খবরা-খবর
ময়নাগুড়ির গ্রামে সাম্প্রদায়িক হামলা
village of Mainaguri

বাংলাদেশে পুজোর মন্ডপে কোরানের অবমাননার অভিযোগকে কেন্দ্র করে মৌলবাদী সন্ত্রাসের প্রতিবাদের নামে ২৩ অক্টোবর জলপাইগুড়ি জেলার ময়নাগুড়ি ব্লকের রাজারহাটে প্রথমে দিনের বেলা বিজেপি সমর্থকেরা জড়ো হয়ে সাম্প্রদায়িক জিগির তোলার চেষ্টা করে। কিন্তু স্থানীয় তৃণমূল কর্মীরা তাড়া করলে তারা পালিয়ে যায়। এরপর সেদিনই সন্ধ্যা নাগাদ বাঁকালি বাজারে প্রায় ৫০ জনের মতো বাহিনী ‘হিন্দু বাঁচাও, মুসলিম তাড়াও’ শ্লোগান দিতে দিতে বাজারের কয়েকটি দোকান ভাঙচুর করে। তারপরে বার্ণিশ এলাকার গোলার বাড়ি গ্রামে মসজিদ ও সংলগ্ন মাদ্রাসার সামনে একটি মিছিল নিয়ে এসে আওয়াজ তোলা হয়, ‘মুসলিম তাড়াও, দেশ বাঁচাও’ ইত্যাদি। সেখানে উপস্থিত সংখ্যালঘু নমাজীদের বলা হয় যে মাইক ব্যবহার করে আজান দেওয়া যাবে না। এই কথা বলে পরিকল্পিতভাবে বচসা তৈরি করা হয় এবং মিছিল থেকে ঢিল, পাটকেল ও ধারালো অস্ত্র নিয়ে স্থানীয় মানুষজনের ওপর হামলা নামানো হয়। স্থানীয় মাদ্রাসার শিক্ষকের খোঁজ করতে থাকে। সেই সময় স্থানীয় মুসলিম জনগণ প্রতিরোধ করলে তারা পালিয়ে যায়। এবং কিছুটা দূরে গিয়ে ঢিল ছুড়তে থাকে। ঢিলের আঘাতে ঘটনাস্থলে তিনজন সংখ্যালঘু গ্রামবাসী আহত হয়। আহত দু’জনকে জলপাইগুড়িতে সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং তৃতীয় ব্যক্তি উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজে গুরুতর আঘাত নিয়ে চিকিৎসাধীন। এলাকায় গত রাত থেকে পুলিশ ও রাফ মোতায়েন করা হয়েছে। তবুও এলাকাজুড়ে আতঙ্কের পরিবেশ রয়েছে।

সকালে সিপিআই(এমএল) জেলা নেতা শ্যামল ভৌমিক আক্রান্ত পরিবারগুলির কয়েকজন সদস্যের সঙ্গে কথা বলেছেন। রাজ্য নেতা পবিত্র সিংহ মেডিক্যাল কলেজে আহত ব্যক্তির সঙ্গে দেখা করে তাঁর সুচিকিৎসার দাবি নিয়ে তৎপর আছেন। পার্টি এলাকায় শান্তি ও সম্প্রীতির বাতাবরণ ফিরিয়ে আনতে হামলার ঘটনায় জড়িত বিজেপি- আরএসএস সন্ত্রাসীদের চিহ্নিত করে গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছে এবং সেইসঙ্গে পুলিশী ব্যবস্থা জোরদার করতে এলাকায় অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প স্থাপনের দাবি করেছে। ইতিমধ্যেই স্থানীয় সমস্ত স্তরের মানুষ একত্রিত হয়ে আজ সকালে ঘটনা স্থলে উপস্থিত ডিআইজি-র সাথে সাক্ষাত করে। স্থানীয় বিডিও, জেলাশাসক প্রভৃতি ক্ষেত্রে অবহিত করা হয়েছে। পুলিশ ১০/১২ জনকে চিহ্নিত করেছে। সমস্ত স্তরের মানুষদের সমবেত করে ২৬ অক্টোবর রাজারহাটে শান্তি ও সম্প্রীতির মিছিল সংগঠিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে।

দাবি তোলা হয়েছে —

মুখ্যমন্ত্রীর উত্তরবঙ্গ সফরের প্রাকলগ্নে এমন নিকৃষ্ট সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের ঘটনার দায় রাজ্য প্রশাসনকে নিতে হবে এবং মুখ্যমন্ত্রীকে রাজ্যের সর্বত্র মৌলবাদী চক্রান্তের মোকাবিলায় বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করতে হবে।

ময়নাগুড়ির ঘটনার পরিদর্শন করে তথ্যানুসন্ধানী রিপোর্ট

শিলিগুড়ি থেকে পিনাকী ব্যানার্জী, অঘোর ভট্টাচার্য, পুলক চক্রবর্তী, মুক্তি সরকার ও পার্থ চৌধুরী সমন্বিত এক তথ্যানুসন্ধানী দল ২৬ অক্টোবর ময়নাগুড়ি'র ধর্মপুর গ্রামের গোলারবাড়ি, হাসপাতাল পাড়া, সর্দার পাড়ায় গত ২৩ অক্টোবর রাতে ঘটে যাওয়া সাম্প্রদায়িক হামলার প্রকৃত চিত্র জানতে সেখানে হাজির হয়েছিলেন। ৩টি জায়গা ঘুরে সবকিছু দেখে এবং ওখানকার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় যে, গোলারবাড়ি মাদ্রাসায় আক্রমণ করে ওখানকার মৌলানাকে মারধর করা হয়। সঙ্গে আরও কয়েকজনও আক্রান্ত হয়। ৩০/৪০ জনের মিছিল “মুসলমান হটাও-দেশ বাঁচাও” জাতীয় শ্লোগান দিয়ে মাদ্রাসা ভাঙচুর করে এবং বড় বড় পাথরও ছোড়ে। সেই পাথরের আঘাতে ৩ জন গুরুতর আহত হয় এবং একজনকে ওই রাতেই প্রথমে জলপাইগুড়ি হাসপাতাল ও পরে সেখান থেকে মেডিকেল কলেজে স্থানান্তরিত করা হয়। ওই মিছিল একইভাবে হাসপাতাল পাড়া ও সর্দার পাড়াতেও তান্ডব চালায়। হাসপাতাল পাড়ার “ওয়াক্ত কি ঘর”-এর তেমন ক্ষতি না করলেও সর্দার পাড়ার মাদ্রাসায় ব্যাপক ভাঙচুর সহ মাইক ভেঙে ফেলে এবং এ্যামপ্লিফায়ার নিয়ে চলে যায়। তিন জায়গাতেই মানুষ এখনও আতঙ্কে। ঘটনার পরে পুলিশ ৪ জনকে গ্রেপ্তার করে এবং এলাকায় পুলিশ পিকেট বসায়, এলাকাবাসীকে ভয় না পাওয়ার আশ্বাস দেয়। কিন্তু ওখানকার মানুষ এখনও আতঙ্কগ্রস্ত। তথ্যানুসন্ধানী দল যাওয়াতে তাঁরা খানিকটা মনোবল ফিরে পেয়েছেন একথা বারবার বলেন। তথ্যানুসন্ধানী দল তাঁদের ভয় না পাওয়ার কথা বলে। ফোন নম্বরগুলো দিয়ে বলে আসে যেকোন প্রয়োজনে যোগাযোগ করলে অবশ্যই পাশে পাবেন। সবার সঙ্গে কথা বলে মনে হল প্রত্যক্ষভাবে গ্রাম পঞ্চায়েতের দলবদলু বিজেপি প্রধানের হাত আছে গোটা ঘটনার পেছনে। যদিও এলাকার মানুষেরা মুখ ফুটে একথা বলছেন না। এবং আমাদের বিশ্বাস বাংলাদেশের ঘটনাও ইন্ধন জুগিয়েছে। সমগ্র বিষয়টি জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে স্মারকলিপি পাঠিয়ে ওঁদের নিরাপত্তা বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার আবেদন রাখা হবে অচিরেই — এমনটাই প্রাথমিকভাবে স্থির হয়েছে।

খণ্ড-28
সংখ্যা-37