আজকের দেশব্রতী : ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২১ (অনলাইন সংখ্যা)
deshabrati 23 september 2021

bharat bandh

ভিন রাজ্যের এক তরুণী। আসন্ন প্রসবা। নিঃসহায়, নিঃসম্বল। খানিকটা মানসিক ভারসাম্যহীন। পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ প্রান্তে এক স্টেশনে তাকে অসহায় ভাবে ঘোরাঘুরি করতে দেখে হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানে পরদিন একটি পুত্রসন্তান হয় তার। এরপর চিকিৎসক ও নার্সদের সহৃদয় পরিচর্যায় সে কিছুটা সুস্থ হয়ে তার ঠিকানা বলতে পারে। পাঞ্জাবের এক অজ পাড়া গাঁয়ে তার বাড়ি। লক ডাউনের সময় স্বামীর চাকরি যায়। তারপর একসময়ে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে তরুণী এবং বড় অদ্ভুত ভাবে এখানে এসে পড়ে। বহু কষ্টে তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে, তার ভাই জানায় তারা হদ্দ গরিব, ট্রেনভাড়া দিয়ে এসে বোনকে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা নেই। তাছাড়া বোনকে খাওয়ানোর সঙ্গতিও তার নেই। সন্তানসহ তরুণী মা এখনও হাসপাতালেই পড়ে আছেন।

ঋত্বিক ঘটক বেঁচে থাকলে হয়তো হৃদয় নিংড়ানো দরদ আর ক্রোধ নিয়ে একটা ছবি করতেন, (বা করতেন না)। কিন্তু স্বাধীনতার ৭৫ বছরে এ কোন হতদরিদ্র ভারতের ছবি?

গত দেড় বছরে অতিমারী পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় সরকারের হিংস্র লুঠেরার চেহারাটা একেবারে নগ্ন হয়ে গেছে। কোভিড-১৯ মোকাবিলায় সম্পূর্ণ ব্যর্থ সরকারটা দেশের মানুষকে ঠেলে দিয়েছে ভয়ঙ্কর দারিদ্র্য অনাহার অপুষ্টি অশিক্ষার অতল অন্ধকারে। সংগঠিত ও অসংগঠিত ক্ষেত্রে কোটি কোটি মানুষ কাজ হারিয়েছে। আর্থিক বৈষম্য তীব্রতম হয়েছে। দেশের মানুষের করের টাকায় মেধায় শ্রমে তিল তিল করে গড়ে ওঠা সম্পদ, পরিকাঠামো, পরিষেবা জলের দরে বেচে দিচ্ছে কর্পোরেটদের হাতে। বন-জঙ্গল-নদী-পাহাড়-খাদান লুঠ তো চলছেই কবে থেকে। অন্যদিকে চলছে ব্যক্তিমানুষের, বিভিন্ন শ্রেণীর, বিভিন্ন পেশার মানুষের সংবিধান-প্রদত্ত অধিকার হরণ। প্রতিবাদী মানুষকে দানবীয় আইনে বিনা বিচারে আটক রাখা, মেরে ফেলাও অব্যাহত।

মোদী-শাহর এই লাগামছাড়া দুঃশাসনীয় ঔদ্ধত্য, এই দানবীয় শোষণ আর নির্লজ্জ মিথ্যাচারের অভিশপ্ত আখ্যানের সমান্তরালে নিঃশব্দে লেখা হয়ে চলেছে ইতিহাসের আরেকটি অধ্যায়। সে ইতিহাস বীরত্বের, সাহসের, স্থৈর্যের, সহিষ্ণুতার, সর্বোপরি আত্মত্যাগের! সেই ইতিহাস লিখছেন ভারতবর্ষের কৃষক শ্রেণী! দিল্লীর সীমানায় সিঙ্ঘু, গাজিপুর, টিকরি বর্ডার ছাড়িয়ে সেই প্রতিস্পর্ধা ছড়িয়ে পড়ছে ভারতের প্রতিটি কোণে। মোদী-শাহের নির্মমতায় বিপর্যস্ত মানুষের সমস্ত ক্ষোভ, প্রতিবাদকে নিজের মধ্যে সংহত করে কৃষকরা হয়ে উঠেছেন আরও জেদী, আরও লড়াকু, আরও কুশলী, আরও দূরদর্শী, আরও দায়িত্বশীল। তাই তারা মোদী-শাহ তথা বিজেপি-আরএসএস-এর এই জুলুমশাহীর বিরুদ্ধে ডাক দিয়েছেন দেশব্যাপী প্রতিবাদের, ডাক দিয়েছেন ‘ভারত বন্ধের’, আগামী ২৭ সেপ্টেম্বর।

গত ২৬ নভেম্বর, ২০২০, ৭১তম সংবিধান দিবস, যেদিন সারা ভারতের ২৫ কোটি শ্রমজীবী, পেশাজীবী মানুষ সাধারণ ধর্মঘটে উগড়ে দিয়েছিলেন তাদের ক্ষোভ, সেইদিন কৃষকরা তিনটি জনবিরোধী কৃষি-বিরোধী কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবিতে দিল্লী অভিযান করেছিলেন শাসকের সব অত্যাচার উপেক্ষা করে। সেই শুরু। তার পরের ঘটনাপ্রবাহ সবার জানা। এখন আর সেই তিনটি দাবিতে তারা আটকে নেই। ছড়িয়ে পড়েছেন তারা জনজীবনের বিভিন্ন স্তরে। কুড়িয়ে নিয়েছেন বিভিন্ন স্তরের বিভিন্ন দাবি। সাচ্চা নেতার মতো! তারা প্রাইভেটাইজশন, মানিটাইজেশন-এর নামে দেশের সম্পদ বেচা, শ্রমিক-অধিকারের উপর হামলা এবং ভারতীয় সংবিধানের উপর হিন্দুত্ববাদীদের হামলার বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন। তারা বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে ‘মোদীর ভারত বেচা’র অপচেষ্টাকে উন্মোচিত করে চলেছেন।

ফিরে এসেছে কৃষক সংগঠনের সেই শিহরণ-জাগানো শ্লোগান ‘আল্লাহ্ আকবর’ ‘হর হর মহাদেব’। গত ৫ সেপ্টেম্বর মজফ্ফরপুরের ‘কিসান মহাপঞ্চায়েত’ চলমান রাজনৈতিক আন্দোলনে শ্রেণিগত ও সাম্প্রদায়িক ঐক্যের এক ঐতিহাসিক নজির রেখেছে। জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র যুব মহিলাসহ সমস্ত মানুষের ঐক্যকে শাসক শ্রেণী সবচেয়ে ভয় পায়। আর এই ঐক্যই হবে সাধারণ মানুষের শাসকদল তথা জনবিরোধী সরকারের বিরুদ্ধে অসমযুদ্ধে এক এবং একমাত্র হাতিয়ার! সেই বার্তা সর্বস্তরে ছড়িয়ে দিয়ে তারা বলেছেন, রাস্তার হিম্মতের লড়াই একদিন গুঁড়িয়ে দেবে তথাকথিত সংখ্যাগরিষ্ঠতার বর্বর তাণ্ডবকে!

গত ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২১ কৃষক আন্দোলনের ২৯৫তম দিনে সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা ‘ভারত বন্ধ’-এর ব্যাপারে এক প্রেস বিবৃতিতে জানিয়েছে-এই বন্ধ হবে স্বতঃস্ফূর্ত ও শান্তিপূর্ণ। সকাল ৬টা থেকে বিকেল ৪টে পর্যন্ত। উদ্দেশ্য - কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের সমস্ত অফিস, স্কুল কলেজ ও অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, দোকান-বাজার ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন ধরনের সরকারি ও বেসরকারি গণপরিবহন, সরকারি কাজকর্ম ও অনুষ্ঠান বন্ধ করা। তবে অত্যাবশ্যক জরুরি পরিষেবা সংক্রান্ত সবকিছু বন্ধের আওতার বাইরে থাকবে। জনসাধারণের কাছে বন্ধের বার্তা যথেষ্ট আগে নিয়ে যেতে হবে যাতে তাদের কোনো অসুবিধা না হয়।

বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, কৃষক আন্দোলনের ধারাবাহিকতা ও তীব্রতর হয়ে ওঠা বিজেপিকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। তারা সঙ্গত দাবিগুলি মেনে নিলেই সমস্যা মিটবে। তার আগে নয়। হরিয়ানা সরকার সুপ্রিম কোর্ট ও জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের নির্দেশে অতিরিক্ত মুখ্যসচিবকে শীর্ষে রেখে পুলিশ আধিকারিকদের নিয়ে এক কমিটি তৈরি করেছে। সোনপাতের জেলাশাসক এস কে এম-এর নেতাদের নিয়ে মুর্থালে এক বৈঠক ডেকেছেন। লক্ষ লক্ষ কৃষক দিল্লি সীমান্তে প্রতিবাদ অবস্থানে রয়েছেন নিজেদের ইচ্ছায় নয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক ও অন্যান্য রাজ্যের পুলিশ তাদের এখানে থাকতে বাধ্য করেছে। কৃষকরা ভারী বৃষ্টি-বন্যা, জ্বালা ধরানো গ্রীষ্ম ও কড়া ঠাণ্ডার মাসগুলো সেখানে অত্যন্ত কষ্টে অতিবাহিত করেছেন। এ পর্যন্ত ৬০০-রও বেশি কৃষক শহীদ হয়েছেন। তারা এই তীব্র কষ্ট ভোগ করেও আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন — তাদের জীবিকা, উৎপাদনের প্রাথমিক সম্পদ আর তাদের আগামী প্রজন্মগুলির ভবিষ্যৎ রক্ষা করার জন্য। সরকারের ঔদ্ধত্য ও একগুঁয়েমি কৃষকদের বাধ্য করছে সীমান্তে প্রতিবাদ জারি রাখতে।

সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা আগামী ২৪ সেপ্টেম্বর প্রকল্প কর্মীদের সর্বভারতীয় ধর্মঘটকে সক্রিয় সমর্থন জানাচ্ছে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এই প্রকল্প কর্মীরা (অঙ্গনওয়াড়ি, আশা, মিড ডে মিল, এনসিএলপি, এসএসএ, এনএইচএম) তাদের জীবিকার নিয়মিতকরণ, শ্রমিকের মর্যাদা, ন্যূনতম মজুরির দাবিতে লড়ছেন। সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা মনে করে, এই প্রকল্পকর্মীরা যারা প্রত্যন্ত গ্রামে পর্যন্ত পুষ্টি স্বাস্থ্য পরিচর্যা, শিশু পরিচর্যা, শিক্ষা সংক্রান্ত অত্যন্ত জরুরি প্রাথমিক পরিষেবা দিয়ে চলেছেন, তারা মূলত মহিলা এবং ভয়ঙ্করভাবে শোষিত। শুধু তাই নয়, তারা কোভিডের সামনের সারির যোদ্ধা, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে চলেছেন। তাদের সংগ্রামে পূর্ণ সংহতি জানায় এসকেএম।

বিবৃতিতে আরও জানানো হয়েছে, উত্তরপ্রদেশ বিজেপির পরিকল্পিত ‘কিসান সম্মেলন’ রাজ্যের কৃষকদের বোকা বানাতে পারবে না। তারা কালা কৃষি আইন বাতিল করা ও ন্যূনতম সহায়ক মূল্য সুনিশ্চিত করার আইন লাগুক করার দাবিতে রাজ্য জুড়ে বড় বড় সমাবেশ করছেন।

বিবৃতিতে আরও জানানো হয়েছে, বিভিন্ন রাজ্যে কৃষক আন্দোলনকে শক্তিশালী করা ও ২৭-এর বন্ধকে সফল করার জন্য নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

বিবৃতির শেষে সমাজ সংস্কারক ও ‘দ্রাবিড় আন্দোলনের পিতা’ পেরিয়ার ই ভি রামস্বামীর জন্মদিবস উপলক্ষে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে বলা হয়েছে তাঁর আত্মমর্যাদা আন্দোলন এবং জাতি বর্ণ পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে সামাজিক ন্যায় বিচারের সফল সংগ্রাম বর্তমান প্রজন্মকেও গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করে।

What to say_0

শৈশব-কৈশোর কাল নিয়ে আমাদের সরকার বাহাদুরের মুখে শোনা যায় কত শত রাশভারী কথা। তা সে প্রধানমন্ত্রী মোদীর ‘মন কা বাত’ হোক বা ‘সবকা সাথ সবকা বিকাশ’-কথা, অথবা অন্য কোনও উপলক্ষে হোক, কথায় কোনও কার্পণ্য করা হয় না, চলে অজস্র কল্পকথার আসর। আর বাস্তবে করুণ পরিণতি হল, শৈশব-কৈশোর শিকার হয়ে চলছে চূড়ান্ত অনাদর, অবহেলা, অশিক্ষা, অপসংস্কৃতি, বিপথগামীতার।

ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর (এনসিআরবি) পেশ করা এক রিপোর্ট রীতিমতো হাড়হিম করে দেওয়ার মতোই। ঐ রিপোর্ট উল্লেখ করেছে, ২০০০ সালে তথ্য ছিল জুভেনাইল অপরাধে অভিযুক্তদের এক-তৃতীয়াংশেরই হয় শিক্ষাগত অবস্থা প্রাথমিক স্তরের নয়ত তারা নিরক্ষরতার শিকার। তাদের অর্থনৈতিক শ্রেণী-স্তরের নির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া সম্ভব না হলেও তারা যে হতদরিদ্র সব পরিবারের সন্তান সেটা নিশ্চিত বোধগম্যের। ২০১৯ সালের সংশ্লিষ্ট তথ্য ছিল, এদের ২৮ শতাংশ নিরক্ষর এবং ৪২ শতাংশের শিক্ষা স্তর দশম শ্রেণীর নিচে। অপরাধের অভিযোগে আটক জুভেনাইলদের ৬৬ শতাংশ, বিচারাধীনদের ৬৯ শতাংশ এবং সাজাপ্রাপ্তদেরও ৬৯ শতাংশ উপরোক্ত দুই বর্গের মধ্যেকার। সুযোগের প্রাদুর্ভাবের কারণে এদের শিক্ষাজীবনে অচিরেই ঘনিয়ে আসে আঁধার, আর তার পরিণতিতে স্কুল ছুট এবং অপরিণত চপল মস্তিষ্কে ন্যায়-অন্যায় বোধ লোপ পেয়ে অপরাধকর্মের হাতছানিতে জড়িয়ে যাওয়া হয়। একবার অপরাধী সাব্যস্ত হলে ও সাজাজীবন ভোগ করলে হতাশায় বিরক্তিতে রাগে ক্ষোভে আর সুমতিতে ফেরা হয়ে ওঠে না। বিচারের সুযোগলাভের প্রশ্নে ধরা পড়ে তীব্র শ্রেণী বৈষম্য। যারা সম্পন্নশালী অংশের তারা প্রয়োজনীয় ব্যয়বহুল বেসরকারি আইনী সাহায্যের সংস্থান করে নিতে পারে, সেই সুবাদে সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে পারে; অন্যদিকে যারা গরিব বা গরিবতম অংশের তাদের পক্ষে ভালো আইনি সহায়তা পাওয়া সম্ভব হয় না, শাস্তির দুর্ভোগ পোহাতে হয়। ‘পকসো’ আইনের ৪০ ধারায় বলা আছে, অভিযুক্ত শিশু/বালক/কিশোরের অভিভাবক বা পরিবারের লোকজনদের অধিকার রয়েছে সরকারি কৌসূলীদের মধ্যে থেকে পছন্দের আইনজীবী চয়নের, কিন্তু কার্যত সে সুযোগ মেলে না। সুবিচারের দাবি নথিবদ্ধ করার ক্ষেত্রেও শ্রেণী বৈষম্য থাকে।

অশেষ দুর্গতির এই ধারা এই দেশে এই রাজ্যে চলে আসছে বহুকাল যাবত। ২০১৯ পর্যন্ত স্কুল পড়ুয়াদের কিছু কিছু তথ্য হল, এক-তৃতীয়াংশের ছেদ ঘটে যায় প্রাথমিক স্তরে, অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত টিকে থাকে ৬ থেকে ১৪ বছর বয়সীদের ৩৫ মিলিয়ন, স্কুলে যায় উপরোক্ত সমবয়সীদের অর্দ্ধেকাংশেরও কম। আর ৫ থেকে ৯ বছরের মেয়েদের ৫৩ শতাংশ রয়ে গেছে নিরক্ষর। ‘ইউনিসেফ’-এর নিদান আছে, প্রত্যেক অপ্রাপ্তবয়সী সন্তানদের শিক্ষার অধিকার কার্যকরি করতে হবে। অন্যদিকে ২০২০-২১-এর একটানা অতিমারী সময়ে লাগাতার শিক্ষালয় বন্ধ রাখার পরিণামে অবস্থাটা এক মারাত্মক আকার নিয়েছে। মূলত দুভাবে — খেটে খাওয়া মানুষের অর্থনৈতিক চূড়ান্ত ভগ্নদশা ঘটেছে আর তাদের ছেলেমেয়েদের স্কুল শিক্ষাঙ্গনছুট হয়ে গেছে। কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকার যদি পরিবারপিছু এককালীন কয়েক হাজার টাকা অর্থসাহায্য আর মিড ডে মিল সহ বিকল্প শিক্ষাব্যবস্থা করতে আন্তরিক হত তাহলে একটা প্রজন্মের ভিত এভাবে উত্তরোত্তর ক্ষতিগ্রস্ত হত না। শিক্ষাবিদদের অনেকে যেমন আরও সাবধানতার সাথে আরও রয়েসয়ে স্কুলশিক্ষা ফের শুরুর কথা বলেছেন, তেমনি শিক্ষক-অশিক্ষক অনেকে তুলেছেন বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণের ভাবনা এবং সক্রিয় হয়েছেন তার সাধ্যমতো রূপায়ণে। সমাজের প্রতিনিধিরা যে স্পর্ধা, যে উদ্ভাবনী চিন্তা, নিজেদের উজার করে দেওয়ার যে মন-মানসিকতা রাখতে পারে; সরকারপক্ষ তা রাখতে পারে না কেন, রাখে না কেন? এ কি সহ্য করা যায়! এর কি কোনও মার্জনা হয়!

anti-CAA protesters

এক বছরের বেশি হয়ে গেল দিল্লীর সিএএ-বিরোধী প্রতিবাদকারিরা জেলে আছেন। তাঁরা যে দাঙ্গার শিকার সেই দাঙ্গারই কারিগর হিসেবে তাঁদের অন্যায়ভাবে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এই বন্দিদের মধ্যে যেমন আছেন বিশাল সংখ্যক মুসলমান আন্দোলনকারি ও মুসলমান পেশাজীবী, তেমনই আছেন বহু শ্রমিক যারা সিএএ-বিরোধী আন্দোলনকারিদের বিভিন্ন ধরনের সরঞ্জাম সরবরাহ করেছিলেন। ইতিমধ্যে দিল্লি হিংসার প্রকৃত অপরাধিরা — বিজেপি নেতারা যারা ভিড় জমিয়ে মুসলমানদের ওপর আক্রমণ চালানোর উসকানি দিয়েছিল, তারা — বেমাসুল ছাড়া পেয়ে গেছে।

এই গত মাসেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক, যাদের অধীনে দিল্লি পুলিশ চলে, দিল্লি পুলিশকে পুরস্কার দিয়েছে দিল্লী দাঙ্গার তদন্তে পুলিশের “এক্সেলেন্ট” কাজের জন্য। এর সমুচিত এক জবাব দিল্লীর সেশন আদালতের এক রায়ের মাধ্যমে এসেছে। দাঙ্গা-অভিযুক্ত তিনজন মুসলমান পুরুষকে জামিন দিয়ে এই রায় দিল্লী পুলিশের তদন্তকাজকে “তদন্ত করার কোনও প্রকৃত ইচ্ছাই নাই, কেবল করদাতাদের কষ্টার্জিত অর্থের অপচয়” বলে ভর্ৎসনা করেছে। তার ফলে, ওই রায়ে বলা হচ্ছে, “অভিযুক্ত ব্যক্তিরা যাদের বহু মামলায় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে তারা সব জেলে পচছেন”। অতিরিক্ত সেশন জাজ বিনোদ যাদব আই বি কর্মচারি অঙ্কিত শর্মার হত্যার দায়ে অভিযুক্ত শাহ আলম, রশিদ সাইফি ও শাদাবকে জামিন দিয়ে বলেন, “ইতিহাস যখন দেশভাগ পরবর্তী সময়ের সবচেয়ে কদর্য এই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার দিকে ফিরে তাকাবে তখন … সঠিকভাবে তদন্ত চালাতে তদন্তকারি সংস্থাগুলোর এই ব্যর্থতা … অবশ্যই গণতন্ত্রের প্রহরিদের যন্ত্রণা দেবে”।

অ্যাডিশনাল সেশন জাজ (এএসজে) দিল্লি পুলিশকে অভিযুক্ত করেছে “আদালতের চোখে ধূলো দেওয়ার চেষ্টা” করার এবং এমনকি জালিয়াতি করে প্রমাণ প্রতিস্থাপন করার। অন্যান্য সেশন কোর্টও বিগত কয়েক মাসে একই ধরনের পর্যবেক্ষণ বারবার ব্যক্ত করেছে। দিল্লি পুলিশের দাঙ্গা-তদন্তকে এরকম ধিক্কার সহ অভিযুক্ত করা অমিত শাহের নেতৃত্বাধীন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রককেই কাঠগড়ায় দাঁড় করায় যাদের “তদন্ত” আসলে দাঙ্গার হিংসা ও অবিচারকেই অন্য কায়দায় চালিয়ে যাওয়ার নামান্তর।

নির্দিষ্ট এই মামলাটির ক্ষেত্রে অ্যাডিশনাল সেশন জাজ জামিন মঞ্জুর করতে পারলেন কারণ তিনি তথ্যপ্রমাণ খতিয়ে দেখে চরম গরমিল ও দুর্বলতা পেয়েছেন। কিন্তু যদি এটি ইউএপিএ মামলা হত তাহলে বিচারক কেবলমাত্র অভিযোগগুলিই দেখতে পেতেন, তথ্যপ্রমাণ খতিয়ে দেখার এক্তিয়ার তাঁর থাকত না। এই একই বিচারক, এএসজে বিনোদ যাদব, উমর খলিদকে এপ্রিল ২০২১-এ জামিন দিয়ে বলেছিলেন, “এই মামলায় এই ধরনের ভাসাভাসা ম্যাটেরিয়ালের ভিত্তিতে আবেদনকারিকে কারাগারে আটকে রাখা চলে না”। তবুও উমর কারাগারে আছেন কারণ দিল্লি পুলিশ তাদের পক্ষপাতদুষ্ট ও হীন তদন্তকার্যের আড়াল হিসেবে ইউএপিএ ব্যবহার করেছে।

দিল্লি পুলিশের তদন্তকার্য এক হীন ধোঁকাবাজি ছাড়া আর কিইবা হতে পারত? ২০২০-র ফ্রেব্রুয়ারিতে যখন দিল্লীর বুকে মুসলমান-বিরোধী নিষ্ঠুর হত্যালীলা চলছিল তখনই দিল্লী হাইকোর্টের বিচারক মুরলীধর দিল্লী পুলিশকে চেপে ধরেছিল বিভিন্ন বিজেপি নেতাদের হিংস্র উসকানির বিষয়ে না জানার ভাণ করায়। তিনি মিশ্র, ঠাকুর ও এমএলএ অভয় বর্মা (যারা “গোলি মারো শালোকো” বলে ভিড়কে নেতৃত্ব দিচ্ছিল) এবং পরবেশ বর্মার (যে শাহিনবাগের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদিদের ‘রেপিস্ট ও মার্ডারার’ বলেছিল) বক্তব্যের ভিডিও ক্লিপ আদালতে চালাতে বলেছিলেন যেহেতু পুলিশ দাবি করেছিল যে তারা সেগুলো দেখেনি ও জানে না। হিংসা থামাতে তিনি ওইসব অপরাধিদের গ্রেপ্তার করার নির্দেশ দেওয়ার দিকেও এগোচ্ছিলেন, কিন্তু সলিসিটর জেনেরাল তুষার মেহতা বলে দেন “যথা সময়ে এফআইআর করা হবে” (কপিল মিশ্র ও অন্যান্যদের বিরুদ্ধে)। বিচারক মুরলীধর প্রশ্ন করেছিলেন, “কোনটা যথাযথ সময়? নগর জ্বলে শেষ হয়ে যাওয়ার পর?” কিন্তু ওই সময়ই বিচারক মুরলীধরের বদলির অর্ডার নামিয়ে আনা হল এবং চলমান দাঙ্গা থামানোর সকল দায়িত্ব-কর্তব্যও বুঝিবা তার সাথে সাথে দিল্লী হাইকোর্ট চত্বর থেকে বিদায় নিল।

সেশন কোর্টের রায় উন্মোচিত করে দিয়েছে পুলিশ/স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের “টুলকিট” : সুপরিচিত বিজেপি নেতারা যে উসকানি দিয়ে ভিড় জমিয়ে দাঙ্গাকারিদের নেতৃত্ব দিয়েছিল তার অজস্র জাজ্বল্যমান তথ্যপ্রমাণ থাকলেও তা থেকে চোখ ফিরিয়ে রাখো; নিরপরাধ ব্যক্তিদের ফাঁসাতে প্রমাণ ঢুকিয়ে দাও, সাক্ষী সাজাও; তারপর ইউএপিএ ব্যবহার করে আদালতকে সেইসব তথ্যপ্রমাণের প্রকট গরমিল যাচাই করা থেকে দূরে রাখো এবং সেই নিরপরাধ ব্যক্তিদের ছাড়া পাওয়া বন্ধ করো; এবং শেষে, নতুন নতুন অনুপূরক চার্জশীট পেশ করে যাও যাতে বিচার ক্রমাগত পিছিয়ে যেতে থাকে।

এখন যখন আদালতগুলি দিল্লী পুলিশের “দাঙ্গা তদন্ত”-কে সুস্পষ্ট ভাষায় অভিহিত করেছে প্রতিবাদকে “সন্ত্রাসবাদ”-এর সমান করে দেওয়ার এবং সময় নষ্ট করার অপচেষ্টা হিসেবে, তখন এই অবিচারের অন্ত ঘটাতে, গ্রেপ্তার হওয়া বন্দিদের মুক্ত করতে এবং দাঙ্গার তদন্তকাজ আদালতের তত্ত্বাবধানে চালাতে বিচার বিভাগের উচ্চতর স্তর থেকে হস্তক্ষেপ অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে।

(এম এল আপডেট, সম্পাদকীয়, ১৪ সেপ্টেম্বর' ২১)

support price guarantee

এ রাজ্যে কৃষকের ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য গ্যারান্টির জন্য এক সরকারি কমিশন গঠনের দাবি জানিয়েছে এআইকেএসসিসি। যার নাম হবে “রাজ্যের কৃষকদের কৃষিজাত ব্যয় ও লাভজনক মূল্য গ্যারান্টি কমিশন” (স্টেট ফার্মার্স এগ্রিকালচারাল কস্ট এ্যান্ড রেমুনারেটিভ প্রাইস গ্যারান্টি কমিশন)।

এই কমিশনের চেয়ারপার্সন হবেন একজন কৃষক যিনি কৃষি অর্থনীতি ও কৃষি বিষয়ক বিষয়গুলিতে সুশিক্ষিত এবং অভিজ্ঞ। কমিশনে থাকবেন ৫ জন কৃষক প্রতিনিধি যার মধ্যে কৃষক সংগঠনের প্রতিনিধিরা থাকবেন। এছাড়াও থাকবেন মহিলা কৃষক প্রতিনিধি। এদের কৃষক ইস্যুতে কাজ করার অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান থাকতে হবে। ৩ জন কৃষি বিশেষজ্ঞ থাকবেন। কৃষি, কৃষি বিপণন, উদ্যানপালন, পশুপালন ও মৎস্য দপ্তরের ৪ জন আধিকারিক ও পূর্ণ সময়ের একজন সদস্যসচিব থাকবেন, যিনি হবেন কৃষি বিপণন দপ্তরের ডেপুটি সেক্রেটারী পদমর্যাদার একজন আধিকারিক।

সারা ভারত কিষাণ সংঘর্ষ সমন্বয় সমিতির পক্ষ থেকে এ বিষয়ে রাজ্যের মূখ্যমন্ত্রীকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এআইকেএসসিসি দ্বারা প্রস্তুত লাভজনক ন্যুন্যতম সহায়ক মূল্য (এমএসপি) গ্যারান্টি আইনের খসড়া পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। এআইকেএসসিসি-র পক্ষ থেকে বলা হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ কৃষি নির্ভর রাজ্য এবং কৃষিই রাজ্যের অর্থনীতির মূল ভিত্তি। প্রত্যক্ষ ও অপ্রত্যক্ষভাবে কৃষির ওপরেই অধিকাংশ মানুষ নির্ভরশীল। রাজ্যের প্রায় ৬৮ শতাংশ ভূমি কৃষি কাজে ব্যবহৃত হয় এবং ৬ শতাংশের বেশি মানুষ কৃষির সাথে যুক্ত। রাজ্যের জিডিপি’র ২৭ শতাংশই আসে কৃষিক্ষেত্র থেকে।

কিন্তু সারা দেশের মতো পশ্চিমবঙ্গের কৃষকরা ভালো বিনিয়োগ ও ভালো ফলন সত্বেও পর্যাপ্ত আয় করতে পারছে না। তাই তাদের অবস্থার ক্রমাগত অবনতি ঘটছে। কৃষির খরচ ক্রমশ বেড়ে গিয়ে সেটা কৃষকদের স্বল্প সঙ্গতির বাইরে চলে যাচ্ছে। কৃষকরা তাদের কৃষিজাত উৎপাদনের জন্য যে দাম পাচ্ছে তার থেকে উৎপাদন খরচ বাদ দিলে যে আয়, তা দিয়ে পরিবারের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করতে পারছে না। এই দুর্দশার জন্য রাজ্যের কৃষক এবং কৃষি শ্রমিকরা দেনার জালে জড়িয়ে পড়ছে এবং আত্মহত্যার পথে যেতে বাধ্য হচ্ছে।

Reject the BJP

গত ১৬ সেপ্টেম্বর এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের পক্ষ থেকে রাজ্য সম্পাদক অভিজিৎ মজুমদার বলেছেন —

১) আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর রাজ্যের ৩টি বিধানসভা কেন্দ্র, ভবানীপুর, জঙ্গিপুর ও সামসেরগঞ্জের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। রাজ্যের বাকি ৪টি বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচন কেন হবে না, তার কোনও সদুত্তর কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে এখনও পাওয়া যায়নি। একইভাবে দীর্ঘ সময় ধরে বন্ধ হয়ে আছে পৌর নির্বাচনও। রাজ্য নির্বাচন কমিশন নিরুত্তর। আমরা এই নির্বাচনগুলি দ্রুত সম্পন্ন করার দাবি জানাই।

২) ২০২১ এর বিধানসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতা দখলের জন্য বিজেপির কেন্দ্রীয় ও রাজ্য নেতৃত্ব মরিয়া চেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ হয়েছে। রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ বিজেপির আগ্রাসী সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে পরাজিত করার পর‌ও বিজেপি এই পরাজয় মেনে নিতে পারেনি। কেন্দ্রের সমস্ত প্রতিষ্ঠানকে কাজে লাগিয়ে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে অগ্রাহ্য করে রাজ্যে হস্তক্ষেপ করার চেষ্টার পাশাপাশি হিংসা বিশৃঙ্খলা ও সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তৈরি করার লাগাতার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

৩) দীর্ঘ দশ মাসব্যাপী হাজারো হাজারো কৃষক কর্পোরেট স্বার্থবাহী তিনটি কৃষি আইনের বিরুদ্ধে অবস্থান বিক্ষোভ প্রতিবাদ চালিয়ে যাচ্ছেন। শ্রমিকদের‌ অধিকার থেকে বঞ্চিত করে দাসে পরিণত করতে কেন্দ্রের সরকার চারটি শ্রম কোড তৈরি করেছে। একদিকে বেকারত্ব ও অন্যদিকে মূল্যবৃদ্ধির জ্বালা, সরকারি সম্পত্তি কর্পোরেটের হাতে তুলে দিতে নয়া পাইপলাইন, গণতন্ত্র হরণের সর্বশেষ উদাহরণ হিসাবে বিরোধী ও বামপন্থীদের উপর ত্রিপুরায় হামলা, লুঠতরাজ ও অফিসে অগ্নিসংযোগ সকলের চোখের সামনেই ঘটে চলেছে। এসবের বিরুদ্ধেই আগামী ২৭ সেপ্টেম্বর ভারত বনধ্। রাস্তার এই লড়াইকে ব্যালটেও প্রতিফলিত করতে হবে।

৪) এই প্রেক্ষাপটে রাজ্যের তিনটি বিধানসভা কেন্দ্রে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে চলেছে। তৃতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর রাজ্যের জনগণের বুনিয়াদি দাবির প্রতি তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের ভূমিকা মোটেই সন্তোষজনক নয়। জনগণের গণতন্ত্র, জীবন-জীবিকা, স্বাস্থ্য, শিক্ষার প্রশ্নগুলি অবহেলিতই থেকে যাচ্ছে। এসবকে কাজে লাগিয়ে বিজেপি ফয়দা তুলতে চাইছে। আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। আমরা সংশ্লিষ্ট বিধানসভা কেন্দ্রগুলির নির্বাচকমন্ডলীর কাছে আবেদন জানাচ্ছি যে, বিজেপিকে পরাস্ত করতে আপনার মূল্যবান ভোটাধিকার প্রয়োগ করুন।

detention camps

ভরা বর্ষা ও বন্যার মরশুমে, এই মহামারীর পরিস্থিতিতে, আসামের দারাং ও চর-চাপরি এলাকার শত শত পরিবারকে (প্রায় পুরোটাই পূর্ববঙ্গ উৎসের মুসলমান) আপন ভিটেমাটি থেকে নিষ্ঠুরভাবে উচ্ছেদ করা হয়েছে। বিজেপি সরকার এই ধরনের ধারাবাহিক উচ্ছেদ অভিযান চালাচ্ছে। “বেআইনি অভিবাসীরা দখল করে ছিল” তকমা দিয়ে সাম্প্রদায়িক ও বিদেশী-বিদ্বেষমূলক প্রচারাভিযান চালিয়ে এই উচ্ছেদ শুরু করেছে বিজেপি সরকার। জুন-আগষ্টে এরকম ২৫৯টি পরিবারকে উচ্ছেদ করা হয়েছিল। ২০ সেপ্টেম্বর ২০০ পরিবারকে উচ্ছেদ করা হল দারাং জেলার ফুহুরাতলি থেকে। তাদের কুঁড়েঘরগুলি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। এই পরিবারগুলি সকলেই পূর্ববঙ্গ উৎসের মুসলমান পরিবার এবং বহু প্রজন্ম ধরে তাঁরা আসামে বসবাস করছেন। উচ্ছেদের মাত্র একদিন আগে তাঁদের নোটিশ দেওয়া হয়। কোনও রকম পুনর্বাসনের ন্যূনতম সাহায্য তাঁদের দেওয়া হয়নি। চারটি মসজিদকেও “বেআইনি” ঘোষণা করা হয় এবং বুলডোজ করা হয়। এভাবে প্রকাশ্যেই সাম্প্রদায়িক উদ্দেশ্য জাহির করা হয়।

২০১৯ সালে আসামের ব্রহ্ম কমিটির রিপোর্ট ও ভূমিনীতি সাম্প্রদায়িক ও জাতিগত নিশানার এই উচ্ছেদ-নীতির রাস্তা তৈরি করেছে। এই কমিটি চর এলাকার জমিকে “বেআইনি অভিবাসীদের” দখলিকৃত তকমা দিয়ে চরের জমি “আসামের আদি বাসিন্দাদের” মধ্যে পুনর্বন্টনের প্রস্তাব দেয়। “আদি বাসিন্দা” কারা সে বিষয়ে অবশ্য সরকারের কোনও স্পষ্ট সংজ্ঞা নেই এবং যথেষ্ট আশঙ্কা আছে যে তা নির্দিষ্ট জাতি-উৎস ও ধর্মীয় পরিচিতির মানুষদের বাদ দিয়ে দেবে।

ইতিমধ্যে বিহারে পাটনা হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ “বেআইনি অভিবাসি” ধুয়ো তুলতে শুরু করেছে এবং বিহার সরকারকে আদেশ দিয়েছে একটি স্থায়ী ডিটেনশন ক্যাম্প বানাতে আর ডিজিটাল ও প্রিন্ট মিডিয়া ব্যবহার করে রাজ্যের বাসিন্দাদের সতর্ক করতে ও “বেআইনিভাবে বসবাসকারি বিদেশীদের” বিরুদ্ধে খবর দেওয়ার কাজ করার জন্য উৎসাহিত করতে। এরকম আদেশ রাজ্যের সাম্প্রদায়িক সংহতির পক্ষে বিপজ্জনক। এই আদেশ বিহারের মানুষকে পরস্পরের প্রতি সন্দিহান ও আতঙ্কিত করে তুলবে এবং ধর্মীয় ও ভাষিক সংখ্যালঘুদের প্রতি বিদ্বেষ ছড়িয়ে দেবে।

তাছাড়া, পাটনা হাইকোর্টের এই রায়ের কোনও তথ্যগত ভিত্তিও নেই। বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়ে আসা একজন মহিলা ভারতে থাকার ও নিরাপদ জীবনযাপন করার অনুমতি চেয়ে আদালতে আবেদন জানিয়েছিলেন। সেই মামলার শুনানির সময় এই আদেশ দেওয়া হয়েছে। নারী পাচারের শিকার হওয়া এই মহিলাকে ফেরৎ পাঠায় আদালত। এবং নারী পাচারের এই মামলাকেই ব্যবহার করে “বিদেশিরা বেআইনিভাবে ভারতে আসতে চাইছে” বলে। এমনকি বিহারের এনডিএ সরকারও গত জানুয়ারি মাসে আদালতে হলফনামা দিয়ে জানিয়েছে যে রাজ্যে সাকুল্যে ৩৮ জন অনথিভুক্ত “বিদেশী” রয়েছে যাদের অধিকাংশই নেপাল থেকে আসা এবং তারা জেলে বা রাজ্যের রিমান্ড হোমে আছে। এতদসত্ত্বেও সীমান্তবর্তী কিষানগঞ্জ জেলার জেলা কর্তৃপক্ষ বিহার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের একটি চিঠির উল্লেখ করে বৈদ্যুতিন ও ছাপা মাধ্যমে তাদের তীব্র “জন সচেতনতা” অভিযান ও “বেআইনি অভিবাসিদের ফেরৎ পাঠানোর কাজে উৎসাহী জনমুখী ব্যক্তি ও এনজিওদের সংযুক্ত করা”-কে বৈধতা দিতে চাইছে। আসলে সীমাঞ্চলের মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিন্দুদের লেলিয়ে দেওয়ার কাজে বহুবিধ আরএসএস গ্যাং-কে ছাড়পত্র দিতেই এরকম পরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছে।

ডিটেনশন ক্যাম্পও সাম্প্রদায়িক নিশানায় উচ্ছেদ করতে বিজেপির ফ্যাসিস্ট পরিকল্পনার অঙ্গ যা সারা ভারতেই মুসলমানদের নাগরিকত্ব, জমি ও জীবিকার অধিকার কেড়ে নিয়ে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের অভ্যন্তরে মরাবাঁচার ভবিতব্যে তাঁদের নিক্ষেপ করতে চায়। ভারতে গণতন্ত্র ও সমতা সুরক্ষিত করতে নিবেদিতপ্রাণ সমস্ত ভারতীয়কে অবশ্যই সর্বশক্তি দিয়ে এই ফ্যাসিস্ট পদক্ষেপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে হবে।

(সিপিআই (এমএল) লিবারেশন কেন্দ্রীয় কমিটির বিবৃতি,

২১ সেপ্টেম্বর ২০২১)

National resource

১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২১

অনাদায়ী ঋণের সমাধান হিসেবে জাতীয় সম্পদ পুনর্গঠন (ন্যাশনাল এ্যাসেট রিকনস্ট্রাকশন) কোম্পানি লিমিটেড (এনএআরসিএল) কর্তৃক ইস্যুকৃত ৩০,৬০০ কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণপত্রের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক দেয় নিশ্চয়তার (গ্যারান্টির) মন্ত্রীসভার অনুমোদন আসলে জনগণকে বিভ্রান্ত করে কতিপয় পুঁজিপতিদের তল্পিবাহক সরকারের স্যাঙাতদের সুবিধা প্রদানের নীতির একটি মুখোশ এবং আমানতকারী ও করদাতাদের অর্থের অপব্যয়।

সরকার দাবি করছে যে ব্যাঙ্ক সমূহের উদ্বর্ত্য পত্র (ব্যালান্স শিট)কে পরিচ্ছন্ন করার জন্য স্বীকৃতি (রেকগনিশন), সমাধান (রেজোলিউশন), পুনর্মূলধনীকরণ (রিক্যাপিটালাইজেশন) এবং সংস্কার (রিফর্ম) এর “চার র রণনীতি” প্রয়োগ করা হচ্ছে। অর্থমন্ত্রী বলেছেন যে, ওই পরিকল্পনার ফলে ব্যাঙ্কগুলি গত ৬টি অর্থ বছরে ৫,০১,৪৭৯ কোটি টাকা পুনরুদ্ধার করেছে। সরকার যে বিষয়ে নিশ্চুপ তা হল যে, ওই ৬ বছরে ১৮,২৮,৫৬৪ কোটি টাকার বিপুল অর্থ অনুৎপাদক সম্পদ হিসেবে যুক্ত হয়েছে ও ৬,৮৩,৩৮৮ কোটি টাকা অশোধ্য ঋণ হিসেবে খাতা থেকে মুছে দেওয়া হয়েছে। ঋণের “দ্রুত পুনরুদ্ধার”এর পরিবর্তে আমরা যা পেয়েছি তা হল দ্রুত ঋণ মুছে দেওয়ার নীতি। এছাড়াও রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে ৩ লক্ষ কোটি টাকার মূলধন যোগান দেওয়া হয়েছে ওই সময়কালে। যদি মোদি জমানার প্রথম ৬ বছরের মোট অনুৎপাদক ঋণের বার্ষিক সংযুক্তি, ঋণ মুছে দেওয়া, এবং পুনর্মূলধনীকরণের পরিমাণ একত্রে যোগ করা হয় তাহলে আমানতকারী ও করদাতাদের অর্থের অপব্যয় দাঁড়াবে ২৮ লক্ষ কোটি টাকার বিপুল অঙ্কে যা আমাদের জিডিপির ১৪ শতাংশের মতো।

প্রদেয় ঋণ বকেয়া রাখার জন্য কোনও রকম সাজা না দিয়ে বকেয়া ঋণের বোঝা বহন করতে জনগণকে বাধ্য করার আশ্বাস দিয়ে ঋণ গ্রহীতাদের প্রতি সরকার কী ধরনের বার্তা দিতে চাইছে ও কী ধরনের ঋণ-সংস্কৃতিকে লালন করতে চাইছে? মনে রাখুন, সাধারণ কৃষক, নারী ও গরিবরা ক্ষুদ্র ঋণ বকেয়া রাখলে কীরকম গণ-অপমান ও হয়রানির শিকার হয় – যেখানে অতিধনী ঋণখেলাপিদের পরিচয় গোপন রাখা হয় ও তাদের বকেয়া ঋণের দায় জনগণকে বহন করতে হয়।

ওই সমস্ত ঋণ-দায় থেকে মুক্তি প্রাপ্ত সুবিধেভোগীরা হয় সরকারের প্রিয সাঙাত বা অসাধু ঋণগ্রহীতা যাদের পরিচয় সরকার লুকিয়ে রেখেছে। কিন্তু এটি পরিষ্কার যে যখন আন্তর্জাতিক বেসেল মান অনুযায়ী যথোপযুক্ত মূলধন বজায় রাখার জন্য মূলধন ঢালতে হয়, ব্যাঙ্কের সাধারণ আমানতকারী ও সাধারণ করদাতাদের সেই ভার বহন করতে হয়।

তর্কের খাতিরে যদি মেনে নেওয়া যায় যে জনগণের অর্থ ব্যবহার করে ব্যাঙ্কের ব্যালান্স শীট পরিস্কার করার ক্ষেত্রে সরকারের প্রকৃত উদ্দেশ্য হল জনস্বার্থে অতীতের খারাপ ঋণপ্রদানকে শুধরে নেওয়া, তাহলে সরকার কেন পরিষ্কারভাবে অনেকের আশঙ্কাকে নাকচ করতে এটা জানাচ্ছে না যে, চলমান সংযুক্তির পরে ব্যাঙ্কগুলিকে বেসরকারিকরণ করা হবে না? অনুরূপ সরাসরি বক্তব্য ব্যতীত এটি সন্দেহ করা যথাযথ যে ব্যালান্স শীট পরিষ্কার করার পিছনে প্রকৃত উদ্দেশ্য হল সরকারের প্রিয় সাঙাতদের কাছে ওই সমস্ত ব্যাঙ্ককে “পরিচ্ছন্ন অবস্থা”য় বিক্রি করে দেওয়া।

উপরন্তু, এনএআরসিএল কর্তৃক ইস্যুকৃত ৩০,৬০০ কোটি টাকার ঋণপত্রকে নিশ্চয়তা প্রদানের সরকারি সিদ্ধান্ত আসলে ব্যালান্স শীট বহির্ভুত একটি সাঙাত পুঁজির তল্পিবহনের বন্দোবস্ত কারণ এই নিশ্চয়তাগুলি বাজেটের “সারির নীচে থাকা” বিষয় যা রাজকোষ ঘাটতিকে বাড়াবে না।

আপাতভাবে, বেসরকারি লগ্নিপুঁজির মালিকানাধীন সম্পদ পুনর্গঠন সংস্থাগুলি (এআরসি) “খারাপ ঋণ”কে ব্যাঙ্কগুলির ব্যালান্স শীট পরিচ্ছন্ন করার জন্য কিনে নেয়। কিন্তু সেগুলি রদ্দি মালের দরে কেনা হয়। ফলে সেগুলির ব্যয়ভার ব্যাঙ্কগুলির (যাদের খারাপ ঋণ কেনা হয়) উপরে পড়ে এবং শেষমেশ তা সাধারণ আমানতকারীর ঘাড়ে চাপে। এমনকি এআরসিগুলির ইস্যুকৃত ঋণপত্রের জন্যও ‘সার্বভৌম নিশ্চয়তা’ দেওয়ার জন্য সরকারের অস্বাভাবিক প্রকরণ গ্রহণের ফলে অনাদায়ের ক্ষেত্রে সরকারি কোষাগারের উপরেই দায় চাপবে।

সিপিআই (এম-এল) কেন্দ্রীয় কমিটি

Gun-Shell Factory

কাশীপুর গান অ্যান্ড শেল ফ্যাক্টরিতে এলপিএফ, টিইউসিসি, এআইসিসিটিইউ'র সম্মিলিত প্রতিরক্ষা শিল্পের সর্বভারতীয় কর্মী ফেডারেশন এনপিডিইএফ, এআইডিইএফ, বিপিএমএস ও কনফেডারেশন অফ ডিফেন্স রেকগনাইজেড অ্যাসোসিয়েশনের যুক্ত উদ্যোগে ১৮ সেপ্টেম্বর এক গণ ভোটের আয়োজন করা হয়।

প্রতিরক্ষা শিল্পকে কর্পোরেশন করার প্রশ্নে জনমত যাচাইয়ের লক্ষ্যেই এই সম্মিলিত ট্রেড ইউনিয়ন উদ্যোগ। দেখা গেল, ২৩০১ কর্মী এই গণভোটে নিজের মতামত ব্যক্ত করেন। এর মধ্যে, ২২৯৭ কর্মীই কর্পোরেশনে পরিণত করার কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ভোট দেন। মাত্র ৪ জন কর্পোরেশনের পক্ষে মত ব্যক্ত করেন। অর্থাৎ, ৯৯.৮৩ শতাংশ ভোট পড়েছে কর্পোরেশনের বিপক্ষে।

চরম দমনমূলক প্রতিরক্ষা অধ্যাদেশ (যা এখন আইনে পরিণত হয়েছে) জারি করে মোদী সরকার কারখানার অভ্যন্তরে সমস্ত ধরনের প্রতিবাদী কন্ঠকে রুদ্ধ করার লক্ষ্যে যে দানবীয় আইন জারি করলো, তার বিপরীতে গিয়ে অভিনব পন্থায় জনমত যাচাইয়ের যে গণতান্ত্রিক পদ্ধতি যুক্ত ট্রেড ইউনিয়নগুলো করে দেখালো, তা প্রশংসার দাবি রাখে।

Deputation in Barasat

সংযুক্ত কিষান সভার ডাকা ২৭ সেপ্টেম্বর ভারত বনধের সমর্থনে এবং জেলার চটকল মজদুর, রন্ধন কর্মী এবং নির্মাণ শ্রমিকদের ৭ দফা দাবি নিয়ে ২১ সেপ্টেম্বর বারাসাত ও বারাকপুরে উত্তর ২৪ পরগনা জেলা এআইসিসিটিইউ'র অবস্থান ও ডেপুটেশন কর্মসূচী নেওয়া হয়েছিল। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বারাকপুরের কর্মসুচী বাতিল হয়ে যায়। বারাসাতে জেলা শাসকের কাছে স্মারক লিপি দেওয়া হয়।

পশ্চিমবঙ্গ সরকার সম্প্রতি ঘোষণা করেছে রাজ্যের চটকলগুলিতে এক লক্ষ লোক নিয়োগ করা হবে। এআইসিসিটিইউ সরকারের এই ঘোষণায় সন্তোষ প্রকাশ করে এই দাবি করছে যে বর্তমানে প্রতিটি মিলে হাজার হাজার শ্রমিক জিরো নম্বরে কাজ করেন। নতুন নিয়োগের ক্ষেত্রে এই সমস্ত দীর্ঘ দিন কাজ করা এবং একেবারেই অস্থায়ী, শ্রমিকদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। প্রতিনিধিদলের কাছে জানতে চাওয়া হয় এদের সংখ্যা কত এবং কেনই বা বিষয়টি ডিএলসি-তে আলোচ্য হবে না? প্রতিনিধি দলের পক্ষ থেকে বলা হয় নীতি নির্ধারণের প্রশ্নে সরকারকে দায়িত্ব নিতে হবে রাজ্যজুড়ে এবং জেলায় রন্ধন কর্মীদের এখনো ১২ মাসের সান্মানিক, পূজার সময়ে বোনাস বা উৎসব কালের অনুদান কোন কিছুই দেওয়া হচ্ছে না। প্রতিনিধি দলের নেত্রী এবং এআইসিসিটিইউ'র জেলা সহ সম্পাদিকা জয়শ্রী দাস উল্লেখ করেন যে রাজ্য সরকার বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে সাধারণ মানুষের জন্য রিলিফের ব্যবস্থা করছে কিন্তু রন্ধন কর্মীদের প্রতি কোনও মানবিক দৃষ্টি নেই। ২০১৩ সালের পর তাদের সান্মানিকের কোনও বৃদ্ধি ঘটেনি। অতিমারীর সময়েও রন্ধন কর্মীরা তাদের উপর ন্যস্ত দায়িত্ব পালন করেছেন কিন্তু তাদের ১২ মাসের সান্মানিক নিশ্চিত হচ্ছে না। ভাটপাড়া পৌর সভা অঞ্চলে ৫৩ জন রন্ধনকর্মীকে এখনো পর্য্যন্ত বকেয়া অনুদান দেওয়া হয়নি। ভাটপাড়া পৌর এলাকার স্কুলগুলিতে নো ওয়ার্ক নো পে চালু করতে চাইছে যা আইন বিরুদ্ধ। বোনাস আইনের ৮(১) ধারায় যখন বছরে ৩০ দিন কাজ করলে কোন একজন বোনাস পাওয়ার যোগ্য হন তাহলে একজন রন্ধনকর্মী বোনাস পাবে না কেন? নির্মাণ কর্মীদের জন্যই তৈরি করা ওয়েলফেয়ার ফান্ডের টাকা রাজ্য সরকারের আটকে রাখার নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয় এবং আবিলম্বে ফান্ড রিলিজ করার দাবি জানানো হয়। জেলা শাসকের তরফে ডেপুটি সেক্রেটারি জেলা পরিষদ স্মারকলিপি গ্রহণ করেন এবং আগামী ৭ দিনের মধ্যে জেলা শাসকের পদক্ষেপ আমাদের সংগঠনকে অবগত করানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা সত্বেও এদিনে অর্ধ শতাধিক রন্ধনকর্মী এবং নির্মাণ শ্রমিক বারাসাত স্টেশনে জমায়েত হয়ে মিছিল করে জেলাশাসকের দফতরে যান সেখানে সভা করা হয়। প্রতিনিধি দলে ছিলেন জয়শ্রী দাস সহ রন্ধন কর্মী ইউনিয়নের জেলা সম্পাদিকা সুলেখা বর্ধন, নির্মাণ ইউনিয়নের শংকর সাহা এবং এআইসিসিটিইউ সদস্য সুজিত ঘোষ।

 Jadavpur-Dhakuria

সংযুক্ত কৃষক মোর্চার ডাকে ২৭ সেপ্টেম্বর ভারত বনধ সফল করার লক্ষ্যে যাদবপুর-ঢাকুরিয়া এলাকায় সিপিআই(এমএল)-এর নেতৃত্বে প্রচার অভিযান চলছে। ২১ সেপ্টেম্বর যাদবপুরের পালবাজার ও সন্ধ্যাবাজারে প্রচারসভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় বক্তব্য রাখেন তমাল চক্রবর্তী, মানস ঘোষ, ঋতম মাজি ও স্নিগ্ধা বসু। বক্তারা কৃষক আন্দোলনের বীরত্বপূর্ণ লড়াইয়ের কথা তুলে ধরেন। মোদী সরকারের 'মনিটাইজেশন পাইপলাইন'-এর নামে দেশ বিক্রির চক্রান্তের বিরুদ্ধেও সরব হন। বনধ-এর দিন রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস কৃষকদের সপক্ষে মোদী সরকারের বিরুদ্ধে কি ভূমিকা নেয়, তা জনগনকে নজর রাখার আবেদন করা হয়। এলাকার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে বনধ সফল করার আহ্বান জানিয়ে হোর্ডিং লাগানো হয়েছে। প্রগতিশীল মহিলা সমিতি, এআইসিসিটিইউ ও সিপিআই(এমএল)-এর পক্ষ থেকে পোস্টারিং চলছে।

Jasbir Kaur Natt

৭ সেপ্টেম্বর টিকরি মোর্চার মঞ্চে সংযুক্ত কিসান মোর্চা এবং পাঞ্জাব কিসান ইউনিয়নের বর্ষীয়ান নেত্রী জসবীর কাউর নাট্-কে তাঁর নিজের গ্রাম বধাই (মুক্তাসর সাহিব জেলা)-এর গ্রাম পঞ্চায়েতের তরফে সরপঞ্চ বলকরণ সিং সম্মান প্রদর্শন করেন। পঞ্চায়েত সরপঞ্চ বলেন জসবীর কাউর নাট্ একজন মহিলা কৃষক নেত্রী, দিল্লী সীমান্তে অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে কৃষক আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য তাঁকে সম্মান প্রদর্শনে তাঁরা গর্বিত।

জসবীর কাউর ঐ সভায় পঞ্চায়েতসহ তাঁর সারা গ্রামকে ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন এই সম্মান প্রকৃতপক্ষে সেই মহিলাদের প্রাপ্য যাঁরা তাঁদের পরিবারের প্রতি দায়বদ্ধ থেকেও এবং বহু অসুবিধার সম্মুখীন হয়ে দিল্লীর আন্দোলনকে জয়ের লক্ষ্যে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। তিনি বলেন যতদিন না কৃষক আন্দোলন জয়লাভ করছে ততদিন তাঁরা দিল্লীর সীমানায় দৃঢ় থাকবেন। ৫ সেপ্টেম্বর মুজফ্ফরনগরের মহাপঞ্চায়েতের অভূতপূর্ব সাফল্য এটাই প্রমাণ করছে যদি কর্পোরেটের পুতুল মোদী সরকার কৃষক বিরোধী তিনটি কৃষি আইন প্রত্যাহার না করে তাহলে দেশের জনতা ভোটের মাধ্যমে এক চরম জবাব দেবে বিজেপিকে। এর ফলে যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক না কেন তাদের এই কর্পোরেটমুখী কৃষি আইন ছোঁয়ার সাহসও হবে না।

গ্রাম পঞ্চায়েত, কুলদীপ সিং ওরফে কীপা-কেও সম্মান প্রদর্শন করেন। এই কৃষক রমণী বিগত ন'মাস ধরে মোর্চার প্যান্ডেলে এবং লঙ্গরে করসেবা দিচ্ছেন। কুলদীপ সিং জসবীর কাউর নাটের তুতো বোন।

সম্বর্ধনা সভার শেষে জসবীর কাউর নাট্ অন্যান্য নেতাদের সঙ্গে টিকরি মঞ্চ সঞ্চালন সমিতি থেকে কারনালে সংযুক্ত কিসান মোর্চার আহ্বানে জেলা সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচিতে অংশ গ্রহণের জন্য রওনা হন।

Farmers Convention

তিন কৃষি কালা কানুনের বিলুপ্তি, কৃষি পণ্যের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য এবং সমস্ত রকমের কৃষি ঋণ মকুবের দাবিতে বিভিন্ন কৃষক সংগঠন ১১ সেপ্টেম্বর পাটনায় এক কনভেনশন সংগঠিত করে। বিভিন্ন জেলার কৃষক আন্দোলনের নেতারা অংশগ্রহণ করেন। চলমান কৃষক আন্দোলনের শহীদদের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা জানিয়ে কনভেনশন শুরু হয়।

এআইকেএম জাতীয় সাধারণ সম্পাদক ও প্রাক্তন বিধায়ক এবং এআইকেসিসি বিহার ও ঝাড়খন্ডের ইনচার্জ রাজারাম সিং বলেন “মোদী সরকার বেসরকারি কোম্পানীগুলিকে শুধু কৃষিক্ষেত্রই নয়, বহুমূল্য জাতীয় সম্পদও বিক্রী করতে প্রস্তুত। আমাদের সংগ্রাম তাই কৃষিক্ষেত্র সহ সমস্ত জাতীয় সম্পদ, গণতন্ত্র ও সংবিধানকে বাঁচানোর”। তিনি বিহারবাসীর কাছে আবেদন করেন আগামী ২৭ সেপ্টেম্বর ভারত বনধ্ সর্বতোভাবে সফল করার জন্য।

কনভেনশনে অন্যান্য কৃষক সংগঠন থেকে বিভিন্ন নেতা, বহু বুদ্ধিজীবী, গণসংঠন, বিধায়ক ভাষণ দেন। উল্লেখযোগ্য বক্তাদের মধ্যে ছিলেন — অশোক সিং, বিনোদ কুমার, সুদামা প্রসাদ, মহানন্দ, বীরেন্দ্র গুপ্তা, ডি এম দিবাকর, শম্ভুনাথ মেহতা, মনোহর লাল, জিতেন্দ্র যাদব প্রমুখরা।

কনভেনশনের শেষভাগে যে প্রস্তাবগুলি পাশ হয় সেগুলি হল, তিন কৃষি-কালা কানুনের প্রত্যাহার, এমএসপি নিশ্চয়তার বৈধকরণ, ভাগচাষি সহ সমস্ত কৃষকদের ঋণ মকুব, বিদ্যুৎ বিল ২০২০-র প্রত্যাহার, বিহারে এপিএমসি আইনের পুনর্বহাল, চাষের উপকরণের কালোবাজারির বিলুপ্তি এবং সারের ঘাটতি মেটানো, ছয় মাসের জন্য বিনামূল্যের রেশন, বন্যার জলে ডুবে থাকা ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলের এবং বন্যায় শস্যহানির জন্য ক্ষতিপূরণ, মুদ্রাস্ফীতি অনুযায়ী আখের দাম নির্দিষ্ট করা।

daily income of farmers

দেশের অন্নদাতারা কৃষিকাজ থেকে ২০১৮-১৯ সালে দৈনিক কত উপার্জন করেছে তা কি ভারতবাসী জানেন?

মাত্র ২৭ টাকা! যা মনরেগার মজুরি থেকেও কম! এই সংখ্যাটাই ভারতীয় কৃষির গভীর সংকটকে প্রতিবিম্বিত করছে। কৃষকেরা কেন ভারত বনধ্ ডাকতে বাধ্য হলেন, তার আভাস হয়ত এখান থেকে কিছুটা হলেও পাওয়া যাবে।

ন্যাশনাল স্ট্যাটিস্টিক্স অফিস (এনএসও)-র তরফ থেকে কৃষকদের আর্থিক অবস্থা নিয়ে ১০ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত সমীক্ষা — সিচুয়েশন অ্যাসেসমেন্ট সার্ভে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট, যা প্রথম প্রকাশিত হয় হিন্দুস্তান টাইমস পত্রিকায়, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২১।

উক্ত সমীক্ষা উল্লেখ করেছে, আনুমানিক ৯ কোটি ৩১ লক্ষ পরিবার কৃষি কাজের সাথে যুক্ত। এ ছাড়াও, ৭ কোটি ৯৩ লক্ষ পরিবার অ-কৃষি কাজের মাধ্যমে নিজেদের জীবিকা নির্বাহ করেন। এই সমীক্ষা থেকে বোঝাই যাচ্ছে, অর্ধেকের ও বেশি গ্রামীণ জনসংখ্যা কৃষিকাজ থেকে ন্যূনতম উপার্জন করতে পারছেন না। প্রায় ৯৯ শতাংশ অ-কৃষি পরিবারের হাতে রয়েছে এক হেক্টর থেকেও কম জমি , তাই অনিয়মিত বা ক্যাজুয়াল ধরনের কাজই তাঁদের আয়ের প্রধান উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখান থেকে যে সিদ্ধান্তে অনায়াসে উপনীত হওয়া যায় তা হল — কৃষিকাজের সাথে যুক্ত পরিবারগুলোর কাছে কৃষি এখন আর আয়ের প্রধান উৎস নয়। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ পরিবারগুলোর ক্ষেত্রে কৃষি থেকে আয়ের উৎস প্রধান অবস্থানে না থাকাটা বুঝিয়ে দেয় যে ভারতীয় অর্থনীতিতে কৃষি প্রান্তিক সীমানায় রয়েছে। অলাভজনক কৃষিকাজ কর্পোরেট বিনিয়োগের জন্য কতটা আকর্ষনীয় হবে তা নিয়ে বিশেষজ্ঞ মহল সন্দিহান।

সমীক্ষায় প্রকাশ, ৯ কোটি ৩১ লক্ষ কৃষিজীবী পরিবারের মধ্যে ৭১ শতাংশ পরিবার কৃষিতে স্বনিযুক্ত বা পশুপালনের কাজে জড়িত।

মহাত্মা গান্ধী জাতীয় গ্রামীণ নিশ্চয়তা প্রকল্পে যে মজুরি সাধারণত দেওয়া হয় তা খোলা বাজারে ন্যূনতম মজুরির থেকে সামান্য কম। এই একশ দিনের কাজের প্রকল্পের সাথে যারা যুক্ত, তাঁরাই সবচেয়ে দরিদ্র হিসাবে বিবেচিত। সমীক্ষা দেখিয়েছে, পাঁচটি রাজ্য বাদে কৃষিকাজ থেকে অর্জিত দৈনিক গড় আয় ১০০ দিনের প্রকল্পের ন্যূনতম মজুরি থেকেও কম।

কৃষি যে আর লাভজনক অর্থনৈতিক ক্ষেত্র নয় তা অতিমারীর সময়ে সরকার কর্তৃক ঘোষিত লকডাউন নির্দয় ভাবে ফুটিয়ে তুলল। দেখা গেল, নিজ গ্রামীণ ক্ষেত্রে কাজের অভাবে যে কোটি কোটি শ্রমজীবী মানুষ পরভূমে কাজের খোঁজে পাড়ি দিয়েছিলেন, লকডাউনের পর সেই সমস্ত কাজ-হারা লক্ষ কোটি মানুষের অনর্গল স্রোত, অবর্ণনীয়-অমানবিক যন্ত্রণা ও দুর্দশাকে পাথেয় করে ফের নিজ নিজ বাসভূমে ফিরে আসে। এই ছবি সেই কঠোর অর্থনৈতিক বাস্তবতাকেই মেলে ধরল। বিপরীতে, এই প্রথম দেখা গেল, কৃষিক্ষেত্রটা চরম সংকটের মধ্যে বেঁচে বর্তে থাকার শেষ সম্বল, ডুবন্ত মানুষের অন্তিম খড় কুটো। ধারাবাহিকভাবে কৃষি ক্ষেত্রে ক্রমশ নিচের দিকে গড়িয়ে পড়া অর্থনীতি ২০১৯-২০তে প্রথম মুখ তুলল। এই প্রথম ওই বছরে কৃষি ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান বেড়ে হয় ৪৫.৬ শতাংশ — ঠিক তার আগের বছরে যা ছিল ৪২.৫ শতাংশ। লকডাউন শহুরে ভারতে নজিরবিহীন মাত্রায় যে কাজ কেড়ে নেয়, গ্রামীণ ভারত সেই কাজের একটা অংশকে ঠাঁই দেয়। এপ্রিল-জুন ২০১৯-এ শহুরে ভারতে কাজ চলে যায় আনুমানিক ১ কোটি ১০ লক্ষ আর ওই একই সময়ে গ্রামীণ ভারতে কর্মসংস্থান নতুন করে বৃদ্ধি পায় ১ কোটি ৪৭ লক্ষ। কিন্তু গ্রামীণ ক্ষেত্রে এই কাজ অনেক কম মজুরিবৃদ্ধিতে, অধিক শ্রমসাধ্য ক্ষেত্রে হয়েছে। অগত্যার গতি, দুর্দশা চালিত সময়েই কৃষি বেশ কিছুটা প্রাণচঞ্চল হয়ে ওঠে ব্যতিক্রম হিসাবে।

অতিমারির সৃষ্ট আর্থিক দুর্দশা থেকে কোনোক্রমে বাঁচতে, কাজ হারা বিপুল সংখ্যক মানুষ মাথা গুঁজতে সেই কৃষি ক্ষেত্রকেই বেছে নিল, কেন্দ্রীয় সরকারের অবজ্ঞা অবহেলায় যা আজ মরণাপন্ন হয়ে উঠেছে। যে মোদী সরকার “আগামী ৫ বছরে কৃষকদের আয় দ্বিগুণ” করার আওয়াজ তুলেছিল, আজ নিঃস্ব রিক্ত দেনার দায়ে আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা কৃষক সমাজ আর আত্মহননের পথে না গিয়ে তার বিরুদ্ধে নেমেছে রাজনৈতিক এক লড়াইয়ে। কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে ভারত বনধের ডাক দিয়ে নামহীন অবয়বহীন অবহেলিত অগণিত কৃষকেরা আজ ছুঁড়ে দিয়েছে বিরাট এক চ্যালেঞ্জ। স্বাধীনোত্তর ভারতবর্ষ এই প্রথম দেখতে চলেছে সংযুক্ত কৃষক মোর্চার ডাকে দেশব্যাপী বনধ যার পাশে দাঁড়িয়েছে সারা দেশের শ্রমিকশ্রেণি, ছাত্র যুব মহিলা সমাজ, বিজেপি বিরোধী সমস্ত রাজনৈতিক দলসমূহ।

মোদীর বিরুদ্ধে সংগঠিত হতে যাওয়া বিরাট এই মহাকাব্যের জন্য চলছে জোর লড়াইয়ের প্রস্তুতি।

- অতনু চক্রবর্তী

Muzaffarnagar Mahapanchayat

৫ সেপ্টেম্বর মুজফ্ফরনগরে কৃষক-কৃষি শ্রমিক মহাপঞ্চায়েত থেকে দৃঢ়ভাবে ঘোষিত হল দেশে আর কোনও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঘটতে দেওয়া হবে না। হিন্দু-মুসলমান ঐক্যকে আরও দৃঢ় করার শ্লোগানে মুখরিত হল সভা। বিজেপি-আরএসএসের সাম্প্রদায়িক, জাতপাতের রাজনীতির বিরুদ্ধে কৃষক-কৃষি শ্রমিকদের এজেন্ডাই জয়ী হবে — এটাই ছিল মহাপঞ্চায়েতের সমস্ত বক্তাদের মূল সুর। মুজফ্ফরনগরের মহাপঞ্চায়েতে উদ্বোধন হল সংযুক্ত কিসান মোর্চার মিশন উত্তরপ্রদেশ-উত্তরাখন্ড — যার লক্ষ্য হল এই দুই রাজ্যে তিন কৃষি কালা কানুনের প্রত্যাহার এবং সি২+৫০ শতাংশ সূত্রে কৃষিপণ্যের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের জন্য সংগ্রাম আর আগামী নির্বাচনে বিজেপিকে চূড়ান্তভাবে পরাস্ত করা। বক্তারা বললেন উত্তরপ্রদেশ সরকার ব্রিটিশদের ‘ভাগ কর শাসন কর’ ও জাতপাত-সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ভিত্তিতে শাসন জারি করেছে। যোগী সরকার কৃষকদের জন্য ঘোষিত প্রতিশ্রুতি পালন করেনি। ২০ শতাংশ শস্য প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কেনেনি। ৮৬ লক্ষ কৃষকের কৃষিঋণ প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী মকুব করেনি, এমনকি ৪৫ লক্ষ কৃষকের কৃষিঋণও মকুব করেনি। কেন্দ্রীয় সরকারের সিএসপি এজেন্সি (কৃষকদের প্রযুক্তিগত ও আর্থিক সহায়তা দেওয়ার এজেন্সি) ২০১৭ সালে অবহিত হয়েছিলেন আখের চাষে প্রতি কুইন্ট্যালে ৩৮৩ টাকা খরচ হয় কিন্তু কৃষক পায় কুইন্ট্যাল প্রতি ৩২৫ টাকা এবং সুগারমিলের কাছে কৃষকদের বকেয়া পাওনা হল ৮৭০০ কোটি টাকা। ২০১৬-১৭ সালে উত্তর প্রদেশের ৭২ লক্ষ কৃষক শস্য বীমার বকেয়া পেয়েছেন, কিন্তু ২০১৯-২০ সালে মাত্র ৪৭ লক্ষ কৃষক শস্য বীমার বকেয়া পান যার ফলে শস্য বীমা কোম্পানির লাভ হয় ২,৫০৮ কোটি টাকা।

মহাপঞ্চায়েতের দাবি উত্তর প্রদেশ সরকারের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ৪৫০ টাকা প্রতি কুইন্ট্যাল আখের দাম দিতে হবে নতুবা সংযুক্ত কিসান মোর্চার পরবর্তী সভায় আন্দোলনের ডাক দেওয়া হবে।

৪ সেপ্টেম্বর দুপুর থেকেই মুজফ্ফর নগরের সভাস্থলে দলে দলে কৃষকেরা আসতে থাকেন। পাঞ্জাব, হরিয়ানা এবং দেশের বিভিন্ন রাজ্য থেকে কৃষকরা সারা রাত ধরে আসতে থাকেন। সংযুক্ত কিসান মোর্চা এবং তার অন্তর্ভুক্ত সংগঠনগুলির প্রায় সমস্ত নেতারাও সভাস্থলে পৌঁছে যান। এ আই কে এম অন্তর্ভুক্ত পাঞ্জাব কিসান ইউনিয়ন গ্রুপ, এআইকেএম- এর জাতীয় কার্যনির্বাহক সদস্য গোরা সিং-এর নেতৃত্বে সভাস্থলে আসেন।

৫ সেপ্টেম্বর সকাল ৯ টার মধ্যেই সভায় ভীড় উপচে পড়ে। বাইরের রাস্তাতেও হাজারে হাজারে লোক দেখা যায়। অন্যান্য রাজ্য থেকে তখনও হাজার হাজার লোক আসার খবর পাওয়া যায়।

জায়গার অভাবে যত লোক সভার ভেতরে ছিল প্রায় তত লোকই সভাস্থলের বাইরে ছিল। প্রধান গেটের বাইরে প্রায় এক কিলোমিটার জুড়ে কলা, লাড্ডু, পুরি, পরোটা, চানা ইত্যাদি খাবার বিতরণ করা হয়। ব্যবস্থাপনায় ছিলেন স্থানীয় গ্রামের কৃষকরা। শিখ সংগঠনের লঙ্গরখানাও ছিল প্রথম দিন থেকে। মুজফ্ফরনগরের দোকানপাট বন্ধ ছিল এবং স্থানীয় দোকানদাররা ও বসবাসীরা তাদের যথাসাধ্য সাহায্য করেছেন কৃষকদের। যুবকরা তাদের বাড়ির সামনে পানীয় জল যোগান দিয়েছেন। সভাস্থলে শৌচাগার ও পানীয় জল এবং মেডিক্যাল ক্যাম্প ও ভ্রাম্যমাণ ডিসপেনসারির ব্যবস্থা ছিল। বেলা দেড়টা পর্যন্ত কৃষকরা সভায় যোগ দিয়েছেন। তাঁরা বিভিন্ন ধর্ম, জাতপাত, অঞ্চল ও ভাষাভাষীর বেড়াজাল ছিন্ন করে এক পরিষ্কার বার্তা দিলেন রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারকে। সমাজের সর্বস্তর থেকে কৃষক-কৃষিশ্রমিকদের এই মহাপঞ্চায়েত অভূতপূর্ব সমর্থন পেয়েছে। ভেতরে বাইরে সর্বত্র মাইকে নেতাদের ভাষণ শোনা গেছে।

পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশ, উত্তরাখন্ড, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, বিহার, কেরালা, তামিলনাড়ু, কর্ণাটক, অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলঙ্গানা, মহারাষ্ট্র, এবং আরো রাজ্য থেকে অংশগ্রহণকারীরা এসেছিলেন। লক্ষ্যণীয় ছিল যুবকদের অংশগ্রহণ। সভায় শ্লোগান ছিল হিন্দু-মুসলিম-শিখ ঐক্য এবং কৃষক-কৃষিশ্রমিক ঐক্যের।

India will be closed

যারা কানে শুনতে পায় না সেই বধিরদের শোনাতে গেলে সজোরে আওয়াজ প্রয়োজন। পরাধীন ভারতে শাসক ইংরেজের বিরুদ্ধে এ কথা বলেছিলেন ভগত সিং। ঔপনিবেশিক আইনের বিরুদ্ধে তিনি এবং তাঁর কমরেডরা পার্লামেন্টে বোমা নিক্ষেপ করেছিলেন। আজ যখন আমাদের দেশকে নয়া উপনিবেশিক শোষণের ফাঁদে ফেলে দেওয়ার চক্রান্ত চলছে তখন সেই মহান বিপ্লবীর দিশানির্দেশকে পাথেয় করে দিল্লীর রাজপথ থেকে কিষাণ আন্দোলনের আওয়াজ ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়ে চলেছে গোটা দেশজুড়ে। পৌছে যাচ্ছে নতুন এক উচ্চতায়। আগামী ২৭ সেপ্টেম্বর ভারত বনধের আহ্বানে জেগে উঠছে সারা দেশ। নয় মাস পেরিয়ে গেলো, তিন কৃষি আইন বাতিলের দাবি যখন সরকার কর্ণপাত করছে না, তখন শাসকের বিরুদ্ধে সংগঠিত হচ্ছে জনগণের স্ট্রাইক বা প্রত্যাঘাত। সমস্বরে জোরালো আওয়াজ উঠেছে, কর্পোরেটের গোলামী মানছি না, মানবো না। আমাদের দেশের কৃষি শিল্প সরকারী সম্পদ দেশী বিদেশী কর্পোরেটদের লুঠের কারবারে সমর্পণ করা চলবে না। নয়া কৃষি আইনের মধ্য দিয়ে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা তথা খাদ্য স্বয়ংভরতা ধ্বংস করে দেশকে খাদ্য আমদানীর পথে নিয়ে যাওয়া চলবে না। চুক্তি চাষের আইনের আড়ালে সাম্রাজ্যবাদী অধীনতাকে বরণ করা চলবে না। কৃষি জমির দখলদারী বন্ধ করো। চলমান এই কৃষক আন্দোলন ফ্যাসিস্ট সরকারের চোখে চোখ রেখে আন্দোলনের ঐতিহ্যকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। রাস্ট্রের ব্যাপক দমন পীড়নকে মোকাবিলা করে গণতান্ত্রিক পরিসরকে বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে। দেশের শ্রমিক শ্রেণী, ছাত্র-যুব, মহিলা, আদিবাসী, দলিত সহ ব্যাপক মানুষের মধ্যে অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করেছে। বিভাজনের রাজনীতিকে অকার্যকর করে দিয়ে শ্রেণী ঐক্যের ঐতিহ্যকে সামনে নিয়ে এসেছে।

বেশ কয়েকমাস হয়ে গেল সংসদে গায়ের জোরে পাশ করা কৃষি আইনের প্রভাব ইতিমধ্যেই জনগণের দৈনন্দিন জীবনে পড়তে শুরু করেছে। নিত্যপণ্য, ভোজ্য তেল প্রভৃতি খাদ্যদ্রব্যের অসহনীয় মূল্যবৃদ্ধি চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে খাদ্যপণ্যর অবাধ মজুতদারীর ছাড়পত্রের নয়া আইন কি অদৃশ্য কায়দায় বাজারে নিত্যপণ্যের দাম উর্দ্ধমুখী করে তুলছে। অন্নদাতারা তাঁদের উৎপাদিত ফসলের অভাবী বিক্রি করছে আর তার আট দশগুণ দামে ক্রেতারা বাজারে তা কিনছে। কৃষিপণ্যের বানিজ্য কব্জা করে কর্পোরেটদের ছোট বড়ো এজেন্টরা বা সিন্ডিকেটগুলি কিভাবে একদিকে উৎপাদক চাষি অপরদিকে মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্ত ক্রেতা দুদিকেই তাদের মুনাফার থাবা বিস্তার করে চলেছে। কৃষক সম্মান বা কৃষক বন্ধু নামক মুখোশ চাষির প্রতি সরকারের সীমাহীন বঞ্চনা প্রতারণার প্রকৃত মুখটাকে আড়াল করতে পারছে না। কর্পোরেটদের করছাড় দিয়ে পেট্রোপণ্যের উপর বিপুল কর চাপানো সরকারের রাজস্ব আয়ের অন্যতম প্রধান রাস্তা হয়ে উঠেছে। এর প্রভাবে একদিকে পরিবহনের খরচ বাড়িয়ে মূল্যবৃদ্ধি আকাশছোঁয়া হয়ে উঠছে, অপরদিকে কৃষি উপকরণের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বৃদ্ধি করে চাষীদের ঋণফাঁদে ফেলে দিচ্ছে। তাঁদের ঠেলে দেওয়া হচ্ছে আত্মহত্যার পথে। সরকারী ক্ষেত্রের বিলোপ কর্মসংস্থানের সামনে কালো পর্দা ঝুলিয়ে দিয়েছে। শিল্পে মন্দা পরিযায়ীদের গ্রামে ফিরিয়ে এনে গ্রামীণ বেকারত্ব সর্বকালীন রেকর্ড করেছে। বিশেষত সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষি মজুর হলেন শ্রমজীবী মহিলারা। তাদের কর্মহীনতা বেড়ে চলেছে। কৃষির উপর শ্রমের চাপ বাড়ছে, কৃষিতে আয় কমছে। সব মিলিয়ে আক্রান্ত সর্বস্তরের শ্রমজীবী মানুষ হয়ে উঠেছে একই নৌকার যাত্রী। ভারত বনধ তাই সর্বস্তরের মানুষের ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ে ময়দান তৈরি করেছে।

আন্দোলনকারী কৃষকরা কেবল বাঁচাও বাঁচাও বলে আওয়াজ তুলছেন না! তারা দেশের কৃষি ব্যবস্থাকে গণমুখী দিশায় এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দাবি তুলে ধরেছেন। তারা বলছেন আমাদের দেশের সংবিধান অনুযায়ী কৃষকদের ও কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত সমস্ত মানুষের জীবন ও জীবিকা রক্ষা করতে এবং কৃষিকাজকে যথাযথভাবে সুরক্ষিত করতে সরকার বাধ্য। জীবন যাপনের অধিকারকে বাস্তবায়িত করা ও জীবিকার অধিকার নিশ্চিত করার জন্য নীতি নির্ধারণ এবং উপযুক্ত আইন প্রণয়ন ও লাগু করে কৃষকদের দুর্দশা রোধ করা সরকারের সাংবিধানিক কর্তব্য। এই লক্ষেই তারা কৃষিপণ্যের লাভজনক দর গ্যারান্টি আইন প্রনয়ণের দাবি তুলে ধরেছেন। তাই এ লড়াই কেবল কৃষকের নয়, এটা দেশ বাঁচানোর লড়াই। দেশের সংবিধান গণতন্ত্র রক্ষার লড়াই। আজ সমগ্র দেশের কৃষি ব্যবস্থায় ব্যাপক মাত্রায় সরকারী বিনিয়োগ করে কৃষকের স্বার্থরক্ষাকারী নীতি প্রনয়নের প্রশ্নটা প্রধান দাবি হয়ে উঠেছে। কৃষক আন্দোলনের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে আসছেন সারা দেশের পাশাপাশি এ রাজ্যের ক্ষুদ্র জোতের উপর নির্ভরশীল কৃষকরা এবং ব্যাপক বাম ও গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল শক্তিগুলি। বনধের দিন তারা অবশ্যই রাস্তায় থাকবেন।

- জয়তু দেশমুখ

attack on the media

অধিকাংশ বড়-বড় সংবাদপত্র এবং টিভি চ্যানেল মোদী সরকারের তাঁবেদার বনে গিয়ে তার প্রচার যন্ত্রে পরিণত হয়েছে। নরেন্দ্র মোদীর গুণকীর্তনই তাদের কাজ। কিন্তু সংখ্যায় অল্প হলেও যে সমস্ত সংবাদমাধ্যম নিজেদের স্বাধীন সত্তাকে ধরে রাখে, ক্ষমতার মুখের ওপর সত্যি কথাটা বলে, সরকারের সমালোচনা করে, তাদের কি চোখে দেখে মোদী সরকার? সরকার তাদের শত্রু জ্ঞান করে এবং বিভিন্ন তদন্তকারী সংস্থাকে লেলিয়ে দিয়ে যে ভাবে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে নিষ্ক্রিয় করার চেষ্টা হয়, এদের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটে না। এর আগে কখনও এন ডি টিভি-র বিরুদ্ধে সরকারকে খড়্গহস্ত হতে দেখেছি। এ বছরের জুলাই মাসের ২২ তারিখে হিন্দি সংবাদপত্র দৈনিক ভাস্কর এবং টিভি চ্যানেল ভারত সমাচার-এর বিভিন্ন অফিস ও কর্মকর্তাদের বাড়িতে আয়কর দপ্তরকে হানা দিতে দেখেছি। তাদের অপরাধ ছিল--কোভিড মোকাবিলায় মোদী সরকার এপ্রিল ও মে মাসে যে চরম অপদার্থতার পরিচয় দিয়েছিল, সে সম্পর্কে বাস্তব ঘটনার প্রতিফলন ঘটিয়ে একগুচ্ছ প্রতিবেদন প্রকাশ করা। দৈনিক ভাস্কর-এর ওয়েবসাইটের পাতায় লেখা ছিল, “গঙ্গায় মৃতদেহ ফেলাই হোক … করোনায় মৃতের সংখ্যাকে লুকোনোই হোক, ভাস্কর নির্ভীক সাংবাদিকতার স্বাক্ষর রেখেছে।” তাদের ভয় দেখাতে, সরকারের তাঁবেদার হওয়ার বার্তা দিতেই যে আয়কর দপ্তরকে পাঠানো হয়েছিল তা বোধকরি কেউই অস্বীকার করবেন না। অতি সম্প্রতি আবার দুটো অনলাইন নিউজ পোর্টাল, নিউজক্লিক ও নিউজলন্ড্রির দপ্তরে হানা দিতে দেখা গেল আয়কর দপ্তরকে। প্রসঙ্গত, তিন কৃষি আইন প্রত্যাহার নিয়ে বড়-বড় সংবাদমাধ্যমগুলোর নীরবতার বিপরীতে নিউজক্লিক যেমন গুরুত্ব দিয়ে কৃষক আন্দোলনের খবর প্রচার করেছে, তেমনি বড় আকারের কোম্পানির কার্যকলাপ নিয়েও প্রতিবেদন বার করেছে। আর নিউজলন্ড্রির কাজ সম্পর্কে সংস্থার এক কর্মীর মন্তব্য এই রকম — “এই সরকার মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করার মধ্যে দিয়েই টিকে থাকে। নিউজলন্ড্রি এই নিয়ন্ত্রণটাকেই চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে। মূল ধারার মিডিয়ার ভাষ্যে ছিদ্র বার করছে।” অর্থাৎ, মোসাহেবি মিডিয়া সরকারের কেমন তাঁবেদারি করছে, সেটার উন্মোচনই তাদের কাজ। এই ধরনের মিডিয়ার ওপর মোদী সরকার কি সদয় হতে পারে?

গত ১০ সেপ্টেম্বর নিউজ পোর্টাল দুটোর দপ্তরে আয়কর বিভাগের অফিসার ও কর্মীরা হানা দেন। সকাল ১১.৩০টা থেকে শুরু করে বারো ঘন্টারও বেশি আয়কর বিভাগের কর্মীদের অনুসন্ধান চালে। আয়কর দপ্তরের কমিশনার জানিয়েছেন, দুটো পোর্টালে তাঁদের কাজ ছিল ‘সার্ভে’র, কোনো রেইড করতে বা হানাদারি/তল্লাশি চালাতে তাঁরা যাননি। ‘সার্ভে’ আর ‘রেইড’-এর মধ্যে ফারাক হল এই যে, ‘সার্ভে’ হলে কোনো নথিপত্র বাজেয়াপ্ত করা যায় না, ‘রেইড’-এর ক্ষেত্রে তাতে কোনো নিষেধ নেই। কিন্তু নিউজলন্ড্রির প্রধান কর্মকর্তা অভিনন্দন শেখরি জানিয়েছেন, “আমার নিজের মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ ও অফিসের গোটা দুই মেশিনকে আয়কর দপ্তরের কর্মীরা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে সেগুলো থেকে সমস্ত তথ্য ডাউনলোড করে নিয়েছিল।” এর সঙ্গে তল্লাশি ও নথিপত্র বাজেয়াপ্ত করার ফারাক কোথায় থাকছে? দুই পোর্টালে হানাদারির পর এডিটর্স গিল্ড আয়কর দপ্তরের এই কর্মকাণ্ডকে ধিক্কার জানিয়ে বলেছে, এটা হল “সরকারি সংস্থাগুলোর স্বাধীন মিডিয়াকে হেনস্থা করা ও ভয় দেখানোর একটা বিপজ্জনক প্রবণতা।” গুজরাটের বিধায়ক জিগনেশ মেভানিও নরেন্দ্র মোদীকে কটাক্ষ করে বলেছেন, “গতকাল রূপাণী সরকারের জনবিরোধী নীতির প্রবল সমালোচক ভি টিভি গুজরাটির অফিসে হানাদারি চালানোর পর মোদী সরকার আজ নিউজক্লিক ও নিউজলন্ড্রিকে নিশানা বানালো। হুমকিবাজির কৌশল ফিরে এসেছে! নরেন্দ্র মোদী, কিসের জন্য আপনার এত ভয়?”

নিউজক্লিক ও নিউজলন্ড্রির ওপর মোদী সরকার যে এই প্রথম হামলা চালালো এমন নয়। এর আগে ফেব্রুয়ারি মাসে এনফোর্সমেন্ট ডাইরেক্টোরেট পাঁচদিন ধরে নিউজক্লিক-এর অফিসে এবং কর্মীদের বাড়িতে তল্লাশি চালায়। সে সময় প্রচুর ব্যাঙ্কের নথিপত্র, ল্যাপটপ, মোবাইল ফোন, কর্মীদের ই-মেইলে থাকা তথ্য বাজেয়াপ্ত করা হয়। জুলাই মাসেও আয়কর বিভাগের অফিসাররা কর ফাঁকির অভিযোগের নামে নিউজক্লিক-এর প্রধান সম্পাদক প্রবীর পুরকায়স্থকে পাঁচ ঘন্টা জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলেন। এবারের হানাদারির পর প্রবীর পুরকায়স্থ জানিয়েছেন, “গতকালের হানাদারি সেই একই মিথ্যা এবং ভিত্তিহীন অভিযোগ সম্পর্কে বলেই মনে হয়, এনফোর্সমেন্ট ডাইরেক্টোরেট এবং দিল্লী পুলিশের অর্থনৈতিক অপরাধ শাখা যার তদন্ত চালাচ্ছে।” দিল্লী পুলিশের অর্থনৈতিক অপরাধের তদন্ত শাখা নিউজক্লিক-এর বিরুদ্ধে যে অভিযোগের কারণে তদন্ত চালাচ্ছে তা হল — নিউজক্লিক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সচল না থাকা একটা সংস্থা থেকে ৯.৫৯ কোটি টাকা নিয়েছিল এবং তার জন্য নাকি প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ (এফডিআই) বিধির লঙ্ঘন হয়েছিল। যে সংস্থা থেকে ঐ অর্থ নেওয়া হয়েছিল সেটি হল ওয়ার্ল্ডওয়াইড মিডিয়া হোল্ডিংস এলএলসি। কিন্তু এই অভিযোগ কতটা সত্যি? নিউজক্লিক জানিয়েছে, ২০১৯ সালে এফ ডি আই-এর ক্ষেত্রে যে নতুন বিধি তৈরি হয়েছিল, যার মধ্যে দিয়ে ডিজিটাল মিডিয়ার ক্ষেত্রে এফডিআই-এর সর্বোচ্চ মাত্রা ২৬ শতাংশ নির্ধারিত হয়েছিল, সেটা তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে না। কেননা, এই অর্থ তারা পেয়েছিল ২০১৮ সালে, নতুন ঐ বিধি তৈরি হওয়ার আগেই। রিজার্ভ ব্যাঙ্কও জানিয়েছে, নিউজক্লিক বিদেশী মুদ্রা পরিচালন আইন-এর বিধি ভঙ্গ করেনি। এনফোর্সমেন্ট ডাইরেক্টোরেট এবং দিল্লী পুলিশ নিউজক্লিক-এর বিরুদ্ধে আপাতত কোনো দমনমূলক ব্যবস্থা নিতে পারবে না – দিল্লী হাইকোর্টের এমন নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও আয়কর দপ্তরকে দিয়ে নিউজপোর্টাল দুটোয় হানাদারি চালানোটা কি মোদী সরকারের প্রতিহিংসার পরিচায়ক নয়?

সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সরকারের বিরোধিতা ও সমালোচনাকে স্তব্ধ ও দমন করতে মোদী সরকার বিরোধীদের ওপর হামলা নামিয়েছে, সমাজ আন্দোলনের ও মানবাধিকার কর্মীদের জেলে পুরেছে। একইভাবে সরকারের নীতির সমালোচক, হিন্দুত্ব ও সাম্প্রদায়িকতার বিরোধিতা করা সাংবাদিকদেরও মোদী জমানায় বারবার আক্রমণের শিকার হতে হয়েছে। সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে এই শঙ্কাজনক পরিস্থিতির জন্যই রিপোটার্স উইদাউট ফ্রন্টিয়ার্স-এর তৈরি করা ২০২১-এর রিপোর্টৈ ভারতকে সাংবাদিকদের জন্য “পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা বিপজ্জনক দেশগুলোর একটা” বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। রিপোটার্স উইদাউট ফ্রন্টিয়ার্স একটা ফরাসি এনজিও এবং প্রতি বছরই তারা সংবাদপত্রের স্বাধীনতার সূচক তৈরি করে তার ভিত্তিতে বিশ্বের দেশগুলোর অবস্থান নির্ধারিত করে থাকে। তাদের ২০২১-এর রিপোর্টে ১৮০টা দেশের মধ্যে ভারতের স্থান হয়েছে ১৪২তম। অবস্থান এত নীচে হওয়ার জন্য রিপোর্টে যে কারণগুলোর উল্লেখ করা হয়েছে তার কয়েকটা হল — (১) নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর সংবাদমাধ্যমগুলোর ওপর কবজাকে শক্তিশালী করে তুলেছেন। (২) ২০১৯ সালের নির্বাচনে বিপুল জয়লাভের পর “হিন্দু জাতীয়তাবাদী সরকারের লাইন গ্ৰহণে বাধ্য হতে সংবাদমাধ্যমের ওপর চাপ বাড়ানো হয়েছে।” (৩) সাংবাদিকদের সমস্ত ধরনের আক্রমণের মুখে পড়তে হচ্ছে, যার মধ্যে রয়েছে “সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে পুলিশি হিংসা, রাজনৈতিক দলের কর্মীদের হাতে অতর্কিত আক্রমণ এবং অপরাধপ্রবণ গোষ্ঠী বা স্থানীয় স্তরে দুর্নীতিপরায়ণ কর্তাদের দ্বারা প্রতিশোধ গ্ৰহণ।” (৪) কোনো-কোনো সাংবাদিক এমন কিছু বলেন বা লেখেন যেগুলো “হিন্দুত্ত্ব অনুগামীদের অসন্তুষ্ট করে”। তারা তখন সমাজমাধ্যমগুলোতে ঐ সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে “ঘৃণার অভিযান” নামায় যাতে “সাংবাদিকদের হত্যা করার আহ্বানও থাকে।” (৫) কাশ্মীরে সংবাদমাধ্যমের অবস্থা “অত্যন্ত উদ্বেগজনক”। সেখানে সাংবাদিকদের “পুলিশ এবং আধা-সামরিক বাহিনীর হয়রানির” মুখে পড়তে হয়, কোনো-কোনো সংবাদপত্র এমনকি বন্ধ করে দিতেও হয়, যেমনটা ঘটেছে কাশ্মীর টাইমস-এর ক্ষেত্রে। (৬) সরকারপন্থী সংবাদমাধ্যমগুলো যেখানে সরকারের হয়ে প্রচার চালায়, এর বিপরীতে যে সমস্ত সাংবাদিক সরকারের সমালোচনা করার সাহস দেখায়, “শাসক ভারতীয় জনতা পার্টির সমর্থকরা” তাদের “রাষ্ট্র-বিরোধী”, “দেশদ্রোহী” এবং এমনকি “সন্ত্রাবাদী সমর্থক” বলে ছাপ মারে।

রিপোর্টটা ফরাসি এন জি ও-র তৈরি হলেও তাতে ভারতের সংবাদ জগতে বিদ্যমান বাস্তবতার প্রতিফলন ঘটেছে এবং সরকারের সমালোচক সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকরা মোদী জমানায় কতটা বিপন্ন হয়ে পড়েছেন রিপোর্টে তাও অভ্রান্তভাবে ধরা পড়েছে। সাংবাদিকদের ওপর আক্রমণ নিয়ে করা একটা সমীক্ষা জানিয়েছে — ২০২০ সালে সাংবাদিকতার কাজ করতে গিয়ে চারজন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন, ৬৬ জন সাংবাদিককে গ্ৰেপ্তার করা হয়েছে এবং প্রায় ২০০ জন সাংবাদিক দৈহিক আক্রমণের শিকার হয়েছেন। এমনকি পেগাসাস স্পাইওয়্যার দিয়ে যাদের ওপর নজরদারি চালানো হয়েছে তাদের মধ্যে সরকারের অপছন্দের কয়েকজন সাংবাদিকও রয়েছেন। কখনও এনফোর্সমেন্ট ডাইরেক্টোরেট, কখনও দিল্লী পুলিশের অর্থনৈতিক অপরাধ তদন্তের শাখা, কখনও বা আয়কর দপ্তরকে দিয়ে নিউজক্লিক ও নিউজলন্ড্রির ওপর হামলাবাজি সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপরই আক্রমণ, সংবাদমাধ্যমকে সরকারের অনুগামী করে তোলার লক্ষ্যে নির্ভেজাল হুমকিবাজিরই আশ্রয়। মিডিয়ার স্বাধীনতা ও প্রাণবন্ততা ফ্যাসিবাদের কাছে প্রতিবন্ধকতা হয়েই দেখা দেয়। আর তাই মোদী সরকার ও সংঘ বশ না মানা মিডিয়াকে বশংবদ করে তুলতে লাগাতার হামলার অভিযান চালায়। তবে, শত দমন সত্ত্বেও প্রতিবাদ-প্রতিরোধকে যেমন নিঃশেষ করা যায় না, একইভাবে কর্পোরেট মালিকানাধীন গোডি মিডিয়ার ব্যাপক অস্তিত্ব সত্ত্বেও বিকল্প, স্বাধীন মিডিয়া নিজের অস্তিত্ব ঘোষণা করে চলে। নিউজক্লিক ও নিউজলন্ড্রির মতো মিডিয়া সরকারের নীতিহীনতা ও ভ্রষ্টাচার সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করার তাদের কাজ করে যায়।

Afghan people for freedom

(তালিবানরা আফগানিস্তানের দখল নেওয়ার পরে ভারতের বিভিন্ন গণতান্ত্রিক সংগঠন সংহতির আহ্বান জানিয়ে স্বাক্ষর করা একটি বিবৃতি দিয়েছিল। এখানে সংক্ষেপে তার মূল মূল বিষয় পুনপ্রকাশ করা হল।)

কুড়ি বছরের মার্কিন দখলদারির অবসান আফগানিস্তানের মানুষের জীবনে কোনো স্বস্তি আনতে পারলো না। ক্ষমতা হস্তান্তরের পর থেকে তালিবানরা আফগানিস্তানে এক বিশৃঙ্খল, সংকটময়, অনিশ্চিত ও ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে।

তালিবানি নৃশংসতার নিত্যনতুন খবর দিয়ে আফগানিস্তানে প্রত্যেকটি দিন শুরু হয়। তালিবানরা সংখ্যালঘু হাজারা সম্প্রদায়ের মানুষদের হত্যা করেছে, ডয়েশ উইলি নামে একজন সাংবাদিকের পরিজনদের হত্যা করেছে, একজন মহিলা টিভি সঞ্চালককে সরিয়ে পুরুষ সঞ্চালককে বসিয়েছে, বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভিন্নমতাবলম্বীদের খুঁজে বার করে অপহরণ করেছে; সাংবাদিকদের উপর অত্যন্ত হিংস্র আক্রমণ করেছে এবং এদের মধ্যে অন্তত একজনকে হত্যা করেছে এবং প্রতিবাদকারীদের গুলি করে প্রকাশ্য রাস্তায় হত্যা করেছে। তালিবানদের ঘোষণা অনুসারে তাদের কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেবে যে, মেয়েরা কতদূর পড়াশোনা করতে পারবে, তারা কোন বিষয়ে পড়াশোনা করবে, কোনও চাকরি করবে; এবং অবশ্যই কী ধরনের পোশাক পরবে। ইতিমধ্যেই আফগান মহিলাদের উপর যথেচ্ছ তালিবানি আক্রমণের খবরাখবর আসছে। অন্যদিকে, অপরিসীম সাহসের সাথে মহিলারা কাবুলের রাস্তায় হাতে লেখা পোস্টার নিয়ে প্রতিবাদ করছেন; এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে আফগান মহিলা ও পুরুষরা হাতে জাতীয় পতাকা নিয়ে বুলেটের সামনে দাঁড়িয়ে তালিবানদের অন্যায়ভাবে ক্ষমতা দখলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছেন। এরাই আফগানিস্তানের সংগ্রামী গণতন্ত্রপন্থী জনগণ, যাঁদের কণ্ঠস্বর আরও সোচ্চার করতে আমাদের সংহতি প্রয়োজন।

আফগানিস্তানের আজকের দুঃখজনক পরিস্থিতির জন্য বহু আন্তর্জাতিক কুশীলব দায়ী। ১৯৭৯ সালে তৎকালীন আফগান সরকারের নির্দেশে সোভিয়েত সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ আফগানিস্তানকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যেকার ঠান্ডা যুদ্ধের দৃশ্যপটে তুলে আনে। সোভিয়েত মদতপুষ্ট সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে থাকা মুজাহিদীন শক্তিসমূহকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র লাগাতার অর্থ ও অস্ত্রের জোগান দিয়েছিল। এই ছিল তালিবানদের উত্থানের পটভূমি। ২০০১ সালে আফগানিস্তানের জনসাধারণ ও বিশেষত মহিলাদের স্বাধীনতা দেওয়া এবং তালিবান সহ দেশটির অন্যান্য সন্ত্রাসবাদী সংগঠন গুলিকে ধ্বংস করার নামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা আবার সামরিক অনুপ্রবেশ ঘটায় এবং আফগানিস্তান দখল করে নেয়।

ঐ আক্রমণ ও দখলদারির পেছনে যে কারণগুলোকে অজুহাত হিসেবে দেখানো হয়েছিল পরিস্থিতির সাম্প্রতিক বিকাশ তাকে ইতিমধ্যেই পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে সম্পূর্ণ মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে। মার্কিন অধিকৃত আফগানিস্তানে জনগণ দখলদার সেনাবাহিনী ও তাদের ভাড়া করা অরাষ্ট্রীয় বাহিনীর বোমা হামলা, ড্রোন হামলা, ঘরে ঘরে নির্বিচার তল্লাশি ও হত্যার লক্ষ্যবস্তু হয়ে ওঠে। মার্কিন আগ্রাসন আসলে তালিবানদেরই নিজেদের সুসংহত করার অবকাশ তৈরি করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং আফগান সরকার সহ অন্যান্য মিত্রশক্তিকে বাদ দিয়ে তালিবানদের সঙ্গে একতরফা সমঝোতা করেছে। মার্কিন-তালিবান চুক্তি সকলের কাছে এটা স্পষ্ট করেছে যে, যুক্তরাষ্ট্রই তালিবানদেরকে ক্ষমতা হস্তান্তর করছিল। “সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ”, “গণতন্ত্র রক্ষার যুদ্ধ” এবং “আফগান মহিলাদের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ” — এহেন অজুহাতগুলোর মুখোশ খসে পড়ার সাথে সাথেই আফগানিস্তানকে পরাধীন করার এক হিংস্র ও নিষ্ঠুর আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ সামনে এসেছে।

আজ আফগানিস্তানের নারীবাদী মানুষ, মানবাধিকার কর্মী, পরিচর্যা ও সমাজকল্যাণ কর্মীদের স্বাধীনতা ও জীবন তালিবান রাজত্বে বিশেষভাবে বিপন্ন। শরণার্থীরা যেসব দেশে আশ্রয় খুঁজছেন সেখানেও তাদেরকে জায়গা দেওয়ায় অনীহা ও নানারকম হিংসার মুখোমুখি হচ্ছেন।

ভারত সরকার এখনও তালিবানের প্রতি অবস্থান স্পষ্ট করেনি। উপরন্তু শাসক বিজেপি ও হিন্দু-আধিপত্যকামী আরএসএস নেতারা ইসলাম ও গোটা মুসলিম সমাজকে বর্বর ও নিপীড়ক তালিবানদের সাথে একই পংক্তিতে বসিয়ে ভারতীয় মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও বিদ্বেষমূলক প্রচার করছে। ধর্মীয় ও অন্যান্য পরিচয় নির্বিশেষে সকলের নাগরিকত্বের সাংবিধানিক নিশ্চয়তার বিরুদ্ধে যাওয়া সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ)-এর প্রসঙ্গ টেনে সরকার নির্লজ্জভাবে ঘোষণা করেছে যে, তারা আফগান শরণার্থীদের মধ্যে হিন্দু ও শিখদেরকে “অগ্রাধিকার” দেবে।

আমরা ভারতবর্ষে যারা বিজেপি-আরএসএসের দমনমূলক চাপিয়ে দেওয়া নিষেধাজ্ঞা, যেমন মানুষ কী খাবে, কী ভাববে, কী লিখবে, কোন গান গাইবে এবং কী বিষয়ে কতটুকু কথা বলতে পারবে, কাকে আমরা ভালোবাসবো — এই সমস্ত বিষয়ে হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে যেভাবে এ'দেশে প্রতিবাদে সোচ্চার হই, ভিড় হিংসার বিরুদ্ধে দিনের পর দিন যারা লড়াই জারি রেখেছি, আসুন তারা সবাই আফগানিস্তানের মানুষের স্বাধীন জীবনযাপন ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের পাশে দাঁড়াই। আমরা যারা ভারতের সংবিধান ও জাতীয় পতাকাকে আরএসএস ও বিজেপির আক্রমণ থেকে রক্ষা করি, তারা আফগান জনগণের পাশে থাকি যাতে একইভাবে তাঁরা দেশের সংবিধান ও পতাকাকে তালিবান রাজত্বের আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে পারে এবং সাংবিধানিকভাবে একটি নির্বাচিত সংসদের দাবি করতে পারে, যেখানে বিভিন্ন আইন পাশ বা সংশোধন ও জাতীয় প্রতীক সংশোধন করার অনুমতি দেওয়া হবে। আমাদের স্পষ্ট দাবি —

১) প্রত্যেক আফগান নাগরিকের ভোটাধিকার সুনিশ্চিত করতে হবে যাতে তারা এক গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত সরকারকে শাসনক্ষমতায় আনতে পারে। রাষ্ট্রসংঘের তদারকিতে এক অস্থায়ী ও অন্তর্বতীকালীন ব্যবস্থা করতে হবে যাতে সত্বর সেখানে নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু করা যায়।

২) একটি আন্তর্জাতিক বিচারালয় স্থাপনের কাজ শুরু করা প্রয়োজন, যাতে আফগানিস্তান আক্রমন ও জবরদখলের সময়ে আমেরিকা ও ন্যাটো দ্বারা সেখানকার সাধারণ নাগরিকদের ওপর চালানো যুদ্ধাপরাধের ন্যায়বিচার সুনিশ্চিত হয়।

৩) রাষ্ট্রসংঘের মানবাধিকার কমিশনকে অবিলম্বে একটি তদন্তকারী দল গঠন প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে, যার কাজ হবে আমেরিকান সৈনিক ও তালিবান সহ যে সমস্ত সশস্ত্র শক্তি হিংসাত্মক নিপীড়ন চালিয়েছে আফগান নাগরিক সমাজের ওপর, তাদেরকে খুঁজে বার করে যথাযোগ্য শাস্তি প্রদান করা। অতীতে ও বর্তমানে মহিলা ও সংখ্যালঘুদের ওপর নৃশংস অত্যাচারী তালিবান নেতাদেরও বিচারের আওতায় আনতে হবে।

৪) রাষ্ট্রসংঘের নিরাপত্তা উপদেষ্টা, মানবাধিকার কমিশন, অন্যান্য আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ও আন্তর্জাতিক মহলকে এই বিষয়টা নিশ্চিত করতে হবে যে, আফগান নাগরিকদের সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার ও শান্তি স্থাপনের উদ্দেশ্যে পরিচালিত সমস্ত সমঝোতা ও উদ্যোগের কেন্দ্রে যেন সেদেশের নারী অধিকার সংগঠনগুলি অবশ্যই থাকতে পারে।

৫) আফগান শরণার্থীদের আশ্রয়দানের ক্ষেত্রে ভারত সরকারকে কোনোরকম ধর্মীয় বাছবিচার বন্ধ করতে হবে। জাতিধর্ম নির্বিশেষে প্রত্যেক বিপন্ন আফগান শরণার্থীর এদেশে সুরক্ষিত আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।

৬) সময় নষ্ট না করে ভারত সরকারকে আফগানিস্তান থেকে সমস্ত ভারতীয় নাগরিককে নিরাপদে ফিরিয়ে আনতে হবে (ভারতীয় দূতাবাসের কর্মীদের ফেরানো হলেও শয়ে শয়ে অন্যান্য মানুষ এখনও দেশে ফেরার কোনো নির্দিষ্ট সরকারী পরিকল্পনা ও দিশা না পেয়ে সেখানে আটকে আছেন)। ভারত সরকারকে অবশ্যই আফগান ছাত্রছাত্রীদের ভারতের শিক্ষা এত কিছু প্রস্তাব প্রতিষ্ঠানগুলোতে পড়াশোনা করার সুযোগ করে দিতে সর্বাত্মক চেষ্টা করতে হবে।

৭) ভারতে বসবাসকারী সমস্ত আফগান নাগরিকের নিরাপত্তা ভারত সরকারকে সুনিশ্চিত করতে হবে।

৮) উত্তরপ্রদেশ ও পাঞ্জাবের আসন্ন নির্বাচনের প্রচারে আফগানিস্তানের ঘটনাপ্রবাহ ও তালিবানি শাসনকে মূল ইস্যু বানিয়ে যাতে কেউ কোনো সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ছড়াতে না পারে সেটা ভারতের নির্বাচন কমিশনকে নিশ্চিত করতে হবে।

৯) রাষ্ট্রসংঘের মানবাধিকার কমিশনকে ভারতে আসা আফগান শরণার্থীদের নিবন্ধন করাতে হবে যাতে তারা প্রয়োজনানুসারে কর্মসংস্থান ও শিক্ষা নিশ্চিতভাবে পেতে পারেন।

১০) সিঙ্গল উইন্ডো ব্যবস্থায় আফগান শিক্ষার্থীদের ভাতা, বৃত্তি, ভিসার আবেদন সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান করতে হবে।

১১) আমরা ভারতের জনগণ ও গণআন্দোলনকারী সংগঠনসমূহের কাছে আবেদন রাখছি–
ক) আফগান জনগণের স্বাধীনতা, শান্তি ও ন্যায়বিচারের সংগ্রামকে সংহতি জানিয়ে কর্মসূচি নিন।
খ) আফগান শরণার্থীদেরকে উষ্ণ অভ্যর্থনার সাথে তাঁদের দিকে সাহায্য ও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে।
গ) মুসলিম-বিদ্বেষ ছড়াতে যারা তালিবানদের ব্যবহার করবে তাদের সর্বতোভাবে প্রত্যাখ্যান ও প্রতিরোধ করুন।

আওয়াজ-ঈ-নিশান, আইপোয়া, আইসা, সারা ভারত দলিত মহিলা অধিকার মঞ্চ, অল ইন্ডিয়া এশিয়ান ফোরাম ফর হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, তানজীম ঈ ইনসাফ, আনহাদ, বেবাক কালেক্টিভ, ভারতীয় মুসলিম মহিলা আন্দোলন, ক্যাম্পেইন ফর পিস অ্যান্ড ডেমোক্রেসি (মণিপুর), কমিউনালিজম কমব্যাট, কমিউনিটি ফর হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট, ফাও (এফএও), ফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান জার্নালিষ্ট অ্যাসোসিয়েশন, হরিয়ানা জ্ঞান বিজ্ঞান সমিতি, এইচআরএফ, ইনসাফ, খোয়াজা আহমেদ আব্বাস মেমোরিয়াল ট্রাস্ট, খুদাই খিদমতগার, মুসলিম উইমেন'স ফোরাম, এনএপিএম, এনএফআইডব্লিউ, নর্থ ইস্ট নেটওয়ার্ক, ওবিআর ইন্ডিয়া, পিইউসিএল, সবরং ইন্ডিয়া, সহেলি, সাউথ এশিয়া সলিডারিটি গ্রুপ, ইউএএইচ ও অন্যান্য সংগঠন দ্বারা অনুমোদিত।

victory of the left in Peru

লাতিন আমেরিকার নানা দেশে গত তিন দশকে বাম ঝোঁক সম্পন্ন একাধিক সরকারের প্রতিষ্ঠা ও কার্যক্রম আমরা দেখেছি। কিন্তু পেরুতে কখনো বামপন্থীরা জিততে পারেনি। সেখানে বিভিন্ন দক্ষিণপন্থী সরকারই বরাবর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে। এবছর ২৮ জুলাই বামপন্থী প্রার্থী কাস্তিলোর প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ ঘোষণার মধ্যে দিয়ে পেরুতে তাই এক নতুন অধ্যায় শুরু হল।

কাস্তিলো পেরুর রাজনীতিতে নতুন মুখ। যে পার্টির সমর্থনে তিনি নির্বাচনে দাঁড়ান ও বিজয়ী হন সেই ফ্রি পেরু পার্টির সদস্যও তিনি ছিলেন না। ফ্রি পেরু পার্টির সর্বোচ্চ নেতা, কিউবা থেকে পড়াশুনো করা চিকিৎসক ভ্লাদিমির কেরন পেরুর একজন পরিচিত মার্কসবাদী। নির্বাচনে কেরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা রুখতে তাঁকে দুর্নীতি মামলায় জড়িয়ে দেওয়া হয়। শেষ মুহূর্তে কাস্তিলো হন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী।

নির্বাচনী প্রচারের গোটা পর্বে কৃষক পরিবার থেকে উঠে আসা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এই শিক্ষক দেশের আর্থ সামাজিক নীতিমালার আমূল রূপান্তরের কথা বলেন। নিও লিবারাল নীতি থেকে সরে সমাজবাদী নীতিমালার দিকে এগনোর প্রতিশ্রুতি তিনি স্পষ্টভাবে দেন। এজন্য নতুন সংবিধানসভা তৈরি করে ১৯৯৩ সালে তৈরি করা নিও লিবারাল সংবিধানটি বদলে দেওয়ার জন্য এক গণভোটের কথাও তিনি তোলেন। তাঁর প্রচারের মূল কথা ছিল “ধনী দেশ পেরুতে কোনও গরিব থাকবে না”। গত তিন দশক ধরে পেরুতে আর্থিক বিকাশ হয়েছে যথেষ্ট পরিমাণে, কিন্তু তার সুফল মূলত পেয়েছে মুষ্টিমেয় ধনীরা। কাস্তিলোর প্রচার একারণে দেশের বিরাট অংশের মানুষকে প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়।

নির্বাচনী প্রচারে কাস্তিলো তাঁর অর্থনৈতিক পরিকল্পনাকে প্রচারে সুনির্দিষ্টভাবে হাজির করেন। তিনি জানিয়ে দেন ক্ষমতায় এলে তিনি পেরুর সমস্ত প্রাকৃতিক সম্পদকে রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের আওতায় নিয়ে আসবেন। এই বাবদ রাষ্ট্রের আয় থেকে স্বাস্থ্য এবং শিক্ষাখাতে সরকারি ব্যয় বরাদ্দ বৃদ্ধি ও ভরতুকি প্রদানের কথা তিনি বলেন। প্রতিশ্রুতি দেন জাতীয় আয়ের কুড়ি শতাংশ শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় করা হবে। পেরুতে যে সমস্ত বিদেশি কর্পোরেট সংস্থা রয়েছে, তাদের আয়ের সত্তর শতাংশ পেরুতেই পুনর্বিনিয়োগ করার নীতি প্রণয়নের কথাও তিনি বলেন। পেরুর আর্থিক সম্পদের বহির্গমন আটকানোর জন্য বিদেশ থেকে ভোগ্যপণ্য আমদানির ওপর নিয়ন্ত্রণের কথাও তিনি বলেন।

সমাজবাদী বাম ঘরানার এই সামাজিক অর্থনৈতিক নীতিমালার প্রতিশ্রুতি কোভিড জনিত পরিস্থিতিতে জনগণের কাছে আশ্বাসবাণী হিসেবে উপস্থিত হয়। পৃথিবীর আরো নানা জায়গার মতোই পেরুও কোভিডের দিনকালে বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছে। জনসংখ্যার অনুপাতে কোভিডে মৃত্যুর হার সারা পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পেরুতে। ক্ষমতাসীন সরকার কোভিড নিয়ন্ত্রণে যেমন চূড়ান্ত ব্যর্থ হয়েছে, তেমনি বিফল হয়েছে ভ্যাকসিন কর্মসূচিকে মানুষের মধ্যে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রেও। পেরুর তিন কোটি কুড়ি লাখ মানুষের মধ্যে মাত্র পাঁচ শতাংশ দু’ডোজ ভ্যাকসিন পেয়েছেন। কাস্তিলো নির্বাচনী প্রচারে দেশের সব মানুষকে নিখরচায় ভ্যাকসিন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন।

পেরুর সমাজ অর্থনীতিতে মারাত্মক সঙ্কটের প্রেক্ষাপটে এই সমস্ত প্রতিশ্রুতি কাস্তিলোকে বিজয়ী হতে সাহায্য করে। কাস্তিলোর এই বিজয় শুধু পেরুর ইতিহাসেই নয়, লাতিন আমেরিকার সার্বিক রাজনীতিকেই যথেষ্ট প্রভাবিত করবে।

সোভিয়েত ভাঙনের পরে যখন শোনা যাচ্ছিল ইতিহাসের সমাপ্তি ও টিআইএনএ (‘পুঁজিবাদ ছাড়া’ দেয়ার ইজ নো অলটারনেটিভ) জাতীয় তত্ত্বাবলী, সেই সময়েই লাতিন আমেরিকার দেশে দেশে এক ইতিহাস তৈরি হতে থাকে। ১৯৯৮ সালে ভেনেজুয়েলার নির্বাচনে প্রথমবারের জন্য বিজয়ী হয়ে রাষ্ট্রপতি হন হুগো স্যাভেজ। এরপরে বিভিন্ন নির্বাচনে পরপর চারবার বিজয়ী হয়ে তিনি গোটা লাতিন আমেরিকার বামমুখী পটপরিবর্তনের অন্যতম কাণ্ডারীর ভূমিকা পালন করেন। তাঁর মৃত্যুর পরেও তাঁর উত্তরসূরী মাদুরোকে মার্কিন মদতপুষ্ট দক্ষিণপন্থী প্রার্থী পরাস্ত করতে পারেননি। নানা উথালপাথালের মধ্যে দিয়ে ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট মাদুরো স্যাভেজের একুশ শতকের সমাজতন্ত্রের স্বপ্নকেই এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন। কিউবা এবং ভেনেজুয়েলার পাশাপাশি লাতিন আমেরিকার নানা দেশে আমরা বিভিন্ন মাত্রার বামঝোঁক সম্পন্ন সরকার প্রতিষ্ঠিত হতে দেখছি। ২০০২ সালে চিলেতে রাষ্ট্রপতি পদের নির্বাচনে বিজয়ী হন রিকার্ডো লাগোস, ব্রাজিলে লুলা। ২০০৩ সালে আর্জেন্টিনার নির্বাচনে বিজয়ী হন নেসটর কির্কনার, উরুগুয়েতে ২০০৫ সালে নির্বাচনে জেতেন তাবারে ভাজকুয়েজ। ২০০৬ সালে চিলিতে মিশেল বাশালেত, বলিভিয়ায় ইভো মোরালেস, ইকুয়েডরে রাফায়েল কোরেয়া ও নিকারাগুয়ায় ড্যানিয়েল ওর্তেগা রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। ২০০৭ সালে আর্জেন্টিনায় ক্রিস্টিনা ফের্নানদেজ ও গুয়েতমালায় আলভারো কলোম রাষ্ট্রপতি পদে বসেন। প্যারাগুয়েতে ২০০৮ সালে ফের্নাদো লুগা এবং এল সালভাদোরে ২০০৯ সালে মরিসিও ফুয়েনেস রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। সে বছরই ইকুয়েডরে রাফায়েল কোরেয়া ও বলিভিয়ায় ইভো মোরলেস দ্বিতীয় বারের জন্য রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। উরুগুয়েতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন হোসে মুজিকা।

বামপন্থীদের এইসব বিজয়ের বিরুদ্ধে দক্ষিণপন্থী শিবিরের পক্ষ থেকে সব সময়েই নানা ধরনের ষড়যন্ত্র চালানো হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও বহুজাতিক কর্পোরেট লবি এই সব ষড়যন্ত্রে দেশগুলির দক্ষিণপন্থী শক্তিকে নানাভাবে মদত দিয়ে যায়। কিছুদিন আগেই আমরা দেখেছি ২০১৯’র নির্বাচনে বলিভিয়ায় মোরালেস বিজয়ী হবার পরেও মার্কিন রাষ্ট্র ও কর্পোরেটদের মদতে সেই জয়ের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচার চলে। জনগণের একাংশকে প্রভাবিত করতে সক্ষম হয় কর্পোরেট প্রচারযন্ত্র। ইভো মোরালেস বাধ্য হন দেশ ছেড়ে চলে যেতে। নির্বাচনে জিতেও লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক আশ্রয়ে একটা গোটা বছর কাটাতে হয় তাকে।

কিন্তু এই চক্রান্তের সাফল্য দীর্ঘমেয়াদি হয়নি। মাত্র এক বছরের মধ্যে পুনরায় আয়োজিত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয় পান ইভো মোরালেসের দল মুভমেন্ট ফর সোসালিজম-এর রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী লুইস আর্ক। যিনি আগে মোরালেসের শাসনকালে বলিভিয়ার অর্থমন্ত্রী ছিলেন। আর্ক শুধু যে জিতেছেন তাই নয়, এই জয়ের মার্জিন বুঝিয়ে দিয়েছে একবছর আগের দক্ষিণপন্থী চক্রান্তর চাকাকে উল্টোদিকে ঘুরিয়ে দিতে বলিভিয়ার জনগণ কতটা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন। লুইস আর্ক যেখানে ৫২ শতাংশ মতো ভোট পেয়েছেন, দ্বিতীয় স্থানে থাকা কার্লোস মেসা সেখানে পেয়েছেন ৩১ শতাংশের মতো। মনে রাখতে হবে মোরালেস ও মুভমেন্ট ফর সোসালিজম বিরোধী ভোট যেন ভাগ না হয়, তাই নিয়ে বিরোধিরা যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করেছিলেন। মোরালেস বিরোধী ক্যু-এর পর প্রেসিডেন্ট হিসেবে যিনি দায়িত্ব নেন, কনজারভেটিভ পার্টির সেই নেতা জেনাইন আনিয়েজ নিজেকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন থেকে সরিয়ে নেন। কিন্তু এতদসত্ত্বেও কার্লস মেসা মুভমেন্ট ফর সোসালিজম প্রার্থী আর্ককে যথেষ্ট প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ফেলতে পারেননি, পিছিয়ে থেকেছেন বিরাট ব্যবধানে।

পেরুর সাম্প্রতিক নির্বাচনে কাস্তিলোর বিজয়কেও দক্ষিণপন্থী শিবির মেনে নিতে পারেনি। নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর নানাভাবে তার বিজয়কে অস্বীকার করতে চেয়েছে। এই নির্বাচনে কাস্তিলো পরাজিত করেছিলেন সে দেশের পরিচিত দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক মুখ কেইকো ফুজিমোরিকে। নির্বাচনের ফল প্রকাশের পরই ফুজিমোরি নির্বাচন কমিশনকে বলেন দেশের আন্দিয়ান এলাকায় প্রদত্ত দু’লাখ ভোটকে বাতিল ঘোষণা করতে হবে, যার অধিকাংশই পেয়েছিলেন কাস্তিলো। একমাস ধরে নানা ধরনের তদন্ত ও বিচার বিবেচনার পর পেরুর নির্বাচন কমিশন ফুজিমোরির দাবিকে বাতিল করে কাস্তিলোকেই বিজয়ী বলে ঘোষণা করেন। ফুজিমোরি শিবির এতেও না দমে গোটা নির্বাচন প্রক্রিয়াকে ‘অর্গানাইজেশন অব আমেরিকান স্টেটস’কে দিয়ে পুনরায় খতিয়ে দেখার কথা বলেন। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য এই সংস্থাটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গুলি হেলনে চলে এবং এই সংস্থাই ২০১৯এ নির্বাচনী বিজয়ের পরেও বলিভিয়ায় ইভো মোরালেসকে ক্ষমতা থেকে অপসারণে বড় ভূমিকা নিয়েছিল নির্বাচনী কারচুপির অভিযোগ তুলে। পেরুর সরকার অবশ্য ফুজিমোরির দাবিকে মেনে নেয়নি এবং কাস্তিলোকেই তারা প্রেসিডেন্ট পদে শপথ নিতে বলে। ২০২১’র ২৮ জুলাই, স্পেনের অধীনতা থেকে পেরুর মুক্তির ঐতিহাসিক ২০০ বছর পূর্তির দিনে কাস্তিলো সাম্প্রতিক সময়ে পেরুর প্রথম বামপন্থী প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন।

কাস্তিলো প্রেসিডেন্ট পদে বসলেও তাঁর শাসন একেবারেই নিষ্কন্টক নয়। পেরুর রাজনীতির ক্ষমতা ভারসাম্য এখনো প্রবলভাবেই দক্ষিণপন্থী শিবিরের দিকে হেলে আছে। যে ফ্রি পেরু পার্টির সমর্থনে কাস্তিলো নির্বাচনে জিতলেন তারা সংসদে সংখ্যালঘু। ১৩০ আসন বিশিষ্ট পেরুর সংসদে তাদের সাংসদ ৩৭ জন। সংসদে দক্ষিণপন্থী শিবিরের পাল্লা অনেক ভারি। দেশের সেনা বাহিনীর প্রধান সিজার আস্তিদিলোও নয়া প্রেসিডেন্টের প্রতি বিরূপ। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পরাজিত কিন্তু বৃহত্তম পার্টির নেতা কুইকো ফুজিমোরি হুমকি দিয়ে রেখেছেন কাস্তিলোর মত কমিউনিস্ট যেন দেশকে ধ্বংস করতে না পারেন, সংবিধান বদলে দিতে না পারেন, তারজন্য তিনি যা করার করবেন। নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসীন হলেও কাস্তিলোর শাসন কীভাবে এগোবে তা মূলত নির্ভর করবে পেরুর ক্ষমতাশালী শিবির ও জনগণের বৃহৎ অংশের দ্বন্দ্বজাত ক্ষমতা ভারসাম্যের ওপরেই। বিশ্বের সমস্ত বাম গণতান্ত্রিক শক্তির শুভেচ্ছা এই যুদ্ধে পেরুর জনগণের পাশেই থাকবে। চোখ থাকবে পেরুর ক্ষমতার রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সামাজিক ভারসাম্য বদলের লড়াইয়ের দিকে।

- সৌভিক ঘোষাল

Haradhan Adak

Commemoration meeting

১৯ নভেম্বর বৈঁচি কোল্ড স্টোরেজে কমরেড হারাধন আদকের স্মরণ সভা অনুষ্ঠিত হয়, যে কোল্ড স্টোরেজে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন হারুদা, হিমঘর শ্রমিকদের দাবিতে লড়াই চালিয়েছেন। স্মরণ সভায় উপস্থিত হয়েছিলেন সিটুর কর্মী হিমঘর শ্রমিক পার্থ পাত্র, ভোলা, উপস্থিত ছিলেন বৈঁচি অঞ্চলের সিপিআই(এমএল) সহযোদ্ধারা। হারুদার স্মৃতিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি পাঠ করেন বিনোদ আহির এবং সকলে প্রতিকৃতিতে পুষ্প অর্পণ করেন। সঞ্চালক মুকুল কুমার, পার্টির জেলা সম্পাদক প্রবীর হালদার, তাঁর পুত্র দেবাশিস এবং অন্যান্য বক্তাদের কথায় উঠে আসে এক নিরলস পার্টিজান মানুষের কথা, যার বোর্ডে দেশব্রতী লাগাতে, নিয়মিত পত্রিকা হকিং করতে, সময় মেনে প্রতিটা কর্মসূচিতে যোগদানে ছেদ পড়তো না। উঠে আসে দারিদ্র্যের মধ্যেও গ্রামে আসা কমরেডদের আহারের ব্যবস্থা করা, “ত্রিশূল হাতে যতই লাফাও, কোম্পানি রাজ কায়েম হতে দিচ্ছি না, দেবো না”, নিজের মতোই সোজা সাপটা লব্জে তার কথাগুলো। বর্তমান সময়ে ফ্যাসিবাদকে রোখার অঙ্গীকার গ্রহণের মধ্যে দিয়ে স্মরণ সভার কাজ শেষ হয়।

Manik Ghosh

জলপাইগুড়ি জেলার দীর্ঘদিনের সিপিআই(এমএল) সদস্য মানিক ঘোষ ২১ সেপ্টেম্বর ভোরবেলা জলপাইগুড়ি জেলা হাসপাতালে প্রয়াত হয়েছেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর। জেলার প্রয়াত সম্পাদক শংকর দাসের সান্নিধ্যে মানিকদা পার্টির সাথে যুক্ত হয়েছিলেন পরিবহন আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। পরিবহন শিল্পে শ্রমিকদের নায্য দাবি আদায়ের আন্দোলনে মানিক ঘোষ ছিলেন অন্যতম সেনাপতি। তাঁর হাত ধরেই ভারতীয় মোটর কর্মী ইউনিয়ন এআইসিসিটিইউ'র অন্তর্ভুক্ত হয়। জলপাইগুড়ি-শিলিগুড়ি মিনিবাস ইউনিয়নকেও তিনি অন্তর্ভুক্ত করান। বাস শ্রমিকদের মজুরি, বোনাসের দাবিতে আন্দোলনের সফলতায় তাঁর লড়াকু ভূমিকা আজও শহরের আলোচ্য বিষয়। তিনি পরিবহন শ্রমিকদের নেতা থেকে পার্টির জলপাইগুড়ি জেলা কমিটির সদস্য হয়েছিলেন। পার্টির রাজ্য কর্মসূচিগুলোকে জেলায় সফল করে তুলতে সামনে দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব দিতেন। গোশালা মোড়ে ভারতীয় মোটর কর্মী ইউনিয়নের অফিস গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ছিলেন অন্যতম সেনাপতি। জলপাইগুড়ি শহরে এফ সি আই গোডাউন বন্ধের বিরুদ্ধে মানিকদার নেতৃত্বে পরিবহন শ্রমিকদের আন্দোলন স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তিনি এআইসিসিটিইউ'র একসময় রাজ্য সহ সভাপতি ছিলেন। বোনাসের মিটিংয়ে উপস্থিত থাকলে মালিকরা দাবি মানতে বাধ্য হত। মিনি বাসের কন্ডাক্টর থেকে জীবন্ত আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সামগ্রিক পার্টি নেতা হয়ে উঠেছিলেন। শারীরিক অসুস্থতার জন্য মানিকদা শেষ দিকে অক্ষম হয়ে পড়েছিলেন। সমস্ত বাধা কাটিয়ে বিধানসভা নির্বাচনের আগে দীপংকর ভট্টাচার্যের জলপাইগুড়ি জেলার কর্মী বৈঠকে উপস্থিত হয়েছিলেন। কমরেড মানিকদার মৃত্যুতে পরিবহন শ্রমিকদের আন্দোলনের বিরাট ক্ষতি হয়ে গেল।

পার্টির রাজ্য কমিটি তাঁর শোক সন্তপ্ত পরিবারকে গভীর সমবেদনা জানাচ্ছে।

কমরেড মানিক ঘোষ লাল সেলাম।

convention in siliguri

 

শিলিগুড়িতে ট্রেড ইউনিয়নগুলোর যৌথ সভা

খণ্ড-28
সংখ্যা-34