কমিউনিস্ট নারীবাদী গীতা দাসের অষ্টম মৃত্যুবার্ষিকী স্মরণ
Commemoration of  anniversary

কমরেড গীতা দাস বলতেন, “আমাকে কেউ কেউ নারীবাদী বলেন। ঠিকই তো আমি অবশ্যই একজন নারীবাদী ! যতদিন নারীদের উপর অবিচার এক জীবন্ত বাস্তব হয়ে থাকছে, ততদিন আমাদের সকলের কী তাই হওয়া উচিত নয়?”

সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির প্রথম সর্ব ভারতীয় সভানেত্রী, সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের কন্ট্রোল কমিশনের সদস্যা, আশির দশকে আইপিএফ, নারী নির্যাতন প্রতিরোধ মঞ্চের রাজ্য ও জাতীয় স্তরের নেত্রী, গীতা দাসের জীবন ভারতের বামপন্থী নারীবাদী ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।

গত ২৪ অক্টোবর, সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের রাজ্য কমিটির অফিসে গীতা দাসের অষ্টম স্মরণ সভায় কমরেডদের স্মৃতিকথায় উঠে এল সত্তরের দশকে নকশালপন্থী রাজনীতির সাথে যুক্ত হওয়া গীতা দাসের অদম্য জেদ আর অফুরান স্নেহে ভরা বিপ্লবী জীবনের ছবি। গীতা দাসকে কেউ মনে রেখেছেন জননেত্রী হিসাবে, কেউ মুশকিল-আসান হিসাবে, আবার কারো কাছে তিনি রাজনীতিতে আসার অনুপ্রেরণা। তাঁর ভাষণ সম্মোহিতের মতো শুনতেন পথচলতি জনতা। মাইলের পর মাইল হেঁটে প্রত্যন্ত এলাকায় অক্লান্ত বলে চলতেন শাসক শ্রেণীর দুরাচারের বিরুদ্ধে। পিতৃতান্ত্রিক আচারের ঘোর বিরোধী গীতা মানুষের সাথে মিশে কাজ করার জন্য বিবাহের চিহ্ন বহন করার বাধ্যতাকে আমল দেননি কোনো দিনই। সংগঠনে যুক্ত হয়া নবীন সদস্যাদের পোশাক, বিধির সামন্ততান্ত্রিক বাঁধন ভেঙ্গে ফেলতে উৎসাহিত করতেন। সংসারের লক্ষণরেখা ভেঙ্গে বহু মেয়েকে সক্রিয় রাজনীতির আঙিনায় নিয়ে এসেছিলেন। রাষ্ট্রের দালাল পুলিশ থেকে শুরু করে ব্রাহ্মণ্যবাদী পিতৃতন্ত্রের দালাল শঙ্করাচার্য, ক্ষমতার সাথে চোখে চোখ রেখে লড়াই করার সাহসের নাম গীতা দাস। একইসাথে কমরেডদের জন্য স্নেহ আর ভরসার নীড়ের নামও গীতা দাস। মার্কসবাদ আর নারীবাদের ওতপ্রোত আন্তঃসম্পর্ককে নিজের জীবন দিয়ে উদযাপন করেছেন।

একদা পূর্ববঙ্গের (বাংলাদেশ) ফরিদপুর জেলার কোটালী পাড়ায় জন্ম, দেশভাগের পর কলকাতায় চলে আসা গীতার পরিবার উদ্বুদ্ধ হয়েছিল বামপন্থী আদর্শে। বামপন্থী সাহচর্যে বেড়ে ওঠায় সাম্যবাদের প্রতি তাঁর ঝোঁক ছিল সহজাত। অসম্ভব দারিদ্র্যের মধ্যে পড়াশোনা চালানো কিশোরী গীতার স্কুল-জীবনেই এক সিপিআই কর্মীর সাথে বিবাহ হয়। এক সন্তানের জন্ম দেওয়ার পরেও ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। বেহালা সরিষা রামকৃষ্ণ মিশনে সন্তানকে নিয়ে হোস্টেলে থেকে প্রাইমারি টিচার বেসিক ট্রেনিং কোর্স করেন এবং ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হন। এরপরে তিনি কলকাতা কর্পোরেশন স্কুলে শিক্ষকতার কাজে যুক্ত হন। স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির বিপরীতে গিয়ে নকশালপন্থী কমরেডদের নিজের বাড়িতে সুরক্ষিত আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতেন। পরিবারের সাথে লড়াই করে বিপ্লবী আন্দোলন চলাকালীন সংবাদবাহকের কাজ করে গেছেন। পার্টির প্রতি তাঁর ভালোবাসা ও অঙ্গীকার ছিল অটল। মানুষের মাঝে কাজ করার জন্য বিবাহ ভেঙ্গে সন্তানদের নিয়ে বেরিয়ে আসেন। বর্জন করেন স্বামীর পদবি আর বিবাহের সমস্ত চিহ্ন। শিক্ষকতা করে সন্তানদের বড়ো করার পাশাপাশি জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত নকশালবাড়ির চেতনায় ভর করে সমাজ বদলানোর কাজে ব্রতী থেকেছেন। গীতা মনে করতেন, নারীমুক্তির প্রাথমিক ধাপ হল রোজকারের লিঙ্গ-ভিত্তিক বঞ্চনার বিরুদ্ধে লড়তে শেখা।

১৯৮২ সালে মথুরা ধর্ষণকাণ্ডে যখন সারা দেশ উত্তাল, আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারী দিবসে, ভারতে নারীদের প্রতি রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক হিংসার বিরুদ্ধে বিভিন্ন নারী সংগঠনকে সংঘবদ্ধ করে, কলকাতায় ব্যপক প্রতিবাদ কর্মসূচি গড়ে তুলেছিলেন। ১৯৮০-র দশকে পার্টির গোপন অবস্থায় রাজ্য ও জাতীয় স্তরে ইন্ডিয়ান পিপলস ফোরামের জাতীয় ও রাজ্যস্তরের নেতৃত্বের অন্যতম ছিলেন গীতা দাস। পশ্চিমবঙ্গে প্রগতিশীল মহিলা সমিতি (PWA) গড়ে তোলার পিছনে মুখ্য ভূমিকা ছিল তাঁর। ১৯৯৪ সালে জাতীয় স্তরে সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতি গড়ে তোলা হয় এবং গীতা দাস প্রথম সর্বভারতীয় সভাপতি নির্বাচিত হন। বন্দীমুক্তি আন্দোলনের অন্যতম মুখ ছিলেন তিনি। পাশাপাশি, বানতলা ধর্ষণকাণ্ড, সিঙ্গুরে জমিগ্রাস সহ প্রতিটি রাষ্ট্রীয় হামলার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন। আদর্শগত ফারাক সত্ত্বেও, লিঙ্গ-ভিত্তিক নিপীড়নের মোকাবিলায় বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যাক্তিবর্গকে একত্রিত করতে উদ্যোগী থাকতেন বরাবর। তাঁর দৃঢ় ব্যাক্তিত্ব ও মধুর আচরণে রাজনৈতিক কর্মী ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার পাত্রী হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর আহ্বানে পশ্চিমবঙ্গে আইপোয়া প্রকাশিত “প্রতিবিধান” পত্রিকার সাথে যুক্ত হয়েছিলেন নবনীতা দেবসেন, মৈত্রেয়ী চট্টোপাধ্যায়, মধুছন্দা কার্লেকর, সুদেষ্ণা চক্রবর্তীর মতো বিশিষ্টজনেরা। নারী আন্দোলনের স্বার্থে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল আরতি গাঙ্গুলি, ঝর্ণা ভৌমিক, যশোধরা বাগচীদের মতো প্রতিনিধিদের সাথে।

কমরেড গীতা দাসের অষ্টম স্মরণ সভায় সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির সদস্যরা ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের জাতীয় ও রাজ্য স্তরের নেতৃত্ব। সভা থেকে প্রস্তাব ওঠে, বামপন্থী ও নারীবাদী ইতিহাসের সাক্ষ্য হিসাবে ও মনুবাদী-কর্পোরেট রাজকে প্রতিহত করতে কমরেড গীতা দাসের জীবনকে পুনরায় আবিষ্কাবর জরুরি। সমাজের প্রতিটি অসাম্য ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে অকুতোভয় যোদ্ধা গীতা দাসের জীবন বামপন্থা ও নারীবাদের যৌথ সংগ্রামের পাথেয় হোক।

- সম্প্রীতি মুখার্জী

খণ্ড-28
সংখ্যা-37