মালদায় অপহরণ ও খুন করে ‘আত্যহত্যা’র গল্প
murder in Malda

মালদা জেলার কালিয়াচকের ১ ব্লক আলিপুর ২ গ্রাম পঞ্চায়েতের ৫২ বিঘি গ্রামের বাসিন্দা সাজিকুল মোমিন (৩৫) কালিয়াচক ২ ব্লকের ঘড়িয়ালিচক লেবার কমিশন সাহাদাত আলির মাধ্যমে ভিনরাজ্যে কাজ করতেন। কাজের বিনিময়ে ১ লক্ষ টাকা অগ্রিম নিয়েছিলেন এবং ৪ মাস কাজ করে প্রায় ৫০ হাজার টাকা শোধ করেছিলেন। লকডাইনে কাজ করতে যাওয়া হয়নি। সাজিকুল মোমিনের কাছ থেকে টাকা আদায়ের জন্য সাহাদাত আলি চাপ সৃষ্টি করতে থাকে। নিজের লোকজন পাঠিয়ে ঘরের টালি ভেঙে দেয়। হুমকি চলে ৫০ হাজার টাকার সুদ সমেত ১ লক্ষ টাকা দিতে হবে। কমিশনের টাকা শোধ করতে না পারলে তুলে নিয়ে এসে বন্দি করে রাখা, এলাকায় নতুন কিছু নয়। কিন্তু এবারে এমন বন্দি শ্রমিককে পিটিয়ে মেরে ফেলার অভিযোগ উঠল কালিয়াচকে। শুধু তাই নয়, অভিযুক্তদের আড়াল করতে পুলিশের অত্যাচার নামে প্রতিবাদীদের উপর।

২ জুলাই সাজিকুল মোমিনকে ঝাড়খন্ডের বারহারুয়া থেকে অপহরণ করে কালিয়াচকে নিয়ে আসে সাহাদাত আলি ও তার ভাড়াটে বাহিনী। সাহাদাত আলির বিশাল বাড়ির আন্ডারগ্রাউন্ডে আটকে রেখে সাজিকুল মোমিনকে প্রচন্ড মারধর করে চারদিন ধরে। তারফলে মারা যায় সাজিকুল। লেবার কমিশনে নিজেকে খুনের দায় থেকে বাঁচানোর জন্য সাহাদাত আলি পরিকল্পনা মাফিক মৃত সাজিকুল মোমিনকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিয়ে ‘আত্মহত্যা’ করেছে রটিয়ে দেয়। সাহাদাত আলির পুলিশের সাথে গোপন আঁতাত করে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা সাধারণ মানুষের মধ্যে জানাজানি হয়ে গেলে, নতুন কৌশল হিসাবে লোক পাঠানো হয় সাজিকুল মোমিনের স্ত্রীর কাছে ৫ লক্ষ টাকা দিয়ে। রাতারাতি কবর দিতে পারলেই প্রশাসনকে নীরব করিয়ে দেওয়া যাবে। ৫২ বিঘি এলাকার তৃণমুল প্রতীকে নির্বাচিত সদস্য মানব সেখের নেতৃত্বে ফারুক মোমিন, এস্রাউল, কাশিম ইত্যাদিরা ‘কমিশন’ থুড়ি লেবার সাপ্লায়ার হিসাবে পরিচিত। এরা সাজিকুলের স্ত্রী সুফিয়া বিবিকে ৫ লক্ষ টাকার বিনিময়ে মিটমাট করে নিতে বলে। সুফিয়া বিবি বলে আমার স্বামীকে যারা মেরে ফেলল তাদের বিচার চাই। কোনভাবেই মীমাংসা না মানার খবরটিও এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে রাত্রিবেলা কালিয়াচক থানার পুলিশ সুফিয়া বিবিকে তুলে নিয়ে যায়। এখানে মনে রাখা দরকার সাহাদাত আলির বাবা হলেন শওকত সর্দার, যিনি শাসকদলের নেতা এবং মাফিয়া ডন বলে পরিচিত। সুফিয়া বিবির সাথে যারা এসেছিলেন তারা দেখেন সাজিকুলকে প্রচন্ড অত্যাচার করে সাহাদাত আলি তার বাড়ির আন্ডারগ্রাউন্ডে গলায় ফাঁস দিয়ে ঝুলিয়ে দিয়েছে। থানার ভারপ্রাপ্ত অফিসার সুফিয়া বিবিকে থানায় নিয়ে যায়। থানায় নিয়ে গিয়ে সাদা কাগজে স্বাক্ষর করে তার হাতে কোনও রিসিভ কপি না দিয়ে ছেড়ে দেয়।

পুলিশ প্রশাসন ও হত্যাকরীর গোপন আঁতাতের কৌশলের বিরুদ্ধে ৬ জুলাই সিপিআই(এমএল) লিবারেশন ও পিডিএস-এর নেতৃত্বে ৫২ বিঘিতে প্রায় ২০০ মহিলা সহ সাধারণ মানুষদের সঙ্গে নিয়ে কালিয়াচকে রাস্তা অবরোধ হয়। দাবি ওঠে পুলিশ ও খুনির গোপন আঁতাত ধংস হোক। মোমিনের আত্মহত্যার গল্প ফেঁদে আসল খুনিকে আড়াল করা চলবে না। অবিলম্বে সাজিকুল মোমিনের খুনিকে গ্রেপ্তার করতে হবে। অবরোধ তুলতে পুলিশ ব্যাপক হারে লাঠি চালায়। পুলিশ টার্গেট করে সিপিআই(এমএল) নেতা এব্রাহিম ও সাজিকুলের স্ত্রী সুফিয়া বিবির উপর। সাজিকুলের ১৪ বছরের ছেলেও রেহায় পায়নি। এই অবরোধে অংশগ্রহণ করেন সিপিআই(এমএল) জেলা কমিটির সদস্য লুৎফুর রহমান, কয়েশ আলি, সামিরুদ্দিন, পিডিএস-এর নাসিমুল হক প্রমুখ। মামি সৎকাজে অংশ নিতে ৫২ বিঘি চলে যায়। কালিয়াচক থানার আইসি বিশাল পুলিশ বাহিনী নিয়ে রাত্রি প্রায় ৭টার সময় বাড়িতে চড়াও হয় এই প্রতিবেদককে ধরার জন্য। বাড়িতে আমার স্ত্রী, বৌমা এবং নাতি-নাতনিরা বাড়ির ভিতরে দরজা লাগিয়ে ছিল। আইসি সামনে থেকে দরজা খুলতে বললে আমার স্ত্রী বলেন আমার স্বামী বাড়িতে নেই, এছাড়া আর কোনও পুরুষ মানুষ কেউ নেই, তাই দরজা খুলতে পারব না — একথা বলার সঙ্গে সঙ্গে তারা দরজায় লাঠি মারতে থাকে। বলে দরজা না খুললে লাথি মেরে দরজা ভেঙ্গে দেব, কেউ বলে জেসিপি দিয়ে বাড়ি ভাঙ্গা হবে। বাড়িতে গিয়ে আমার স্ত্রী ও প্রতিবেশীর মুখে শুনে আমার একটা ধারণা হয়েছে, মনে হয় পুলিশের উর্দি পরে খুনিদের গুন্ডারা আমার প্রাণ নাশ করতে হাজির হয়েছিল।

বাড়িতে পুলিশের হামলার খবর ছড়িয়ে পড়লে খবর যায় সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের রাজ্য কমিটি ও কেন্দ্রীয় পলিটবুরো সদস্য কার্তিক পালের নিকট। তিনি কালিয়াচক আইসি’র সঙ্গে কথা বললে আইসি হুমকির সুরে বলেন আগে ইব্রাহিমকে অ্যারেস্ট করব তারপরে আপনার সঙ্গে কথা বলব। এই কথা পিডিএস-এর রাজ্য নেত্রী অনুরাধা দেবের নিকট পৌঁছে যায়। অনুরাধা দেব কালিয়াচক থানার আইসি’র সঙ্গে কথা বললে সমস্যা শোনার বদলে হুমকীর সুরে বলে ইব্রাহিম ও নাসিমূলকে গ্রেফতার করার পরে কথা বলব। আইন রক্ষার শপথ নিয়ে যারা চাকরিতে আসেন, উর্দি আর অস্ত্র যাদের হাতে তুলে দেওয়া হয় দুষ্টের দমনের জন্য, তারা যখন সেই শপথকে অমর্যাদা করে দুষ্টের বন্ধু হয়ে ওঠে, তাদের কাছ থেকে প্রতিবাদীরা হুমকি ছাড়া অন্য কিছু আশা করতে পারে না। আমাদের আশা একমাত্র জনসাধারণ।

৭ জুলাই পুরো ঘটনার বিবরণ দিয়ে সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের নেতৃত্বে মালদা জেলাশাসক ও পুলিশ সুপারের নিকট ডেপুটেশন দেওয়া হয়। অপরদিকে অনুরাধা দেব ৯ আগস্ট পুরো ঘটনার বিবরণ দিয়ে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর নিকট লিখিতভাবে জানান। ১০ জুলাই অনুরাধা দেব সহ সিপিআই(এমএল) ও পিডিএস সুফিয়ার সঙ্গে দেখা করার জন্য এলাকাতে যায়, কিন্তু তার আগেই সুফিয়াকে পুলিশ থানায় ধরে নিয়ে চলে যায়।

সুফিয়ার সঙ্গে কথা বলতে সকলে মিলে থানাতে এলে, থানার আইসি এবং শাসক দলের নেতারা অসভ্যের মতো আচরণ করে অনুরাধা দেব সহ সকলকে মার্ডার কেসের আসামী বানিয়ে এ্যারেস্ট করার হুমকি দেয়। এসপি’র হস্তক্ষেপে বাধ্য হয়ে আইসি অনুরাধা দেবের নিকট জোড় হাত করে ক্ষমা চায় এবং সকলকে মুক্ত করে। কালিয়াচক থানার আইসি’র এই ধরনের আচরণের বিরুদ্ধে ১২ জুলাই অনুরাধা দেব, নাসিমুল হক, মোহাঃ ইব্রাহিম এসপি’র সাথে সাক্ষাত করে। এসপি’র হস্তক্ষেপে সাহাদাত আলিকে পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয়েছে।

খণ্ড-28
সংখ্যা-30