বিবৃতি
দিল্লীর যে জমায়েত থেকে মুসলিমদের গণহত্যার ডাক দেওয়া হয়েছিল, তার সংগঠকদের ও তাতে অংশগ্ৰহণকারীদের গ্ৰেপ্তার করতে হবে
Arrest Organisers and Participants

(দিল্লীতে বিজেপি অনুগতদের এক জমায়েত থেকে মুসলিম-বিরোধী গণহত্যার ডাক দেওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে সিপিআই(এমএল)-এর কেন্দ্রীয় কমিটির দেওয়া বিবৃতিটির ভাষান্তর আমরা এখানে রাখছি।)

স্বাধীনতা দিবসের এক সপ্তাহ আগে গত ৮ মার্চ বিজেপির দিল্লীর পূর্বতন মুখপাত্র অশ্বিনী উপাধ্যায়ের নেতৃত্বে জাতীয় রাজধানী দিল্লীর পারলিয়ামেন্ট স্ট্রীটে ৫০০০ লোকের এক জমায়েত সংগঠিত করা হয়। ওরা ঐ অনুষ্ঠানের নাম দেয় ‘জেগে ওঠো ভারত’ এবং শ্লোগান দেয় “মুসলিমদের গণহত্যা করা হলে তারা রামের (হিন্দু দেবতা) নাম নাম নিয়ে চিৎকার করবে।” জমায়েতের সংগঠকরা একটা প্রচারপত্র বিলি করে যাতে জনগণের উদ্দেশ্যে এই প্রশ্ন রাখা হয় যে, তারা “ইসলামকে খতম করতে” আগ্ৰহী কি না। ঐ জমায়েতের জন্য পুলিশের কাছ থেকে কোনো অনুমতি নেওয়া হয়নি, এ সত্ত্বেও সেদিন পুলিশ কোনো অংশগ্ৰহণকারীকেই ছত্রভঙ্গ বা গ্ৰেপ্তার করেনি। ব্যাপক প্রতিবাদ এবং সক্রিয় ব্যবস্থা গ্ৰহণের দাবি ওঠার পরই কেবল দিল্লী পুলিশ উপাধ্যায় এবং আরো চার জনকে গ্ৰেপ্তার করে। তবে, পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে আইনের তুলনামূলকভাবে দুর্বল ধারাই প্রয়োগ করেছে।

“জেগে ওঠো ভারত” কর্মকাণ্ডের দুই সংগঠক প্রীত সিং ও অশ্বিনী উপাধ্যায় ঘোষণা করেছিলেন, তাঁরা ভারতের ‘বিদেশী’ আইনি কাঠামো বাতিলের দাবি জানাচ্ছেন এবং আরো দাবি জানাচ্ছেন যে, ভারতীয় সংবিধানে “এক হাজার সংশোধনী” আনতে হবে যাতে তা “হিন্দু রাষ্ট্রের ভিত্তি তৈরি করতে পারে”। এটা কিন্তু সুস্পষ্ট রূপে ধরা পড়ে যে, “বিদেশী” আইন বলতে তাঁরা রাষ্ট্রদ্রোহ, ইউএপিএ, সেনা বাহিনীর বিশেষ ক্ষমতা আইন আফস্পা-র মতো ঔপনিবেশিক যুগের এবং ঔপনিবেশিক শাসন অনুপ্রাণিত আইনগুলোকে বোঝাননি। তাঁরা ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সংবিধানকেই কলুষিত করতে চান যাতে তা হিন্দু কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হয়।

এই ঘটনার উল্লেখও জরুরি যে, গত ৪ জুলাই হরিয়ানা বিজেপির মুখপাত্র সুরজ পল আমু পাতৌদিতে এক জমায়েত পরিচালিত করেন যেখান থেকেও রামের নাম নিয়ে মুসলিম গণহত্যার আহ্বান জানানো হয়, এবং আমু নিজেই বলেন, “প্রয়োজন হলে গলা কেমন করে কাটতে হয় তা আমরা জানি।” আমু এখনও বিজেপির মুখপাত্র আছেন এবং কি হরিয়ানার পুলিশ কি ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক কেউই তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। দিল্লীর ঘটনা স্পষ্টতই এমন কোনো ঘটনা ছিল না যা মাত্র একবারই ঘটেছে এবং কোনো “প্রান্তিক গোষ্ঠীও” তা ঘটায়নি। ভারতের হিন্দু কর্তৃত্ববাদী শাসক দল বিজেপিই দেশের মুসলমানদের বিরুদ্ধে গণহত্যাকারী হিংসা চালানোয় প্রস্তুত করতে হিংস্র জনতাকে প্রণালীবদ্ধভাবে সংগঠিত করছে ও প্রশিক্ষণ দিচ্ছে।

গত এক বছরে জাতীয় রাজধানীতে যত মুসলিম-বিরোধী হিংসার ঘটনা ঘটেছে, তার সবকটিতেই হাত থেকেছে জাতীয় রাজধানী সংলগ্ন উত্তরপ্রদেশের গাজিয়াবাদ জেলার দাসনা মন্দিরে ঘাঁটি করা এক সহিংস ও বিপজ্জনক সংগঠনের। আগস্টের ৮ তারিখে জমায়েত হওয়া জনতাও এর কোনো ব্যতিক্রম ছিল না। গাজিয়াবাদের দাসনার শিব শক্তি ধাম মন্দিরের ‘মহন্ত’ ইয়াতি নরসিংহানন্দ সরস্বতী জানিয়েছেন যে, সেদিনের ঘটনায় “তাঁর বহু শিষ্যই উপস্থিত ছিলেন”। রামের নামে মুসলিমদের গণহত্যা করার সমর্থনে তিনি এই যুক্তি দিয়েছেন যে, “সেদিনের ঘটনার যথেষ্ট প্রয়োজন ছিল এবং যারা শ্লোগানগুলো তুলেছিল তাদের পক্ষে সেগুলো এই জন্যই ন্যায়সংগত ছিল যে, হিন্দুদের যথেষ্ট অবরুদ্ধ ক্রোধ রয়েছে।…” হিন্দুত্ববাদী আধিপত্যকারীদের “সশস্ত্র প্রশিক্ষণ” দেন বলে যিনি ঘোষণা করেছেন, সেই নরসিহানন্দের কথাকে কি উত্তরপ্রদেশ সরকার কি কেন্দ্রীয় সরকার কোনো গ্ৰাহ্যই করেনি, ব্যবস্থা নেওয়াতো দূরের কথা।

ভারতের জাতীয় রাজধানীর চারপাশে প্রকাশ্য সহিংস সমাবেশের জন্য মোদী সরকারই বিশেষভাবে দায়ী। গত এক বছরে বহু বিজেপি, আরএসএস এবং এবিভিপি নেতা এবং অন্যান্য হিন্দু আধিপত্যবাদী পুরুষ ও মহিলা দিল্লী এবং জাতীয় রাজধানী অঞ্চলে প্রকাশ্যেই মুসলিম-বিরোধী হিংসায় ইন্ধন জুগিয়েছেন, কিন্তু পুলিশ বা সরকার তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। বিজেপি নেতা কপিল মিশ্র মুসলিমদের গুলি করে মারার কথা বলে মুসলিম-বিরোধী হিংসায় ইন্ধন জুগিয়েছেন; রাম ভক্ত গোপাল জামিয়া মিলিয়া ক্যাম্পাসে ছাত্রদের বিরুদ্ধে গুলি ছুঁড়েছেন; এবিভিপি নেতা কোমল শর্মা এক উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে পরিচালিত করেন যারা লোহার রড দিয়ে জেএনইউ-র ছাত্র ও শিক্ষকদের বিরুদ্ধে হিংস্র আক্রমণ চালায়; উত্তর-পূর্ব দিল্লীতে মুসলিম খুনে হিংস্র জনতাকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বলে দম্ভোক্তি করেছিলেন রাগিনী তিওয়ারি। মিশ্র, শর্মা বা তিওয়ারির বিরুদ্ধে পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি; নরম অভিযোগ দিয়ে গোপালকে কিছু সময় গ্ৰেপ্তার করে রাখা হয়েছিল, তারপর জামিনে ছেড়ে দেওয়া হয়।

প্রতিবাদকে সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে একাকার করে তুলে অহিংস আন্দোলনের সংগঠকদের দানবীয় আইনে জেলে পোরা হলেও মুসলিম-বিরোধী বিদ্বেষ বচন এবং হিংসা শাস্তি থেকে অব্যাহতি পেয়ে এসেছে এবং মোদী ও শাহর নেতৃত্বাধীন সরকারের মদতও লাভ করেছে।

বিজেপি ও আর এস এস আমাদের দেশকে “রক্ত-গঙ্গা বওয়ানো জবাইখানায়” পরিণত করতে চাইলে ভারতের জনগণ কিন্তু মুখ বুজে বসে থাকবেন না। আমরা জনগণের কাছে আবেদন জানাচ্ছি – ১১ ও ১২ আগস্ট প্রতিবাদ সংগঠিত করুন এবং নিম্নলিখিত দাবিগুলো তুলে ধরুন –

১) অশ্বিনী উপাধ্যায় ও ইয়াতি নরসিংহানন্দকে এবং ঘৃণাপূর্ণ প্রচারপত্রটির জন্য যারা দায়ী তাদের গ্ৰেপ্তার করে সংশ্লিষ্ট সমস্ত আইনে অভিযুক্ত করতে হবে।

২) ৮ আগস্টের জমায়েতকে থামাতে ব্যর্থ হওয়ার জন্য দিল্লী পুলিশ প্রধানকে পদত্যাগ করতে হবে।

৩) সক্রিয় পদক্ষেপ নিয়ে ৮আগস্টের জমায়েতকে থামাতে ব্যর্থ হয়েছে দিল্লী  পুলিশের যে অফিসাররা, তাদের চিহ্নিত করে বরখাস্ত করতে হবে।

৪) কপিল মিশ্রর ‘হিন্দু ইকোসিস্টেম’ এবং ইয়াতি নরসিংহানন্দের ‘শিব শক্তি ধাম মন্দির’ সহ দিল্লী-এনসিআর-এর হিন্দু-আধিপত্যবাদী নেটওয়ার্কগুলোর স্বরূপ উন্মোচন করে সেগুলোর বিলোপ ঘটাতে আদালতের নজরদারিতে এক তদন্ত চালাতে হবে।

খণ্ড-28
সংখ্যা-30