জবাব চাই
an answer

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের তৈরি কমিটি পশ্চিবাংলার নির্বাচন পরবর্তী সন্ত্রাসের তথ্য সম্বলিত রিপোর্ট পেশ করেছে। তবে তার কোনও সত্যতা পুনর্নির্বাচিত মমতা সরকার মানতে রাজি নয়। শাসকদল তৃণমূলের অবস্থানও যথারীতি তথৈবচ। এনএইচআরসি-কে কমিটি গঠন করে তদন্ত করে রিপোর্ট দেওয়ার নির্দেশ দেয় কলকাতা হাইকোর্ট। এক-দুই সদস্যের নয়, পাঁচ সদস্যের ডিভিশন বেঞ্চ। রাজ্য সরকার বলেছিল তার কোনও প্রয়োজন নেই। কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। পুলিশ-প্রশাসন সব ম্যানেজ করে নেবে। কিন্তু সেই সওয়াল দাঁড়ায়নি। এখন বলছে, পেশ হওয়া রিপোর্ট রাজনৈতিক প্রতিহিংসা মূলক এবং উদ্দেশ্য প্রণোদিত। সমস্ত অভিযোগ প্রবলভাবে অস্বীকার করছে। রাজ্য সরকারের বলছে — তদন্ত কমিটি গঠন, তাদের সাঙ্গোপাঙ্গ, গন্তব্যস্থল, তথ্যপ্রমাণ দাখিল — কোনোকিছুই প্রকৃত নিরপেক্ষতার ভিত্তিতে হয়নি। আরও প্রশ্ন তুলেছে, গুজরাট-উত্তরপ্রদেশের মতো বিজেপি শাসিত রাজ্যে কোনও তদন্তের টিম পাঠানো হয় না কেন? উত্থাপিত প্রশ্নগুলোর মধ্যে যুক্তি আছে। সন্দেহাতীতভাবে সিবিআই, নিয়া, ইডি ইত্যাদি কেন্দ্রীয় বিশেষ বিশেষ গোয়েন্দা পুলিশের জাল ও জাতীয় স্তরের মানবাধিকার কমিশনের নিয়ন্ত্রণ থাকে কেন্দ্রের হাতে, আর কেন্দ্র ওইসব হাতিয়ার ব্যবহার করে নিজপক্ষের কায়েমী স্বার্থে। এবারও তার অন্যথা হয়নি। কমিশনের তৈরি তদন্ত কমিটির মাথা সহ অন্তত তিনজনের নানারূপে বিজেপি সংস্রবের ডিএনএ রয়েছে। সত্যিই, যে উত্তরপ্রদেশ-গুজরাট হিন্দুত্বের সাম্প্রদায়িক ফ্যসিবাদী আগ্রাসনে, বর্ণবাদী বা জাতপাতের হিংসায়, সংঘটিত হত্যা-গণহত্যায়, মুসলিম-দলিত-নারী-সাংবাদিক নিধন ও নিগ্রহে — সবকিছুতে সরকারের মদতে বা খোদ সরকারের সন্ত্রাসে কুখ্যাত হয়ে উঠেছে; সেখানে কোনও স্তরের কোনও কমিশনের তদন্ত হতে দেখা যায় না। এই অর্থে এরাজ্যে সন্ত্রাসের ক্ষত খতিয়ে দেখতে মোদী সরকারের পদক্ষেপ যে বিজেপির স্বার্থেই তা আর অস্পষ্ট নেই।

কিন্তু মোদীর কেন্দ্র এবং বিজেপির বদ মতলব আছে বলেই রাজ্য সরকার আর শাসকদল তৃণমূলের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ সব খারিজ হয়ে যায় না। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের তৈরি কমিটির পেশ করা রিপোর্টে অভিযোগের সংখ্যা চৌদ্দশতাধিক। কমিটির টিম চক্কর দিয়েছে ঝড়ের গতিতে। সঙ্গে কেবল বিজেপির সাংসদ-বিধায়ক-নেতা-পারিষদদের দল। যদি ধরেও নেওয়া হয়, তৈরি রিপোর্টে প্রচুর রঙজল মেশানো, তবু আশ্চর্যের বিষয়, রাজ্যের মানবাধিকার কমিশনে কোনও অভিযোগ পেশ হল না! থানায় সন্ত্রাসের কোনও এফআইআর জমা পড়ল না! এই মাত্রায় বৈসাদৃশ্য নিয়ে রাজ্যের শাসকেরা এতটুকু লজ্জ্বিত নয়, বিচলিত নয়, পরন্তু গলাবাজি করছেন!

রাজ্য সরকারের যখন ‘নিরীহ নির্দোষ’ নাম কেনার এতই ইচ্ছা, এতই দম্ভ, তাহলে রাজ্যের তরফে সন্দেহাতীত উদ্যোগ-সক্রিয়তা নেওয়া হচ্ছে না কেন? কেন রাজ্যের মানবাধিকার কমিশনকে মাঠে নামানো হচ্ছে না? নিদেনপক্ষে থানাকে বিশেষ নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে না কেন? কেন রাজ্যের স্বরাষ্ট্র সচিবের দপ্তর এপ্রশ্নে মূক ও বধির? সবার ওপরে যাঁর অধিষ্ঠান, মুখ্যমন্ত্রী, তিনি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সন্ত্রাসের অভিযোগ খতিয়ে দেখার পদক্ষেপ করবেন না কেন? নির্বাচনে জয়ের হ্যাটট্রিক আসলেই সন্ত্রাসের অভিযোগ স্বয়ংক্রিয় ভাবে নাকচ হয়ে যায় না। ‘পেগাসাস’ নিয়ে তো মুখ্যমন্ত্রী তুরন্ত্ তদন্ত কমিশন বসালেন। সন্ত্রাসের প্রশ্নে সেই সততা থাকছে না কেন? বিজেপি নিজেকে জাহির করার ফিকির খুঁজতে দাবি করছে সন্ত্রাসের শিকার হচ্ছে কেবল ‘তার কর্মী-সমর্থকরাই’। এই অপকৌশল ধর্তব্যের নয়। উপরন্তু হুমকি দিচ্ছে রাজনীতির বাজার তৈরি করতে। শোনা গেল বিজেপির দলনেতার ধমকি। জেলার পুলিশ সুপারের উদ্দেশ্যে। তাঁর বিরুদ্ধে পুলিশী তদন্ত বন্ধ না হলে কেন্দ্রীয় সরকারকে দিয়ে বদলি করে দেওয়া হবে জম্মু-কাশ্মীরে! বিজেপি বড় হয়ে ওঠার জমি পেতে শুরু করে ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচন থেকে। সেবার ব্যাপক ভোট পায় প্রধানত সিপিআই(এম) প্রভাবিত জনগণের অংশ থেকে। আর এবার ২০২১-এর লোকসভা নির্বাচনে ভোট বাড়ে তৃণমূল দলবদলুদের হাত ধরা কিছু অংশ থেকে। কিন্তু যারা সন্ত্রাসের শিকার হচ্ছেন তাদের মূল পরিচয় হল তারা জনগণ। তারা সন্ত্রাসের শিকার হচ্ছেন জনগণের বিভিন্ন অংশ হিসেবে। নিজস্ব বিচারের ভিত্তিতে ঠিক-ভুল যাইই হোক, তৃণমূলকে ভোট দেয়নি বলে। কিন্তু তা বলে তাদের ওপর তৃণমূলের সন্ত্রাস চালানোর এ্যক্তিয়ার জন্মে যায় না। গণতন্ত্রের অন্যতম মূল শর্ত হল বিরোধী ও সংখ্যালঘু মতের নিরাপত্তা ও সম্মান থাকতেই হবে। মমতা সরকার এই প্রশ্নে আদৌ গণতান্ত্রিক নিয়ম নিষ্ঠ নয়। তৃণমূল আমলের সবচেয়ে কলঙ্কের মুখ্য দুটি বিষয় হল, দুর্নীতি আর সন্ত্রাস। দু’দশকের এই প্রেক্ষাপটে তৃতীয় বার জিতে আসার পর বিরুদ্ধে চলে যাওয়া শক্তিগুলোর ওপর সন্ত্রাস চালানোর অভিযোগ খুবই সম্ভাব্য। তার জবাব দিতেই হবে তৃণমূলকে।

খণ্ড-28
সংখ্যা-28