৈরি করতে হবে, এদের সরকারি সমস্ত প্রকল্পের সুবিধা দিতে হবে।

ওদিকে কেন্দ্রীয় সরকার ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নির্ধারণে (সি+ ৫০%) কারচুপি করছে। চাষিদের সম্পদ লুঠ হয়ে চলেছে। যথা ধানের কুইন্টাল পিছু ন্যূনতম সহায়ক মূল্য হওয়া উচিত ২,৩৫০ টাকা, অথচ কেন্দ্রীয় সরকার ঘোষণা করেছে ১,৮৬৫ টাকা! এদিকে রাজ্য সরকার ফসল কেনার কোনো পরিকাঠামো গড়ে না তুলে চাষিদের ঠেলে দিচ্ছে অভাবী বিক্রির পথে। ফলে চাষিরা বিপুল লোকসানে ব্যবসায়ীদের কাছে ফসল বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। তাই আওয়াজ উঠেছে যৎসামান্য দান খয়রাতি নয়, ফসলের প্রকৃত সংগ্রহ মূল্য গ্যারান্টি কর, কম দামে ভর্তুকি দিয়ে সার-বীজ-বিদ্যুৎ সরবরাহ কর। ধান কেনার জন্য টাকা বরাদ্দ কর, গ্রামে দুয়ারে দুয়ারে ধান কেনার ব্যবস্থা কর। দিল্লীর চলমান কৃষক আন্দোলনে এটা অন্যতম প্রধান দাবি। এরাজ্যেও সেই দাবি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।

সর্বোপরি গ্রামের কৃষি ও অন্যান্য মজুররা কোনোরকম সরকারি সহায়তা পাচ্ছেন না। এই লকডাউনের কর্মহীন পরিস্থিতিতে ১০০ দিনের কাজের প্রকল্প বন্ধ। সমস্ত জবকার্ডধারী গ্রামীণ মজুরদের ৫০ দিনের মজুরি নগদে দিতে হবে। জবকার্ডধারীরা বা গ্রামীণ শ্রমিকরা “৫০ দিন কাজ করেছেন” ধরে নিয়ে সেই মজুরি লকডাউন পরিস্থিতিতে আশু ত্রাণ হিসেবে দিতে হবে। এই মর্মে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর কাছে চিঠি পাঠাবে সারা ভারত কিষাণ মহাসভা।

- জয়তু দেশমুখ 

খণ্ড-28
সংখ্যা-24