স্কুল খোলা কেন জরুরি
important to open school

দিন দুয়েক আগে স্কুলে গিয়েছিলাম। জরুরি কাজে। কয়েকজন সহকর্মীর সঙ্গে অনেক দিন পর দেখা হল। স্কুলে না আসতে পারা, ছাত্রদের সঙ্গে যোগাযোগ না থাকা জনিত কষ্টের কথা বলছিলেন কেউ কেউ। কেউ আবার বলছিলেন আমাদের অনেক বাচ্চা আর স্কুলে ফিরবে না। পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছে তারা। আমি একটু কৌতুহলী হয়ে জানতে চাইলাম, একথা কেন মনে হচ্ছে আপনার? তিনি যা বললেন তা মারাত্মক। এখন স্কুলে স্কুলে স্বচ্ছ ভারত অভিযানের তথ্য সংগ্রহের কাজ চলছে। অভিভাবককে ফোন করে জেনে নিতে হচ্ছে বাড়িতে শৌচালয় আছে নাকি সর্বসাধারণের শৌচাগার ব্যবহার করেন। ফোন করলেই অনেক অভিভাবক জানাচ্ছেন তার ছেলে বা মেয়ে আর স্কুলে যাবে না। পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছে। কাজ ধরেছে। অষ্টম শ্রেণীর মেধাবী ছাত্রের মা নাকি জানিয়েছে এখন তো মোবাইলে স্কুল হয়। ছেলেকে মোবাইল কিনে দেবার পয়সা নেই। তাই স্কুলে নাম রাখার কোনো মানে নেই। সব ক্লাসের একই অবস্থা। এই চিত্র শুধু আমার স্কুলের নয়। গোটা রাজ্যের। সমগ্র দেশের। বিশাল সংখ্যক ছাত্র ইতিমধ্যেই স্কুল ছুটের দলে নাম লিখিয়েছে। পরিসংখ্যান বলছে প্রায় ৪০ লক্ষ পড়ুয়া পড়াশোনার বাইরে চলে গেছে।

করোনার কারণে প্রায় দেড় বছর স্কুল বন্ধ। ছেলেমেয়েরা স্কুলের বাইরে। ভয়ংকর দুরবস্থার মধ্যে ছোটরা দিন কাটাচ্ছে। মানসিক স্বাস্থ্যের ভীষণ ক্ষতি হচ্ছে। অনেকে আবার অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ছে। নেশায় ডুবে যাচ্ছে।

আমাদের মনে রাখতে হবে স্কুল হল ছাত্রছাত্রীদের জীবনের অপরিহার্য অঙ্গ। শুধু লেখাপড়ার জায়গা নয়, বিদ্যালয় অনুভূতিক এবং সামাজিক (socio-emotional) বিকাশের আদর্শ পরিসর, অন্যের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের কৌশল, কঠিন সমস্যা মোকাবিলা করার উপায়; এসব সহপাঠীদের সঙ্গে সাবলীল মেলামেশায় আয়ত্ত করে নেওয়ার সুযোগ থাকে। নিজের জীবনের জটিল পরিস্থিতি প্রিয় বন্ধু বা মাস্টারমশাইয়ের সান্নিধ্যে সমাধানের পথ খুঁজে পায়। আমরা যদি আমাদের শৈশবের স্মৃতি রোমন্থন করি তাহলে দেখব অনেক কথা যা বাড়িতে বলা নিষিদ্ধ তা অবলীলায় সহপাঠীর সঙ্গে বলেছি। শুধু বলিনি, সেখান থেকে একটা সামাধানের পথ খুঁজে বের করেছি। আর যৌথ-দুষ্টুমির অনাবিল আনন্দ এখনও স্মৃতিতে আবিল হয়ে আছে আজও তা অমূল্য সম্পদ, আদরের ধন, বার্ধ্যকের বারাণসি। এই কারণেই তো বিখ্যাত গজল শিল্পী জগজিৎ সিংহ লিখেছেন –  আমার সম্পদ নিয়ে নাও। যশ, খ্যাতি প্রতিপত্তি সব নিয়ে নাও। তার বিনিময়ে আমার শৈশব ফিরিয়ে দাও। কাগজের নৌকা বানিয়ে আমি যে জলে ভাসাতাম তা আমি ফিরে পেতে চাই। আসাধারণ সেই আকূতি। সেই কারণেই বলছি বাচ্চাদের উদ্বেগ, বিষন্নতা বা মন খারাপ অনেকটা প্রশমিত হয় বন্ধুর সাহচর্যে। সহপাঠীকে সব কথা উজার করে বলতে পেরে, প্রতিকূল পরিবেশে বন্ধুর লড়াই করার গল্প শুনে তারা অনুপ্রেরণিত হওয়ার অবসর পায়। স্কুল এই সুযোগ করে দেয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই সক্ষমতাকে নাম দিয়েছে Life Skills বা জীবন শৈলী যা শৈশবে এবং বয়ঃসন্ধিতে পুরোটাই স্কুল থেকেই শেখার কথা।

WHO-র প্রতিবেদনে লেখা রয়েছে জীবন শৈলী হল, “adaptive and positive behaviour that enable individuals to deal effectively with the demands and challenges of everyday life.”

সিদ্ধান্ত নির্মাণ, সমস্যার সমাধান, সৃজনশীল চিন্তা, জটিল চিন্তা, কার্যকরি যোগাযোগ, পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপনের শৈলী, আত্ম সচেতনতা, সমানুভূতি, মানসিক চাপ এবং অনুভূতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখার শিক্ষা এই দশ মহাবিদ্যা শেখার সুযোগ মানুষ স্কুল জীবনেই পায়। সর্বোপরি অভিভাবকতুল্য শিক্ষিকা-শিক্ষকদের পরিচর্যা এবং স্নেহ-স্পর্শ ছাত্রদের রূপান্তরের সুযোগ করে দেয়। মনের ভেতর জমে থাকা ক্লেদ-কালিমা ধুয়ে মুছে যায় মাস্টারমশাইয়ের সামান্য প্রশ্রয় পেলে।

করোনা আবহে স্কুল বন্ধ। বাড়িতে বন্দী শিক্ষার্থীরা। নিষেধের বেড়াজালে তাদের প্রাণ হাফিয়ে উঠেছে। বন্ধুর সঙ্গে সামনাসামনি দেখা করার সুযোগ নেই। আড্ডা, মজা, দুষ্টুমি সব অতীত। কতদিনে শেষ হবে অতিমারীর প্রকোপ তা তাদের অজানা। বড়োরাও কোনো দিশা দিতে পারছেনা। কোনো পরিকল্পনা করে ওঠা সম্ভব হচ্ছেনা। পড়াশোনা নিয়ে ঘোরতর অনিশ্চয়তা। বেসরকারি স্কুলের সম্পন্ন ছাত্রদের অনলাইনে ক্লাস চলছে। সেখানে অনিচ্ছা থাকলেও ‘অন’ হতে হচ্ছে দিনের মধ্যে একাধিক বার। চলছে পড়াশোনার ঝকমারি। লেখাপড়ার হদ্দ মুদ্দ। সোনার খাঁচায় বন্দী করে ইন্টারনেটের ডগা দিয়ে শিশুর মুখে ঢুসে দেওয়া হচ্ছে শিক্ষা। ‘তোতাকাহিনী’র খবর যেমন কেউ রাখেনি, এখানে বাচ্চাদের খবর কেউ রাখছে না। এ অবস্থায় উদ্বেগ তো জমাট বাঁধবেই ছোট্ট মনে। রাগও হওয়া অস্বাভাবিক নয়। অসহ্য উৎকন্ঠা-রাগ বেরিয়ে আসতে না পেরে অবসাদ জন্ম নিচ্ছে শিশু মনে। তারমধ্যে আগে থেকেই যাদের মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যা রয়েছে তাদের অবস্থা আরো দুর্বিষহ। তাই এই মুহূর্তে স্কুল ছাত্রছাত্রীদের কাছে একটা বড়ো স্বস্তির জায়গা হয়ে উঠতে পারে। স্কুল ভালো লাগার পরিসর। অসহ্যতাকে মানিয়ে নেওয়ার সুযোগ। নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখার নিরীক্ষাগার। অসংযত অনুভূতিকে আয়ত্তে রেখে মূল স্রোতে ভেসে থাকার পরিমন্ডল।

সম্প্রতিক পরিস্থিতিতে ছাত্রছাত্রীদের মানসিক সংকটের কথা মাথায় রেখে এবং পাঠদানের কাজকে সচল রাখার জন্য কিছু শিক্ষক ব্যক্তিগতভাবে চেষ্টা করছেন। স্বল্প হলেও সাধু উদ্যোগ। তবে অন্যদিকে এই অবস্থায় ছাত্রদের বিদ্যালয়ে ফিরিয়ে আনাটা অত্যন্ত জরুরি। তা নাহলে হয়ত অনেক কুঁড়িকে ঝরে যেতে দেখতে হবে আমাদের। মানসিক স্বাস্থ্যে মহামারির জন্য দায়ী থাকতে হবে। সরকারের উচিত সমস্তরকম স্বাস্থ্যবিধি মেনে ছাত্রদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব স্কুল ফিরিয়ে দেওয়া। অন্তত আর পাঁচটা পরিষেবার মতো পড়াশোনাও যে অত্যন্ত জরুরি এটা সরকার মান্যতা দিক এবং বিশেষজ্ঞদের নিয়ে আলোচনায় বসুক। সমস্ত স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্কুল কীভাবে খোলা যায় তার চর্চা হোক।

- কমল কুমার দাশ  

খণ্ড-28
সংখ্যা-24