সময়ের শিক্ষা সময়ে নিতে হয়
Time education is to take time

আজ পর্যন্ত ভারতবর্ষে যতগুলো নির্বাচন হয়েছে, তারমধ্যে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ কোনো নির্বাচন যদি হয়ে থাকে তা হল ২০২১’র পশ্চিমবাংলার নির্বাচন, যেখানে বাংলা দখল করার জন্য বিজেপি ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। এবারের নির্বাচনটা পশ্চিমবাংলায় কেবল রাজ্য প্রেক্ষিতে ছিল না, এই নির্বাচন ছিল গোটা দেশের পরিপ্রেক্ষিতে, গোটা দেশের লড়াই হয়ে গেছিল। এবং এই কারণেই হয়েছিল, ২০১৪ সালে বিজেপি যখন ক্ষমতায় এলো অমিত শাহ একটা কথা বলেছিলেন, ‘যে আমরা ৫০ বছর রাজত্ব করব’। সুতরাং ওদের উদ্দেশ্য ছিল নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে কোনোভাবে ক্ষমতাটা দখল করে নাও। যদি মেজরিটি পাওয়া গেল তাহলে ক্ষমতা তো চলেই এলো, আর যদি তা নাও পাওয়া যায় তবু শক্তি তো বাড়ানো যাবে, উত্তর-পূর্ব ভারতে এমন রাজ্যও আছে যেখানে বিজেপির কাছে রয়েছে দু’টো আসন কিন্তু সরকারটা বিজেপির হাতে। তাই যে কোনো মূল্যে গোটা দেশে সংসদের ক্ষমতা থেকে শুরু করে পঞ্চায়েতের ক্ষমতা, সমস্ত ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে হবে। এইজন্য কুক্ষিগত করতে হবে, যাতে সেই ক্ষমতায় বসে যেটা প্রায় ১০০ বছর ধরে আরএসএস স্বপ্ন দেখেছে ভারতবর্ষের চরিত্রটাকে বদলে দেওয়া, এই দেশটাকে হিটলারের-মুসোলিনির আদর্শে হিটলারি কায়দায় একটা সমাজ, একটা দেশ, একটা রাষ্ট্র এখানে গড়তে হবে। এই যে ওদের একটা স্বপ্ন, ১০০ বছরের পুরনো স্বপ্ন, যেটা আসলে একটা চক্রান্ত, সেই চক্রান্তকে বাস্তবায়িত করার জন্য ওদের ক্ষমতা দখলের লক্ষ্য। সেইজন্য বাংলাটা এত গুরুত্বপূর্ণ। ওরা এখনো পর্যন্ত যে ক্ষমতা দখল করেছে তা মূলত হিন্দী বলয়ে। সেখানেও কিন্তু ওরা দেখতে পারছে সেই সমস্ত জায়গায় ধীরে ধীরে মানুষ ওদের ‘জুমলা’, ওদের স্বৈরতান্ত্রিকতা টের পাচ্ছে।

সিপিআই(এম) এবারের নির্বাচনে একটা অদ্ভুত বিষয় যোগ করল, “বিজেপিকে হারাতে গেলে আগে তৃণমূলকে হারাতে হবে”! এই এ্যাজেন্ডাটা সিপিআই(এম) তার কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে বেঁধে দিয়েছিল এবং তা জনগণের মধ্যে নিয়ে যাওয়ার সবটুকু চেষ্টা করেছিল। আর তৃণমূলের বাইরে যে সমস্ত বামপন্থী, লিবারাল মানুষ বিজেপিকে প্রধান শত্রু বলে চিহ্নিত করেছিলেন বা ‘নো-ভোট-টু-বিজেপি’র’ প্রচার করেছিলেন তাদের সাথেই সিপিআই(এম) নিজেদের দূরত্ব বাড়িয়েছে। যার পরিণামে পশ্চিমবঙ্গে এবারের নির্বাচনে বিজেপির মতো একটা সাম্প্রদায়িক, ফ্যাসিষ্ট দলের বিরুদ্ধে বামপন্থী শিবির একজোট হতে পারল না। বিজেপির সাথে অন্য কোনো পার্টির তুলনা হয়না। এটা একটা সম্পূর্ণ অন্য পার্টি, অন্য আদর্শ। একটা অন্য চক্রান্ত, যেটা হচ্ছে ভারতবর্ষকে, সংবিধানকে, গণতন্ত্রকে ধংস করে দেওয়ার জন্য, আর গোটা দেশে ‘কোম্পানিরাজ’ অর্থাৎ আদানি-আম্বানিদের রাজত্ব করে দেওয়ার জন্য। তৃণমূলের দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের অবশ্যই বিরোধিতা করার দরকার রয়েছে। ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূলের সন্ত্রাস অবশ্যই বিজেপিকে এরাজ্যে বাড়তি জায়গা করে দিয়েছে, কিন্তু ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির ১৮টি আসন ও ৪০ শতাংশ ভোটের বিপরীতে তৃণমূলের দখলে থাকা ২২টি আসন ও ৪৩ শতাংশ ভোটকে বিজেপির সাথে একাকার করে দিয়ে ‘বিজেমূল’ আখ্যা দেওয়াটা চরম নেতিবাচক পদক্ষেপ। বিজেপির ক্ষমতা কেন্দ্রীকরণের বিপরীতে একটি বিরোধী দল পরিচালিত সরকার ও রাজনীতিকে বিজেপির সাথে মিলিয়ে দেখাটা কোনো বাস্তববাদী বিশ্লেষণ হতে পারেনা। ষড়যন্ত্রমূলক তত্ত্ব বা কনস্পিরেসি থিওরী দিয়ে বাস্তব অবস্থাকে অস্বীকার করে বামপন্থী রাজনীতি এগোতে পারে না।

একদিকে এই প্রথম পশ্চিমবাংলার বিধানসভায় একজনও বাম প্রতিনিধি না থাকাটা যতটা দুর্ভাগ্যজনক, ঠিক ততটাই বিপজ্জনক একটা বড় সংখ্যক ফ্যাসিস্ট-সাম্প্রদায়িক শক্তির প্রতিনিধি থাকাটা। আর নির্বাচন মিটে যাওয়ার মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই তার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। ৩৫৬ ধারা প্রয়োগ করে রাজ্যে একটা নির্বাচিত সরকারকে ফেলে দেওয়ার চক্রান্ত, ঘুষ বা আমলাকান্ডের ছুতোয় যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে আঘাত হানার মতো অপচেষ্টা ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। আর এসমস্ত ঘটনায় যারা ‘গায়ের জ্বালা মেটানোর’ আত্মতুষ্টিতে ভুগছেন তাদের জানা উচিত যে, বিজেপির মূল শত্রু রাজনৈতিকভাবে কমিউনিস্টরা ও ধর্মীয়ভাবে মুসলিমরা। এছাড়াও আছেন দলিতরা যারা ব্রাহ্মণ্যবাদী সামন্ততান্ত্রিক সমাজের রক্ষকদের অন্যতম শত্রু।

একবার রুখে দেওয়া গেলেও তৃণমূলের মতো আদ্যন্ত একটি ক্ষমতাকেন্দ্রীক দল যে আগামীদিনে বিজেপির বিপদকে মোকাবিলা করতে পারবে এবিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায় না। কোনো সন্দেহ নেই যে, ওদের কাছে রাজনীতিটা ‘করে-কম্মে খাওয়ার’ বা ‘আখের গোছানোর জায়গা’ এবং তা আর একবার পরিস্কার হয়ে গেছে নির্বাচনের আগে বা পরে দলবদলের হিড়িক দেখে। সিপিআই(এম)ও ভেবেছিল তৃণমূলের ভোট লুঠ, দুর্নীতি, সর্বক্ষেত্রে নৈরাজ্য, গণতন্ত্রহীনতা ইত্যাদি বিষয়গুলিই নির্বাচনের প্রধান বিষয় হয়ে উঠবে। লকডাউনে পরিযায়ী শ্রমিকদের দুর্দশা, সারা দেশে গড়ে ওঠা কৃষিআইন-বিরোধী একটানা ঐতিহাসিক আন্দোলন, উত্তরপ্রদেশ-ত্রিপুরা-আসামে রামরাজ্যের নমুনা, রান্নার গ্যাস-পেট্রোল-ডিজেল সহ অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের লাগামছাড়া মূল্যবৃদ্ধি, শ্রমিকদের নূন্যতম অধিকারগুলো কেড়ে নিতে নতুন শ্রমকোড, সেন্ট্রাল ভিস্তা প্রজেক্টের নামে নির্লজ্জ ধৃষ্টতা, নতুন শিক্ষানীতির নামে শিক্ষাকে সম্পূর্ণরূপে পণ্যে পরিণত করার দাম্ভিকতা, সমস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে কব্জা করে ফেলা, সর্বোপরি সিএএ-এনআরসি’র নামে দেশের নাগরিককে বেনাগরিক বানানোর ষড়যন্ত্রর মতো বিষয়গুলো তথা বিজেপিই যে সাধারণ মানুষের কাছে প্রধান বিপদ বলে চিহ্নিত হবে সেটা একবারের জন্যও সিপিআই(এম) ভাবতে পারেনি তা তাদের নির্বাচন পরবর্তী বিবৃতি থেকেই পরিষ্কার।

তৃণমূলের বাইরে যে বা যারা বিজেপির বিরুদ্ধে কথা বলেছে তাদেরই ‘চাল চোর’, ‘চটিচাটা’ ইত্যাদি বলে দেগে দেওয়া হয়েছে। অতীতে কোনো বামপন্থী দলকে জনগণের প্রতি এই ধরনের বাক্য বা শব্দবন্ধ ব্যবহার করতে দেখা যায়নি। সিপিআই(এম)-এর তথাকথিত সমর্থকরা এবার যেটা করে দেখালেন, তা বিজেপির মতো ভয়ঙ্কর একটা দলের আইটি সেলের বিদ্বেষ-বিভাজন-কুৎসিত আক্রমণের ধারার পাশাপাশি আরেক ধরনের কুৎসার পরিবেশ তৈরি করে। দীর্ঘকালের কর্তৃত্ববাদী মতাদর্শ ও ক্ষমতার রাজনীতি সমাজে একশ্রেণীর সুবিধাভোগী তৈরি করে, এগুলো তারই ফসল। আর এই কারণেই ভারতবর্ষ‌ জুড়ে কর্পোরেট সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন ও সংগ্রামের বর্শামুখ নির্দিষ্ট করার আহ্বান জানালে তা ওদের কাছে দালালি বা গোপন বোঝাপড়া বলে মূল্যায়ন হয়। জনগণকে এই বিপজ্জনক রাজনীতি সম্পর্কে জরুরি ভিত্তিতে সতর্ক করাটা আশু কর্তব্য, আর এর দায়ভার বামপন্থীদেরই। ওদের বোধহয় জানাই নেই, জার্মান সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটরা এই কাজটা ভালো করে উঠতে পারেনি বলেই হিটলারের উত্থান দেখতে হয়েছিল। বাংলার বামপন্থীদের অবশ্যই আশা রাখতে হবে, ইতিবাচক-নেতিবাচক শিক্ষা নিয়ে সংগ্রামের পথে সংগঠিত হতে হবে।

- শ্রীকান্ত লাহা

খণ্ড-28
সংখ্যা-24