লক্ষ্মীর ভাণ্ডার
treasure

পাড়ায় পাড়ায় বিপুল চাঞ্চল্য। মহিলারা এবার সরকারি হাতখরচ পাবেন! পশ্চিমবঙ্গের স্থায়ী বাসিন্দা, পঁচিশ থেকে ষাটের মধ্যে যাদের বয়েস, যাদের কোনো বাঁধা রোজগার নেই, যাদের পরিবার আয়করের আওতামুক্ত এবং যাদের পারিবারিক মালিকানায় দু'হেক্টরের কম জমি আছে, সেই মহিলারা মাসে ৫০০ টাকা (জেনারেল কাস্ট ও ওবিসি) আর এসসি/এসটি-ভুক্ত মহিলারা মাসে ১০০০ টাকা করে পাবেন। সরাসরি নিজের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে।

‘স্বাস্থ্যসাথীর’ হাত ধরে এল ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’। অনেকেই বিরস বদনে মন্তব্য করেছেন, “হ্যাঁ, আমাদের করের টাকায় মেলা খেলা ফুটবল বিতরণ-এবার মেয়েদের বিলাসব্যসন! সব ভোটের অঙ্ক!” এমনিতেই গৃহকর্ত্রীর নামে স্বাস্থ্য সাথী কার্ড-এর ব্যাপারটা তারা ভালো মনে নেননি। ‘মেয়েছেলেকে’ মাথায় তোলা কেন? তাদের কোন্ যোগ্যতা আছে? এবার আবার বসে বসে 'হাতখরচ'!

হ্যাঁ, ঠিক জায়গাতেই ঘা পড়েছে! নির্বাচনী প্রচারে যখন ‘মেয়েছেলে’কে ‘পায়ের তলার চটি’ ভাবায় অভ্যস্তরা ‘দিদি! অ দিদি!’ বা ‘মমতা বেগম’ বলে নারীর সম্মানহানি করতে পেরেছেন, তার বিপ্রতীপে মেয়েদের সমাজে, পরিবারে মাথা উঁচু করে বাঁচার ভাবনা থেকে এল স্বাস্থ্যসাথী কার্ড। এবার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি মেনে আসছে ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’ - রাজ্য বাজেটে মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা রাজ্যের এক কোটি ঊনসত্তর লক্ষের বেশি মহিলাকে এই সহায়তার জন্য ব্যয়বরাদ্দে টাকার সংস্থান রাখা হয়েছে ।

এই প্রকল্পটির টার্গেট গ্রুপ যারা, সম্পূর্ণ দুর্নীতিমুক্ত ভাবে যদি প্রকল্প রূপায়িত হয়, তাহলে সত্যিই কি এটা সরকারের ‘অনুৎপাদক’ ব্যয় হবে? কন্যাশ্রী রূপশ্রী আর বিধবা ভাতা বার্ধক্য ভাতার মাঝখানে এই অংশটি গরিব নিম্নবিত্ত পরিবারের বধূ যারা উদয়াস্ত সংসারের জন্য পরিশ্রম করেন, স্বামী-সন্তানের বাড়তি পুষ্টির জন্য, ছেলে মেয়েদের ঠিকঠাক পড়াশুনোর জন্য মুখে রক্ত তুলে খাটেন, কিন্তু নিজের জন্য এক পয়সা রাখার সঙ্গতি যাদের নেই। মাসে মাসে এই টাকার ভরসায় কেউ হয়তো সংসারের প্রয়োজনে, ঘরবাড়ির সংস্কারের জন্য, বা পরিবারের ছোট্ট ব্যবসা চালানোর জন্য দীর্ঘমেয়াদী ঋণ নিতে পারবেন। শেষ বিচারে সে অর্থ সমাজের অর্থনীতির মূল স্রোতে মিশে তাকেই খানিকটা চাঙ্গা করবে বৈকি! সুতরাং লকডাউন পরিস্থিতিতে অর্থনীতিবিদরা যে সরকারকে মানুষের হাতে টাকা দেওয়ার কথা বলেছিলেন তার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে এই উদ্যোগ।

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ভাবেই এই প্রকল্পের সূচনা থেকেই দুর্নীতি সঙ্গ নিয়েছে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রশাসনিক স্তরে দিশাহীনতা ও সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাব। মুখ্যমন্ত্রী যেখানে একাধিকবার জানিয়েছেন, অন লাইনে বা অন্য কোনও ভাবে নয়, ‘দুয়ারে সরকার’ ক্যাম্প থেকে ফর্ম পাওয়া যাবে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে, সেক্ষেত্রে বহু জায়গা থেকেই পয়সা নিয়ে আগাম ফর্ম বিক্রি এবং পয়সা নিয়ে ফর্ম ফিল আপ করার খবর পাওয়া যাচ্ছে।

ফর্ম বিলি থেকে শুরু করে গোটা প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। বিশেষ করে শাসকদলের আধিপত্য এবং তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতিগ্রস্ততার কারণে। ফলে প্রকৃত প্রয়োজন যাদের আছে, তাদের হাতে টাকা পৌঁছানো নিয়েও সন্দেহ থেকে যাচ্ছে।

 লকডাউন-উত্তর আপৎকালীন ব্যবস্থা হিসেবে ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’ এই মুহূর্তে একটি বিশেষ উদ্যোগ। বিশেষত উপর্যুপরি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের তাণ্ডববিধ্বস্ত পরিস্থিতিতে। কিন্তু নারীর ক্ষমতায়ন তথা প্রকৃত মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় সরকার কতটা আগ্রহী? নারীর মর্যাদা তখনই প্রতিষ্ঠিত হতে পারে যখন সামাজিক উৎপাদন তথা অর্থনীতিতে তাদের প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরি হবে। হাত পেতে নেওয়া নয়, পরিশ্রমী হাত দুটোকে, মেধা, অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে স্বোপার্জনেই আজকের নারী আগ্রহী। তাতেই তাদের মর্যাদা ও গৌরব! সেই সুযোগ কতটা পাচ্ছে রাজ্যের নারীসমাজ? দরিদ্র নিম্নবিত্ত পরিবারের অশিক্ষিত, সাক্ষর বা স্বল্প শিক্ষিত মহিলাদের কর্মসংস্থানের কতটা সুযোগ তৈরি হয়েছে আজ পর্যন্ত?

গ্রামীণ কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রটি মহিলাদের জন্য বিশেষত অতিমারী পরিস্থিতিতে সংকুচিত হয়ে গেছে। ভিন রাজ্যে কাজে যাওয়া শ্রমিকরা ঘরে ফিরে আসায় একশো দিনের কাজে মহিলাদের সুযোগ কমে গেছে। (এখন অবশ্য দাবি ২০০ দিনের কাজ এবং পরিবারের সবার জন্য জব কার্ড। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের বঞ্চনাও তাতে বড় রকম বাদ সাধছে)। পশ্চিমবঙ্গ এ ব্যাপারে দেশের মধ্যে এগিয়ে থাকলেও এখানে গড়ে ৬২ দিনের বেশি শ্রমদিবস তৈরি করা যায়নি। কৃষি, মৎস্যচাষ, খাদ্যপ্রক্রিয়ন, ফল-ফুলের চাষ, কুটির শিল্প ও লোকসংস্কৃতির পুনরুজ্জীবন ও তাকে আধুনিক নাগরিক সমাজে তুলে ধরা, প্রসূতি মা ও শিশুর পরিচর্যা, কুসংস্কার, অপবিজ্ঞানের বিরোধিতা করে গ্রামীণ জনজীবনে সমাজমনস্কতা, বিজ্ঞান চেতনা, স্বাস্থ্য সচেতনতা গড়ে তোলা, প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ – এ সব ক্ষেত্রে মহিলাদের কর্মসংস্থানের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে । চাই সরকারের সদিচ্ছা ও বাস্তবোচিত সুষ্ঠু পরিকল্পনা। চাই উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও সামাজিক নিরাপত্তা। চাই আধুনিক প্রযুক্তির উপযুক্ত ব্যবহার। চাই দুর্নীতিমুক্ত স্বচ্ছ প্রশাসনের আন্তরিক সহযোগিতা, নিয়মিত তদারকি। এ সব,আপাতত সোনার পাথরবাটি মনে হলেও, সত্যিই সম্ভব।

দু'টি বিষয়ের উল্লেখ করে শেষ করব। পাশের বাড়ির বধূটি জানালো, শ্বশুর ‘স্বাস্থ্যসাথী’র আওতাভুক্ত হতে নারাজ, কারণ তার সন্দেহ এটা বাড়ি হাতিয়ে নেওয়ার চক্রান্ত! (স্বাস্থ্যসাথী কার্ড না থাকলে লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের জন্য আবেদন করা যাবে না)। পিতৃতান্ত্রিক সমাজ মানসিকতার বদল কতটা জরুরি সেটা সরকারকে ভাবতে হবে।

মনে পড়ে গেল, প্রতিবেশিনী অত্যন্ত শান্ত স্বভাবের এক মেয়ে কথা প্রসঙ্গে চোয়াল শক্ত করে বলেছিল, “এখন আর আমি শান্ত নেই! বাইরে কাজে বেরিয়ে বুঝেছি আজ মুখ খোলা কত জরুরি!” ও একটা শপিং মলে কাজ করত। টিঁকতে পারেনি। নতুন কাজের সন্ধানে আছে। এ রকম অজস্র মেয়ে ছোট ছোট কারখানায়, মলে, কলসেন্টারে, ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা নার্সারি স্কুলে প্রতিনিয়ত ঘাম ঝরিয়ে চলেছে, যৎসামান্য পারিশ্রমিকে। নারীশ্রম লুণ্ঠন তো চলছেই, তার সঙ্গে জুটছে লাঞ্ছনা, অসম্মান। ওরা রুখে দাঁড়াতে চায়। কিন্তু এই মুহূর্তে ওরা অসহায় – যদি কাজটা চলে যায়! সরকার ওদের পাশে দাঁড়াবে? কীভাবে? কবে? যেখানে নিজেই প্রকল্প কর্মীদের শ্রম লুণ্ঠন করে চলেছে!

- জয়ন্তী দাশগুপ্ত

খণ্ড-28
সংখ্যা-32