বিএসএফ-এর অধিক্ষেত্র বাড়ানো যুক্তরাষ্ট্রীয়তা ও আইনের শাসনের ওপর হামলা
Assault on Federalism

সারা দেশ যখন লখিমপুর খেরির কৃষক হত্যাকাণ্ডের মূল নায়ক ও সংগঠক মন্ত্রী অজয় মিশ্রর (এই অজয় মিশ্রকে কিছুদিন আগে স্বরাষ্ট্র দপ্তরের রাজ্য প্রতিমন্ত্রী তথা অমিত শাহের ডেপুটি হিসেবে মোদীর ক্যাবিনেটে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল) পদত্যাগ দাবি করছে তখন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক চুপিচুপি আরেকটি প্রবল জনবিরোধী অর্ডার পাস করল। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক একটি নির্দেশিকা জারি করে সীমা সুরক্ষা বলের অধিক্ষেত্র বাড়িয়ে দিল। পূর্ব ও পশ্চিম সীমান্তের আসাম, পশ্চিমবঙ্গ ও পাঞ্জাব রাজ্যে ১৫ কিলোমিটার থেকে বাড়িয়ে ৫০ কিলোমিটার করা হয়েছে বিএসএফ’এর অধিক্ষেত্র। গুজরাট রাজ্যের ক্ষেত্রে আগে ছিল ৮০ কিলোমিটার, এখন কমিয়ে করা হয়েছে ৫০ কিলোমিটার। এই নির্দেশিকা অনুসারে সীমান্ত থেকে দেশের ৫০ কিলোমিটার ভেতর পর্যন্ত বিএসএফ তল্লাশি চালানো, গ্রেপ্তার করা ও বাজেয়াপ্ত করার অভিযান চালাতে পারবে সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের অনুমতি ছাড়াই।

১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময়ে সীমা সুরক্ষা বল গঠন করা হয়েছিল ভারতের আন্তর্জাতিক সীমা সুরক্ষিত রাখতে। গত পাঁচ দশকে এই সীমা সুরক্ষা বাহিনী প্রভূত পরিমাণে বৃদ্ধি ঘটানো হয়েছে আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সুরক্ষিত রাখতে, রাষ্ট্রের ভাষায় কাউন্টার-ইনসার্জেন্সি ও কাউন্টার-টেররিজমের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে। অন্যান্য আধাসামরিক বাহিনীর মতো বিএসএফ’ও মানবাধিকারের ব্যাপক অবমাননার অভিযোগে অভিযুক্ত। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে বাংলাদেশের সাথে ভারতের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বিকাশের ক্ষেত্রে বিএসএফ বারবার সমস্যার বিষয় হয়ে উঠেছে। কিন্তু, সীমান্ত এলাকায় বসবাসকারী ভারতীয়দের যে অত্যাচার ও হয়রানি সহ্য করতে হয় তা সেভাবে নথিভুক্ত ও চর্চিত হয়নি।

সীমান্ত এলাকায় বসবাসকারী মানুষেরা কোনও অভিযোগ দায়ের করতে অত্যন্ত ভীতসন্ত্রস্ত থাকেন। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের পৃষ্ঠপোষকতায় বিএসএফ এইসব এলাকায় সবরকমের ছাড় পেয়ে যায়, অনেকটা যেমন কুখ্যাত ‘আফস্পা’ আইনে সশস্ত্র সেনা ভয়ঙ্কর ‘বিশেষ ক্ষমতা’ পেয়ে থাকে। বর্তমান নির্দেশিকাটি পাঞ্জাব ও পশ্চিমবঙ্গে বিএসএফ’এর অধিক্ষেত্রকে তিনগুণের বেশি বাড়িয়ে দেবে। বিজেপির অভিবাসী-বিরোধী বিষাক্ত প্রচার এবং প্রতিবেশি দেশের সঙ্গে নাগরিকত্ব ও ভিসা সংক্রান্ত বিষয়ে হিংস্র সাম্প্রদায়িক অভিযানের কথা মাথায় রাখলে বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে বিএসএফ’এর এই বর্ধিত অধিক্ষেত্র ও ক্ষমতাবৃদ্ধি সেই অভিবাসী-বিরোধী অভিযানকেই আরও তীব্র করার কাজে ব্যবহৃত হবে এবং সীমান্ত এলাকায় এক স্থায়িরূপে বিভাজিত পরিবেশ কায়েম করবে।

বিএসএফ’এর অধিক্ষেত্র পরিবর্তন সংক্রান্ত নতুন নির্দেশিকাকে বৈধ করার চেষ্টা হচ্ছে কাজকর্ম চালানো ও অপরাধ দমনের কার্যকরী পদক্ষেপ হিসেবে। ঘটনা হল, গুজরাটে, যেখানে অধিক্ষেত্র ৮০ কিলোমিটার পর্যন্ত প্রসারিত ছিল, সেখানে মেগা স্মাগলিং ব্যবসায় রমরমা চলে। গত সেপ্টেম্বরেই তো বিপুল পরিমাণ, ৩০০০ কিলোগ্রাম, হেরোইন ধরা পড়ে গেল গুজরাটের কচ্ছে আদানি মালিকানায় চলা মুন্দ্রা বন্দরে। বিএসএফ’এর বর্ধিত অধিক্ষেত্র আসলে রাজ্যের আইনশৃঙ্খলার প্রশ্নে পেছনের দরজা দিয়ে কেন্দ্রের অবৈধ অনুপ্রবেশ। ঘটনাচক্রে, ইউপিএ সরকারের আমলে নরেন্দ্র মোদী গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন উচ্চকন্ঠে বিরোধিতা করেছিলেন বিএসএফ’এর ক্ষমতা বাড়ানোর প্রস্তাবকে যুক্তরাষ্ট্রীয়তার ওপর আক্রমণ হিসেবে চিহ্নিত করে। ২০১২’র এপ্রিল মাসে মনমোহন সিংকে অত্যন্ত কড়া শব্দ প্রয়োগে চিঠি লিখেছিলেন নরেন্দ্র মোদী রাজ্যের মধ্যে আরেক রাজ্য গঠন ও কেন্দ্র কর্তৃক রাজ্যের ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা বলে বর্ণনা করে।

আজ কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলিকে মোদী সরকার অত্যন্ত ব্যবস্থিতভাবে ব্যবহার করছে বিরোধী-শাসিত রাজ্য সরকারগুলির বিরুদ্ধে, রাজ্যের ক্ষমতা ও অধিকার খর্ব করতে। সিবিআই ও ইডি এবং এখন বিএসএফ — কেন্দ্রীয় এজেন্সি ও কেন্দ্রীয় বাহিনী মোদী সরকারের রাজনৈতিক অভিসন্ধি চরিতার্থ করতে বিভিন্নভাবে লাগাতার রাজ্য সরকার ও রাজ্য প্রশাসনের কর্তৃত্বকে খর্ব করে চলেছে। মোদী সরকারের অতিকেন্দ্রীকরণ অভিযান আইন প্রণয়ন ও অন্যান্য বিষয়ে ইউনিয়ন সরকার ও রাজ্য সরকারের মধ্যে ক্ষমতাভাগের সংবিধান প্রদত্ত যুক্তরাষ্ট্রীয়তার নির্দেশনাকে হাস্যকর করে তুলছে। রাজ্যের ক্ষমতাকে অন্যায়ভাবে নিজের হাতে নেওয়ার সবচেয়ে ন্যক্কারজনক উদাহরণ হল সাম্প্রতিক তিন কৃষি আইন। নয়া শিক্ষানীতি বা নীট (ডাক্তারি পড়তে একটিই কেন্দ্রীয় পরীক্ষা) থেকে শুরু করে জিএসটি ও কৃষি আইন, মোদী সরকারের প্রতিটি প্রধান উদ্যোগে রাজ্যের ক্ষমতাকে ক্ষয় করা হয়েছে। এরসাথে, সবচেয়ে মারাত্মক উদাহরণ হিসেবে আছে জম্মু ও কাশ্মীর। সেখানে রাতারাতি একটি রাজ্যের শুধু সাংবিধানিক পরিচিতি ও ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হয়েছে তাই নয়, রাজ্য হিসেবে অস্তিত্বই শেষ করে দিয়ে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে অবনমিত করা হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে দিল্লী ও লক্ষদ্বীপেও অনুরূপ আগ্রাসন চলেছে কেন্দ্রের। বিএসএফ তার মনযোগ কেন্দ্রীভূত করুক দেশের আন্তর্জাতিক সীমানা সুরক্ষিত রাখার কাজে। বিএসএফ’এর বর্ধিত অধিক্ষেত্র ও ক্ষমতা সীমা সুরক্ষা বল হিসেবে তার ঘোষিত কার্যকারিতাকেই দুর্বল করে তুলবে, ভারতের ইতিমধ্যে ক্ষয়ে যাওয়া মানবাধিকার পরিস্থিতি ও যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে দুর্বল করে তুলবে। মোদী সরকারের রাজনৈতিক অভিসন্ধি পূরণের হাতিয়ার হিসেবে বিএসএফ’কে ব্যবহার করা বন্ধ করতে হবে।

(এম-এল আপডেট সম্পাদকীয়, ১৯ অক্টোবর ২০২১)

খণ্ড-28
সংখ্যা-37