চরবৃত্তি কেলেঙ্কারি ও রেইড-রাজ : সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মোদির যুদ্ধ
Modi’s War on Journalists

ইজরাইলি কোম্পানির কাছ থেকে কেনা পেগাসাস সফটঅয়্যার দিয়ে ভারতীয় নাগরিকদের ব্যক্তিগত জীবনে আড়ি পাতার কলঙ্কজনক ঘটনা প্রকাশিত হতে থাকায় মোদি সরকার যা প্রতিক্রিয়া দেখাল তা তাদের অপরাধি মনোভাবকেই খোলাসা করেছে। মন্ত্রীদের জবানে সরকার যা বলছে তা হল: “পেগাসাসকে আমরা আড়ি পাতার কাজে লাগিয়েছি এমনটা আপনারা কখনই প্রমাণ করতে পারবেন না। কিন্তু আড়ি পাতার কাজ যেটুকু করা হয়েছে তা আইনিভাবেই করা হয়েছে। অনেক দেশই পেগাসাস ব্যবহার করে। তাহলে শুধু ভারতকে কেন্দ্র করেই এত কথা কেন? পেগাসাস প্রজেক্ট তদন্ত আসলে বিজেপিকে ও ভারতের সরকারকে বদনাম করার ষড়যন্ত্র। যাই হোক না কেন, মাওইস্টদের ওপর আড়ি পাতার জন্য আমরা কোন সফটওয়্যার ব্যবহার করছি না করছি তা বলব কেন?” এইসব গা-বাঁচানো কথাবার্তায় একটা জিনিস খুব স্পষ্টরূপে নজরে আসে। তা হল, সরকার পরিস্কার করে বলতে পারছে না যে তারা পেগাসাস কেনেনি বা ব্যবহার করেনি। যদি তারা পেগাসাস কিনে থাকে আর তা আইনি পথেই ব্যবহার করে থাকে তাহলে তা স্পষ্ট করে বলতে কোথায় আটকাচ্ছে?

পেগাসাস সফটওয়্যার দিয়ে যাদের ওপর ভারতে আড়ি পাতা হয়েছে সেই তালিকায় আছেন ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং প্রতিরক্ষা ও ইন্টেলিজেন্স প্রতিষ্ঠানে উচ্চপদে আসীন ব্যক্তিরা। আছেন সুপ্রিম কোর্টের এক বর্তমান বিচারক, বিরোধী দল নেতারা, সিবিআই-এর উচ্চ পদাধিকারীরা, বিপুল সংখ্যক সাংবাদিক। আছেন ৬০ জন মহিলা যার মধ্যে এমন একজন আছেন যিনি যৌন হেনস্থার অভিযোগকারি, আবার এমন অনেকে আছেন যারা কোনও জনপ্রতিনিধি বা পাব্লিক ফিগার নন। ফোন প্রতি দেড় (১.৫) কোটি টাকা খরচ করে এরকম নির্বিচার আড়ি পাতার সিদ্ধান্তটা কোথায় বসে নেওয়া হয়েছিল? কাকে কী কারণে পেগাসাসের নিশানা বানানো হবে তা কে কোথায় বসে ঠিক করছিল? এবং, এইসব সিদ্ধান্ত কি কখনও কোনও সাংবিধানিক কর্ত্তৃপক্ষ দ্বারা অনুমোদিত হয়েছিল? ইজরায়েল রাষ্ট্রের সাথে ঘনিষ্ঠ বন্ধনে আবদ্ধ একটি ইজরায়েলি সংস্থাকে ভারতের নাগরিকদের, এমনকি সেনাবাহিনী, ইন্টেলিজেন্স, রাজনীতি, সরকার ও বিচার বিভাগের মতো ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বে থাকা নাগরিকদেরও ব্যক্তিগত তথ্য এভাবে দিয়ে দেওয়া হল কেন? ভারতের সংসদে এবং জনতার সামনে এইসব প্রশ্নের জবাব দিতে সরকারের এত অনীহা কেন?

কেবিনেট মিনিস্টার মীনাক্ষি লেখি গর্জে উঠে বললেন যে “মাওইস্ট”-দের ওপর নজর রাখতে সরকার কোন সফটওয়্যার ব্যবহার করল না করল তা কাউকে জানাতে বাধ্য নয় সরকার। ভারত সরকার সাংবাদিকদের, বিরোধী নেতাদের, বিচারকদের, যৌন নির্যাতনের অভিযোগিকারীকে, মানবাধিকার রক্ষা কর্মিদের বা সরকারের নিজের মন্ত্রীদের ও আর্মি অফিসারদের কিসের ভিত্তিতে “মাওইস্ট” তকমা দিচ্ছে? স্পষ্টতই শাসক দল যাকে প্রতিপক্ষ মনে করছে তাদের তকমা দিতে “মাওইস্ট” শব্দটা সরকারি কোড হয়ে গেছে। এই স্পাইং আসলে ডাইনি-শিকার। তথ্য হল ক্ষমতা: সুতরাং এইসব নাগরিকদের ব্যক্তিগত জীবনে আড়ি পাতাটা আসলে সাংবাদিক, বিচার বিভাগ, সশস্ত্র বাহিনী, বিরোধী রাজনৈতিক নেতা ও আন্দোলনকর্মিদের ওপর শাসক দলের ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণ কায়েম করার হাতিয়ার। যে দেশে সাংবাদিক, বিচার বিভাগ, সশস্ত্র সেনা, বিরোধী পক্ষ তথা মানবাধিকার রক্ষককে সর্বদা শাসক দলের রক্তচক্ষুর আতঙ্কে থাকতে হয় সে দেশ গণতান্ত্রিক দেশ হতে পারে না।

সরকারি নীতি নির্ধারণ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনকে প্রশ্নবিদ্ধ করা সাংবাদিকরা মোদি সরকারের দ্বারা “এন্টি ন্যাশনাল” তকমা পাচ্ছে আর বে-আইনি চরবৃত্তির শিকার হচ্ছে। পেগাসাস চরবৃত্তি নিয়ে প্রশ্ন তোলাকে মোদি সরকার “এন্টি ন্যাশনাল” বলে চিহ্নিত করছে। একইভাবে যেসব সাংবাদিক ও মিডিয়া হাউস কোভিড-মৃত্যুর খবর প্রকাশ করে মোদি সরকারের আড়াল করা সত্যকে সামনে এনেছে তাদের হুমকি দিয়ে লাইনে আনতে ইনকাম ট্যাক্স রেইডের শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। যে গুটিকয় মিডিয়া হাউস কোভিড-১৯ এর দ্বিতীয় ধাক্কার খবরাখবর তথা মৃত্যুর সঠিক সংখ্যা আন্তরিকভবে তুলে এনেছে তার মধ্যে ‘দৈনিক ভাস্কর’ খবরের কাগজ ও ‘ভারত সমাচার’ টিভি চ্যানেল অন্যতম।

প্রকৃত পক্ষে দৈনিক ভাস্করের সর্বভারতীয় সম্পাদক নিউ ইয়র্ক টাইমসে একটি উত্তর-সম্পাদকীয় লিখেছেন, “গঙ্গা মৃতদেহগুলি ফিরিয়ে দিচ্ছে : গঙ্গা মিথ্যা বলে না” শিরোনামে। এই লেখায় তিনি চাঁছাছোলা ভাষায় “মোদি সরকারের নির্বোধ অবজ্ঞা”-কে সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ আসার মূল ইন্ধন হিসেবে বর্ণনা করেছেন। কুম্ভ মেলা ও তারপর “গোটা রাজ্যে ইন্টেন্সিভ কেয়ার ইউনিটগুলিতে অক্সিজেন, ভেন্টিলেটর ও বেড এবং শব দাহ ও দাফনের জায়গার চরম অভাব প্রকট হওয়া” সত্বেও উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর “অস্বীকার ও হুমকি”-কে তুলে ধরেছেন তিনি। এবং তিনি তাঁর পত্রিকার তদন্তমূলক সংবাদদাতাদের সম্পর্কে লিখেছেন যারা গঙ্গায় ২০০০ শব ভেসে যেতে দেখেছেন, গঙ্গার তীরে ৭০টি শব জলে ধুয়ে যেতে দেখেছেন এবং ৪০০০ মরদেহ গঙ্গার তীরে সামান্য মাটিচাপা দিয়ে কবর দিতে দেখেছেন। সাংবাদিকদের যা প্রকৃত কর্তব্য দৈনিক ভাস্কর সেটা করেছে বলেই মোদিরাজের আক্রমণের শিকার হয়েছে।

ভারতের জনসাধারণের অধিকার আছে সত্যটা জানার : কোভিড মৃত্যু সম্পর্কে আর পেগাসাস চরবৃত্তি সম্পর্কে। প্রতিটি কোভিড মৃত্যুর হিসাব থাকতে হবে, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলিকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। পেগাসাস চরবৃত্তি কেলেঙ্কারির তদন্তের জন্য সুপ্রিম কোর্টের অবসর প্রাপ্ত বিচারক মদন লোকুর ও কলকাতা হাইকোর্টের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকার যে প্যানেল গঠন করেছে তাকে আমরা স্বাগত জানাই। অগ্রণী সাংবাদিকেরাও তদন্ত চেয়ে সুপ্রিম কোর্টে গেছেন। পেগাসাস চরবৃত্তির তদন্ত করার ব্যাপারে মোদি সরকার যতই অনীহা দেখাক বা নিজের অপরাধী মনোভাব প্রকাশ করুক না কেন, একটি নিরপেক্ষ ও পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত হওয়া নিতান্ত জরুরি। এবং বিদেশি একটি সংস্থার সাথে হাত মিলিয়ে এভাবে আমাদের সংবেদনশীল ও ব্যক্তিগত তথ্য হ্যাক করার প্রতিটি কুকম্মের সমুচিত শাস্তি হওয়া দরকার।

(এম এল আপডেট সম্পাদকীয় ২৭ জুলাই ২০২১)

খণ্ড-28
সংখ্যা-28