বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার প্রতিবাদ দুই বাংলা জুড়েই
across two Bengals

বাংলাদেশে প্রতি বছরের মতো এবারও কয়েক হাজার মণ্ডপে হচ্ছিল বারোয়ারি দুর্গা পুজো। কিন্তু সপ্তমীর মাঝরাতের পর থেকেই এই পুজোকে কেন্দ্র করে এমন কিছু ঘটনা ঘটে, যা চলে আসে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমের নজরে। ভারতে বিশেষত পশ্চিমবাংলার সর্বত্র তা চর্চিত হতে থাকে। বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ, আশঙ্কা, ক্ষোভ, প্রতিবাদ আছড়ে পড়তে থাকে দুই বাংলা জুড়েই।

কুমিল্লার একটি পূজামণ্ডপকে কেন্দ্র করে শুরু হয় দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা পরম্পরা। পূজামণ্ডপটি ছিল কুমিল্লা শহরেই নানুয়াদীঘির পাড়ে, যে দীঘির চারপাশে অনেক হিন্দু পরিবারের বসবাস। তারা ২০ বছরের বেশি সময় ধরে অস্থায়ী মণ্ডপ তৈরি করে সেখানে দুর্গাপূজা করে আসছেন। পূজার আয়োজকরা জানিয়েছেন, সপ্তমী শেষে রাত আড়াইটা পর্যন্ত তাদের পূজা মণ্ডপে লোকজন ছিল। এরপর লোকজন চলে গেলে আয়োজকরা অস্থায়ী মঞ্চের মূল পূজামণ্ডপ পর্দা দিয়ে ঘিরে রেখেছিলেন। সেই মঞ্চের বাইরে অল্প দূরত্বে গণেশের মূর্তি ছিল, সেটি উন্মুক্ত ছিল। সেখানেই কেউ রেখে গিয়েছিল ‘কোরআন’।

একজন তরুণের ট্রিপল নাইনে ফোন করা এবং আরেকজনের ফেসবুক লাইভ করা — এই দু’টি ঘটনার মাধ্যমে অষ্টমীর ভোর থেকে বিষয়টা জানাজানি হয়। খবর পেয়ে কুমিল্লার কোতোয়ালি থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সকাল সাড়ে সাতটার দিকে ঘটনাস্থলে আসেন। এরপর ওই পুলিশ কর্মকর্তা পূজামণ্ডপ থেকে ‘কোরআন’ সরিয়ে নিয়ে যান। এর অল্প সময়ের মধ্যেই গোটা এলাকায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে এবং হামলা হয় তাদের মণ্ডপে। ‘কোরআন’ পাওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়লে অল্প সময়েই সেখানে অনেক মানুষ জড়ো হয়। তারা পূজা বন্ধ করে দেওয়ার দাবি তোলে এবং চরম উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। এক পর্যায়ে জড়ো হওয়া লোকজন পূজামণ্ডপে হামলা চালায় এবং অস্থায়ী মঞ্চ আর প্রতিমা ভাঙচুর করে। এরপর কুমিল্লারই বিভিন্ন পূজামণ্ডপে এবং হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলা হয়। এরপর হামলা ক্রমশ ছড়াতে থাকে এবং বাংলাদেশের নানা জায়গায় হিন্দুদের ওপর আক্রমণ সংগঠিত হয়। কুমিল্লার মণ্ডপ-মন্দিরে হামলার পর আরো ২২টি জেলায় সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর হামলা হয়েছে প্রকাশ্যেই। কুমিল্লার ঘটনার পর ওই দিনই চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে ও পরে সারাদেশে এ সহিংসতার জের ধরে পরিস্থিতি খানিকটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। বেশ কয়েকজন হতাহত হন। ব্যাপক সম্পত্তি ধ্বংস করা হয়।

বাংলাদেশে অতীতে নানা ঘটনায় হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের উপর হামলা বা আক্রমণের ঘটনা যেমন ঘটেছে, কখনো কখনো মন্দির বা পূজার প্রস্তুতিকালীন সময়ে প্রতিমা ভাঙচুরের বিচ্ছিন্ন ঘটনাও ঘটেছে। কিন্তু এবার দুর্গাপূজার সময়ে যেভাবে ব্যাপক মাত্রায় হামলা ও সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে, এমনটা সাম্প্রতিককালে দেখা যায়নি।

Protests against attacks on minorities

 

সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর মৌলবাদী দুর্বৃত্ত শক্তির সহিংস সংগঠিত আক্রমণ নিয়ে বাংলাদেশের ভেতরে ও বাইরে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। বাংলাদেশের বামপন্থী মহল ঘটনাধারার প্রতিবাদে প্রথম থেকেই সক্রিয় থেকেছেন। লেখক, শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীরা সংগঠিতভাবে প্রতিবাদে সামিল হন। হিন্দুদের প্রতিমা মণ্ডপ বাড়িঘর রক্ষায় নানা জায়গায় এগিয়ে আসেন মুসলিম সম্প্রদায়ের বিবেকী মানুষজন। এই সব ঘটনাবলী ধীরে ধীরে পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণের দিকে নিয়ে আসে।

এই ঘটনায় প্রশাসনের দিক থেকে গাফিলতির অভিযোগ উঠেছে নানা মহল থেকে। কেউ কেউ হাসিনা সরকার ও শাসক আওয়ামী লীগ বা তার কোনও কোনও অংশের সঙ্গে হেফাজতে ইসলাম সহ সাম্প্রদায়িক শক্তির বোঝাপড়ার অভিযোগ তুলেছেন এবং মনে করছেন এই ধরনের আঁতাতের ফলেই দুর্বৃত্তরা এত বেপরোয়া ঘটনা ঘটানোর সুযোগ পেয়েছে। শাসক শিবির অবশ্য এই ধরনের ঘটনার জন্য জামাত শিবির ও তাদের মদতদাতা বিএনপি’র দিকে অভিযোগের তীর নিক্ষেপ করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আওয়ামী সরকার ও পুলিশ প্রশাসনের তরফে গোটা ঘটনায় সংখ্যালঘু হিন্দুদের পাশে থাকার বার্তা দেওয়া হয়েছে। মন্দির, মণ্ডপ ও সংখ্যালঘু হিন্দুদের ওপর তাণ্ডব চালানোর অভিযোগে দেশজুড়ে ব্যপক সংখ্যায় দুর্বৃত্তদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কুমিল্লার পূজামণ্ডপে ‘কোরআন’ রাখার যে ঘটনা থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ও হিংসা ছড়িয়ে পড়েছিল, সেই ঘটনার প্রধান সন্দেহভাজন ইকবাল হোসেনকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে পুলিশ জানিয়েছে। তবে ইকবালকে এই কাজে উস্কানি দেওয়া হয়েছিল বলেই মনে করা হচ্ছে এবং এর পেছনে সক্রিয় থাকা চক্রান্তকারীদের পরিচয় উন্মোচন এখনো তদন্ত সাপেক্ষ। বাংলাদেশের সরকার বলেছে মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে তৈরি হওয়া বঙ্গবন্ধু মুজিবর রহমানের সময়ে তৈরি সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রটিকে আবার সম্পূর্ণভাবে ফিরিয়ে আনতে সংসদে প্রস্তাব পাশ করানো হবে।

বাংলাদেশের ঘটনার প্রতিবাদে কলকাতা সহ পশ্চিমবাংলার নানা জায়গায় প্রতিবাদ কর্মসূচি পালিত হয়েছে। কলকাতায় বাংলাদেশ হাইকমিশনে গণডেপুটেশন দেওয়া হয়েছে। বুদ্ধিজীবীদের পক্ষ থেকে জারি করা হয়েছে বেশ কয়েকটি বিবৃতি। বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের স্বার্থরক্ষার দাবি তোলার পাশাপাশি ভারতে, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি-আরএসএস বাংলাদেশের ঘটনাকে ব্যবহার করে যেভাবে সাম্প্রদায়িক উস্কানি সৃষ্টি করতে চাইছে, সে বিষয়েও বিবৃতি ও প্রতিবাদ কর্মসূচিগুলির মাধ্যমে মানুষকে সতর্ক করার চেষ্টা জারী রয়েছে। গোটা উপমহাদেশ জুড়ে গণতন্ত্র রক্ষা ও প্রসারের অন্যতম প্রধান শর্ত হিসেবে সংখ্যালঘুদের স্বার্থ রক্ষায় সরকার, পুলিশ, প্রশাসন, রাজনৈতিক দল, সমস্ত শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ ও সংগঠনগুলিকে যে আরো সক্রিয় হতে হবে — বাংলাদেশের ঘটনাবলী তা আরো একবার চোখে আঙুল দিয়ে আমাদের দেখিয়ে দিচ্ছে।

- সৌভিক ঘোষাল

খণ্ড-28
সংখ্যা-37