বিশে জুলাই, প্রবীর দত্ত - পথেই হবে এ পথ চেনা
July 20, Prabir Dutt

বিগত শতকের সত্তরের দশকে রক্ত, কান্না, মৃত্যু, শপথ, লড়াই এবং লড়াইয়ের এক মহাকাব্য রচিত হয়েছিল। রাষ্টশক্তির লাগামহীন শ্বেতসন্ত্রাস সমসময়ে অবলীলায় দিনকে রাত্রিতে রূপান্তরিত করতো। বাকরুদ্ধ গণতন্ত্রের কান্না, দলিত মানবাত্মার আর্ত চিৎকার আর রাষ্ট্রশক্তির খুনি-গেস্টাপো বাহিনীর লাল চোখের স্পর্ধার দিকে প্রতিস্পর্ধায় চোখ রেখে স্বপ্নপাগল, মুক্তিপাগল তরুণদের রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড গড়ে অসম দুঃসাহসী লড়াইয়ের রক্তাক্ত ইতিহাসের নামই সত্তর দশক। প্রচুর সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও নকশালপন্থী আন্দোলন নতুন করে ইতিহাসকে পড়তে, চিনতে, জানতে এবং বুঝতে শিখিয়েছিল; পুরানোর মোহ ভেঙে জীবনকে নতুনভাবে দেখতে, বুঝতে শিখিয়েছিল; নতুন শব্দ এবং বর্ণের সন্ধান দিয়েছিল, নতুন দিশা, নতুন স্বপ্নের আকাশ দেখিয়েছিল। সত্তর দশকের মাটিতে পা-রাখা দৃপ্ত তারুণ্যের দীপ্তিময়তা আরও একবার প্রমেথিয়ুস হতে চেয়েছিল। মুক্তির স্বপ্নতাড়িত তারুণ্যের এই নবজন্ম এবং তার উত্তাল উচ্ছ্বাসকে স্বভাবতই রাষ্ট্রশক্তি মেনে নিতে পারেনি। সারাদেশ হয়ে উঠেছিল জেলখানা, জেলখানা হয়ে উঠেছিল বধ্যভূমি। রক্তস্রোতে রঞ্জিত হয়েছিল সারাদেশ, তার ছড়ানো মানচিত্র।

এই সত্তরের দশকের প্রত্যূষ-পোষিত এক সকালে প্রথিতযশা কবি-বুদ্ধিজীবী এবং সর্বোপরি বিপ্লবী কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম শীর্ষ নেতা সরোজ দত্তকে কংগ্রেসি জমানার পুলিশ প্রকাশ্যে হত্যা করেছিল। ১৯৭১ সালের ৫ অগাস্ট কলকাতা ময়দানে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের পুলিশ এই অপকর্মটি করেছিল অত্যন্ত শান্তমাথায় এবং পরিকল্পিতভাবে। তবে এই অপকর্মের কথা পুলিশ স্বীকার করেনি। পুলিশের খাতায় সরোজ দত্ত আজও নিখোঁজ! এই ঘটনার মাত্র এক বছরের মাথায় নকশালবাড়ি আন্দোলনের রূপকার চারু মজুমদারকে জেলের মধ্যে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করে পুলিশ। ১৯৭২’র ২৮ জুলাই চারু মজুমদারকে খুন করার বিষয়টিও ছিল পূর্বপরিকল্পিত। এইসব পূর্বপরিকল্পিত খুন ও সমসময়ের হাজার হাজার গণহত্যার নায়করা কেউই শাস্তি পায়নি। বরং সাতাত্তর-উত্তর ‘বাম’ জমানায় তাদের পদোন্নতি ঘটেছিল, তাঁদের সামাজিক জীবনে নিরাপত্তার শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছিল।

চারু মজুমদার-হত্যার ঘটনার ঠিক এক বছর একান্ন সপ্তাহের মাথায় সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের পুলিশ শত শত মানুষের বিস্ময়াহত চোখের সামনে প্রকাশ্য দিবালোকে কলকাতার কার্জন পার্কের কাছে হিংস্রতার সার্বিক প্রকাশ ঘটিয়ে হত্যা করেছিল নাট্যকর্মী এবং কবি প্রবীর দত্তকে। সেদিনটি ছিল শনিবার, ১৯৭৪’র ২০ জুলাই। এবারের এই দিনটি প্রবীর-নিধনের ৪৭তম উৎক্রান্তি দিবস।

১৯৭৩’র ৭ মার্চ দিল্লীর মিরান্দা হাউসে এক বক্তৃতায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী শিহরণ-জাগানো একটি উক্তি করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন: “আমি বিপ্লবী ছিলাম এবং এখনও বিপ্লবী আছি!” তাঁর বিপ্লবীয়ানার ফলিত রূপ তখনতো সমস্ত ভারতবাসী প্রত্যক্ষ করেছিলেন। একদিকে তিনি নিজের বিপ্লবীয়ানা যেমন জাহির করছিলেন, তেমনই অন্যদিকে আন্দোলনকে ‘বিলাসিতা’ হিসেবে আখ্যাত করেছিলেন! পশ্চিমবঙ্গে ইন্দিরার অনুগামী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের পুলিশও আন্দোলনের নামে ‘বিলাসিতা’র টুঁটি চেপে ধরতে বিন্দুমাত্র বিলম্ব করেনি। ভিয়েতনামের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াইয়ের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়ে ১৯৭৪’র ২০ জুলাই সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী দিবসে, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতায় ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদের আহ্বানকে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের পুলিশ ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখতে পারেনি। আন্দোলনের নামে এই ‘বিলাসিতা’কে কোনও মতেই প্রশ্রয় দেওয়া যায়না। নাট্যকর্মী এবং এই অনুষ্ঠানের অন্যতম উদ্যোক্তা দেবর্ষি চক্রবর্তী সংস্কৃতি কর্মীদের মিছিলে যখনই প্রচারপত্র বিলি করতে শুরু করেন, তখনই পুলিশ তাঁকে ধরে টানতে টানতে অপেক্ষমান ভ্যানে নিয়ে তোলে। এদিনের মিছিলের গতিপথ ছিল কার্জন পার্ক থেকে ধর্মতলা, সুবোধ মল্লিক স্কোয়ার, কলেজ স্ট্রিট, মহাত্মা গান্ধী রোড হয়ে শিয়ালদা। দেবর্ষি চক্রবর্তীকে এভাবে জোর করে পুলিশ ভ্যানে তোলার প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে ওঠে মিছিল। মিছিলের গতিমুখ পুলিশের ভ্যানের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। অকারণে এবং অন্যায়ভাবে দেবর্ষি চক্রবর্তীকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদ জানিয়ে তাঁর মুক্তির দাবিতে শ্লোগানে শ্লোগানে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত হতে থাকে। এসময় আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে পুলিশ। একজন পুলিশ অফিসার হঠাৎই দু’জন সাংস্কৃতিক কর্মীর জামার কলার চেপে ধরায় প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক কর্মীরা উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। আর তখনই শুরু হয়ে পুলিশের অপারেশান। প্রচুর পুলিশ অন্যান্য ভ্যান থেকে নেমে এসে নির্বিচারে লাঠি চালাতে শুরু করে। এই আকস্মিক আক্রমণে হতচকিত হয়ে সাংস্কৃতিক কর্মীরা যে যেদিকে পারে ছুটতে শুরু করেন। সেদিন এই সাংস্কৃতিক কর্মী-লেখক-কবি-বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন স্বয়ং কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, প্রবীণ গণশিল্পী পরেশ ধর, প্রয়াত সিপিআই(এমএল) নেতা সুশীতল রায়চৌধুরীর জীবনসঙ্গী অমিয়া রায়চৌধুরি, ডাক্তার অমিয় বসু, ঝর্ণা (বসু?), শান্তনু ভট্টাচার্য, শুভঙ্কর মুখোপাধ্যায়, সাগর চক্রবর্তী প্রমুখ। পুলিশের তাড়া খেয়ে এঁদের সঙ্গেই ছুটছিলেন প্রবীর দত্তও।

কিন্তু প্রবীর বেশিদূর যেতে পারেননি। তাঁর পিঠে পুলিশের লাঠির সজোর আঘাত লাগায় তিনি মুখ থুবড়ে পড়ে যান। খুনের নেশায় পুলিশের চোখ তখন জ্বলে ওঠে। তাঁকে চিৎ করে ফেলে তাঁর পেটের ওপর দু’জন পুলিশ সবুট লাথি মারতে থাকে। যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকেন প্রবীর। অস্ফূট গোঙানির শব্দ বেরিয়ে আসে তাঁর মুখ থেকে। এই ঘটনা দেখে কিছু লোকজন প্রবীরকে উদ্ধার করার জন্যে এগিয়ে আসতেই পরিস্থিতি বেগতিক বুঝে পুলিশ অকুস্থল থেকে সরে যায়। কলকাতা মেডিকেল কলেজে প্রবীরকে আনতেই তাঁকে ‘ব্রড ডেড’ বলে ঘোষণা করেন ডাক্তার।

কোনরকম প্ররোচনা ব্যতিরেকেই প্রকাশ্য দিবালোকে শত শত মানুষের চোখের সামনে এভাবেই ঠাণ্ডা মাথায় প্রবীর দত্তকে হত্যা করেও পুলিশ কিন্তু এই হত্যার দায় স্বীকার করেনি। পুলিশ নাকি সেদিন আদৌ লাঠি চালায়নি! অথচ কলকাতার লিগ্যাল এইড কমিটির কর্মী দীপা চক্রবর্তীর বাড়িতে গিয়ে সেদিন রাত্রে পুলিশ তাঁকে শাসিয়ে এসেছিল, কারণ দীপা গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলের দু’জন কর্মীকে সঙ্গে নিয়ে অকুস্থল থেকে একটি ট্যাক্সিতে প্রবীরকে মেডিকেল কলেজে নিয়ে গিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলের সেই কর্মীদের খোঁজে রাতদুপুরে গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলেও হানা দিয়েছিল পুলিশ।

চারু মজুমদারের মৃতদেহের ময়নাতদন্ত যে ডাক্তারকে দিয়ে পুলিশ করিয়েছিল, সেই ডাক্তারকে দিয়েই মেডিকেল কলেজ থেকে জোর করে নিহত প্রবীর দত্তের মৃতদেহ তুলে লালবাজারে নিয়ে গিয়ে ময়নাতদন্ত করা হয়েছিল! এই ময়নাতন্তের সময় প্রবীরের মাকে থাকতে দেওয়া হয়নি! অথচ পুলিশ বলেছিল যে তারা আদৌ লাঠি চালায়নি! প্রবীরের মৃত্যুর ব্যাপারে তারা কিছুই জানে না!

১৯৭৪’র ২০ জুলাই সংস্কৃতি কর্মীদের ওপর এই নির্মম পীড়ন এবং প্রবীর দত্তকে ঠাণ্ডা মাথায় প্রকাশ্যে হত্যা করার কথা অস্বীকার করলেও সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের পুলিশ অবশ্য দাবি করেছিল যে সংস্কৃতি কর্মীদের এই মিছিলটি আসলে ছিল নকশালপন্থীদের। আর নকশালপন্থীদের ওপর হামলা করার অধিকার তো পুলিশের আছেই! পুলিশের এই বক্তব্যের নিহিতার্থে যা প্রতিষ্ঠা পায় তা হলো: এই মিছিলে অংশগ্রহণকারী নাট্যকর্মী, কবি, সঙ্গীতকার, লেখক, বুদ্ধিজীবী সহ সকলেই ছিলেন নকশালপন্থী! আর সেইসঙ্গে শহিদ প্রবীর দত্তও ছিলেন নকশালপন্থী! সুতরাং এই ‘নকশালপন্থী’ প্রবীর দত্তকে পুলিশ জেনেশুনেই হত্যা করেছে। কোনও ব্যক্তিকে ‘নকশালপন্থী’ আখ্যা দিয়ে হত্যা করাটা সেসময় আইনানুগ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

সেদিন সংস্কৃতি কর্মীদের ওপর হামলা আর প্রবীর দত্তকে নৃশংসভাবে হত্যা করার মধ্যে যে ফ্যাসিস্ত লক্ষণিকতা সুপ্রকট হয়ে উঠেছিল, তা অনতি-পরবর্তীতে আরও ভয়ঙ্কররূপে আত্মপ্রকাশ করেছিল পঁচাত্তরের জরুরি অবস্থা জারির পর। প্রবীর দত্ত হত্যার প্রতিবাদে পশ্চিমবাংলার লেখক-কবি-শিল্পী-বুদ্ধিজীবী তথা সংস্কৃতিকর্মীরা সোচ্চার হতে থাকেন। একইসঙ্গে নকশাল দমনে পুলিশি সক্রিয়তা বৃদ্ধি পেতে থাকে। শেষপর্যন্ত প্রবীর দত্ত হত্যার একান্ন সপ্তাহের মাথায় সারা দেশে জারি করা হয় কুখ্যাত জরুরি অবস্থা। আর তারই সঙ্গে প্রতিবাদী আন্দোলন নামক ‘বিলাসিতা’কে স্তব্ধ করে দেওয়ার জন্যে ফ্যাসিস্ত আক্রমণ তার দাঁত-নখ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।

তবে প্রবীর দত্ত শহিদ হওয়ার ঠিক দু’সপ্তাহ পরে কার্জন পার্কেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল নাটক ‘মিছিল’। সেই নাটকে কেয়া চক্রবর্তী অভিনয় করেছিলেন। উৎপল দত্ত আবৃত্তি করেছিলেন শহিদ প্রবীর দত্তের কবিতা। নাটক শেষ হওয়ার পর হয়েছিল মিছিল। সেই মিছিলে ছিলেন বিভাস চক্রবর্তী, মোহিত চট্টোপাধ্যায়, অশোক মুখোপাধ্যায় প্রমুখ। সে দিনের ওই কর্মসূচিতে মৃণাল সেনের পাশাপাশি ছিলেন কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও। তবে প্রবীর-নিধনের আনুষঙ্গিক জরুরি কর্ম হিসেবে পুলিশ ১৬ জনকে গ্রেপ্তার করেছিল বলে জানা যায়। এদের মধ্যে তিনজন ছিলেন সিপিএম সমর্থক। এই ঘটনার দিনকয়েক পরে কলকাতায় ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলে এক কনভেনশনে কিছু স্বনামধন্য ‘বামপন্থী’ বুদ্ধিজীবী এই তিনজন সিপিএম সমর্থকের মুক্তির দাবি তুলেছিলেন!

প্রবীর দত্তের শহিদত্বের সাতচল্লিশ বছর অতিক্রান্তির পর্যায়ে আজ আমরা কোন পরিস্থিতির মুখোমুখি? আজ ইন্দিরা গান্ধী নেই। দিল্লীর ক্ষমতায় কংগ্রেস নেই। এমনকি পশ্চিমবাংলায়ও কংগ্রেস বা সিপিএম-নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট ক্ষমতার অলিন্দে নেই। কিন্তু দেশজুড়ে আছে সংঘ পারিবারিক ফ্যাসিবাদের উদগ্র আক্রমণ। দিল্লী সহ দেশের বেশ কয়েকটি রাজ্যের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে আরএসএস-এর হিন্দুত্ববাদী ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের অনুশীলনে পুরোমাত্রায় নেমে পড়েছে বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকার। পঁচাত্তরের জরুরি অবস্থার তীব্র সমালোচনা করে বিজেপি সরকার তাদের লাগামহীন ফ্যাসিস্ত আক্রমণকে বৈধতা দিতে চায়। লাগামছাড়া মিথ্যাকথা, অবাস্তবকে বাস্তব বলে প্রদর্শন, ক্রিশ্চান, দলিত এবং আদিবাসী সহ মুসলিম জনসাধারণকে এই দেশ থেকে উৎখাত করার লক্ষ্যে উগ্রজাতিয়তাবাদের অতিপ্রসারণের মধ্যে দিয়ে তারা দেশের জনসাধারণের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টির এক কপট এবং ক্রূর রাজনীতির অনুশীলন করে চলেছে। দেশের প্রচলিত জনস্বার্থবিরোধী আইনগুলিকে ব্যবহার করে তারা একদিকে যেমন দেশের জনসাধারণের স্বাভাবিক প্রতিবাদের কণ্ঠস্বরকে স্তব্ধ করে চলেছে, ইউএপিএ’র মতো ঔপনিবেশিক আইনের প্রয়োগে যাকে-তাকে বিনাবিচারে কারারুদ্ধ করে চলেছে, তেমনই সামাজিক ন্যায় থেকে ক্রমাগত বঞ্চিত করে চলেছে দেশের আপামর জনসাধারণকে। শ্রম এবং কৃষি আইনের নামে তারা দেশের শ্রমিক এবং কৃষকদের ওপর অন্যায়ের জুলুম জারি করে চলেছে, তেমনই এই কুখ্যাত কৃষি আইনের প্রতিবাদে রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে রাস্তায় নেমে আন্দোলন জারি রাখা কৃষকদের প্রতি কোনরকম সহানুভূতি দেখাতে নরেন্দ্র মোদীর সরকার বিন্দুমাত্র রাজি নয়। আলোচনার অজুহাতে বারবার তাঁদের আন্দোলনে বিভেদ সৃষ্টির প্রয়াস পেয়েছেন তাঁরা। এখন তো এই সরকার এই আন্দোলনকারী কৃষকদের ‘দেশবিরোধী’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে! মোদী বিরোধিতা আর দেশবিরোধিতাকে সমার্থক করে তুলেছে তারা। সম্প্রতি এই কৃষি আইনের প্রতিবাদকারী এক তেরো বছরের কিশোরকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে ভ্যানে করে নিয়ে যাওয়ার ছবি ভাইরাল হয়ে গিয়েছে।

২০১৬ থেকে ২০১৯ সালের অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে আমাদের দেশে এই কুখ্যাত ইউএপিএ আইনে গ্রেপ্তার হয়েছেন ৫,৯২২ জন। ২০১৪ থেকে ২০১৯’র অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে ‘রাষ্ট্রদ্রোহ’র মামলা হয়েছে ৩২৬টি। কোনরকম বিরুদ্ধতার প্রতি অতি-অসহিষ্ণু এই সরকার প্রতিবাদের সমস্ত অধিকারকে কেড়ে নিয়েছে। সরকারের জনবিরোধী ভূমিকার কোনোরকম প্রতিবাদ এরা বরদাস্ত করেনা। ব্রিটিশ আমলে মীরাট ষড়যন্ত্র সহ বিভিন্ন মামলার অনুসরণে এখনও এলগার পরিষদ মামলার নামে দেশের প্রখ্যাত কবি-লেখক-বুদ্ধিজীবী-আইনজীবী-সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার করে দিনের পর দিন কারান্তরালে রাখা হয়েছে। এই কারান্তরালে থাকাকালীন সম্প্রতি তিরাশি বছর বয়সি অসুস্থ পাদরি স্ট্যান স্বামীকে হত্যা করা হয়েছে।

পশ্চিমবংলার ‘পরিবর্তন’এর সরকারও ইউএপিএ আইন প্রয়োগ করতে দ্বিধা করেনি। কেন্দ্রের বিজেপি সরকার যেমন রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তির দাবিকে অগ্রাহ্য করে থাকে, পশ্চিমবাংলার ক্ষেত্রেও তার বিশেষ ব্যতিক্রম দেখা যায়না। এখানেও গত দশ বছরে ৭ জন বন্দি জেল হেফাজতে মারা গিয়েছেন। এই ৭ জনের মধ্যে ৬ জনই ছিলেন ‘বিচারাধীন’ বন্দি। চারু মজুমদারের মতো একই প্রক্রিয়ায় পুলিশ হত্যা করেছিল ‘পিপলস মার্চ’ পত্রিকার সম্পাদক ‘মাওবাদী’ কথিত স্বপন দাশগুপ্তকে। এখানকার জেলে এখনও ৬ জন মহিলা সহ কয়েকজন সত্তরোর্ধ্ব বন্দিও আছেন। ২০১৪ থেকে ২০১৯’র অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে পশ্চিমবাংলায় ৮ জনের বিরুদ্ধে ‘রাষ্ট্রদ্রোহ’র মামলা দায়ের হয়েছে আর তারমধ্যে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে ৫টি মামলায়।

প্রতিবাদের অধিকার এখানেও সবসময় স্বীকৃত হয় না। সরকারি প্রতিবাদ ভিন্ন অন্যদের সংগঠিত প্রতিবাদকে এই সরকারও সম্মান জানাতে কার্পণ্য দেখাতে কসুর করে না। গত ১৬ জুলাই হাজরা মোড়ে এআইপিএফ, সিআরপিপি, পিইউসিএল, বন্দি মুক্তি কমিটি প্রভৃতি প্রায় কুড়িটি সংগঠনের তরফে রাজবন্দি পাদরি স্ট্যান স্বামীকে হত্যার প্রতিবাদে, সমস্ত রাজবন্দির নিঃশর্ত মুক্তির এবং ইউএপিএ, এনআইএ, আফস্পা সহ সমস্ত দমনমূলক আইন বাতিলের দাবিতে আহুত এক সভা করতে দেয়নি এই সরকার। ‘আত্মশাসন’এর অভিধায় লকডাউন জারি রেখে, জনজীবন বিপর্যস্ত করে তুলছে এই সরকার। সাধারণ খেটে-খাওয়া মানুষের রুজি-রোজগারের জন্য লোকাল ট্রেন চালুর জনদাবি ক্রমাগত উপেক্ষা করে চলেছে। স্বভাবতই আন্দোলন কোনও ‘বিলাসিতা’ নয়। এটাই প্রতিবাদী জনতার প্রয়োজনের হাতিয়ার। এই হাতিয়ারকে ব্যবহার করতেই প্রতিবাদী মানুষ পথে নামবেই। আজ থেকে সাতচল্লিশ বছর আগে অনেক অনেক প্রতিবাদী মানুষজনের সঙ্গে প্রবীর দত্তও পথে নেমেছিলেন। সেদিন প্রতিবাদী মিছিলে সামিল হওয়ার জন্যেই তাঁকে শহীদ হতে হয়েছিল। আজ প্রবীর নেই, কিন্তু আন্দোলন রয়ে গিয়েছে, রয়ে গিয়েছে প্রবীরদের রেখে যাওয়া পথ।

ফলতই নতুন উদ্যমে পথে নামার সময় এসেছে। ২০ জুলাই প্রবীরের শহীদত্বের সাতচল্লিশতম বার্ষিকী নতুন করে আহ্বান জানাচ্ছে: পথে এবার নামও সাথী, পথেই হবে এ পথ চেনা।

- অশোক চট্টোপাধ্যায়

খণ্ড-28
সংখ্যা-27