নদীয়ায় শহীদ স্মারক নির্মাণ তুলে ধরলো কৃষক প্রতিরোধ সংগ্রামের দিশা
construction of a martyr

“তিনি ছিলেন বলেই গোটা এলাকা সেদিন রক্ষা পেয়েছিল। দাঙ্গাবাজরা জলঙ্গি নদী পেরিয়ে আমাদের এলাকায় ঢোকার সাহস পায়নি। তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে কয়েকশো গ্রামবাসী সারা রাত জেগে কাটিয়েছিল। মানুষ রুখে দাঁড়িয়েছিল বলেই সাম্প্রদায়িক হামলাবাজরা পিছু হঠে যেতে বাধ্য হয়েছিল।” একথা জানালেন কালীনগর গ্রামের নুরউদ্দিন সেখ। এধরনের আরও বহু ধরনের বার্তালাপে ৮০’র দশকের সেই উজ্জ্বল অধ্যায় যেন জীবন্ত হয়ে উঠলো। ইতিহাসের সেই আখ্যান আজও নদীয়ার ধুবুলিয়া ব্লকের কালীনগর ও পার্শ্ববর্তী গ্রামাঞ্চলের মানুষের মুখে মুখে ফেরে। এভাবেই বেঁচে আছেন এই গ্রাম তথা এলাকার ভূমিপুত্র বিমান বিশ্বাস। তখন ছিল কংগ্রেসী দাঙ্গাকারী বাহিনী আর আজ সামনে এসেছে ফ্যাসিষ্ট বিজেপির আগ্রাসন। তাই গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলার সেই কর্মকাণ্ড আজকের সময়কালেও হয়ে রয়েছে ফ্যাসিবাদ মোকাবিলার অন্যতম কার্যকরী পন্থা। সংশ্লিষ্ট এলাকায় মানুষের চেতনার বিকাশ ঘটেছিল গ্রামীণ গরিবদের জমি, মজুরি ও মর্যাদার সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। ৮০-৯০’র দশক জুড়ে নদীয়ার ধুবুলিয়া, চাপড়া ব্লক সহ পার্শ্ববর্তী বিরাট এলাকা জুড়ে কয়েক হাজার একর খাস বেনামী জমি উদ্ধারের মধ্য দিয়ে সফল হয়েছিল ভূমি সংস্কারের আন্দোলন। প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল নিপীড়িত মানুষের অধিকার। গড়ে উঠেছিল প্রতিরোধ সংগ্রামের এলাকা। সে সময়কালে জলঙ্গী নদীর আকবাঁকা স্রোতে ভেজা সবুজ ক্ষেতে শহীদের মৃত্যু বরণ করেন বিমান বিশ্বাসের সহযোদ্ধা ফজলু ও আমির। তারও আগে ৭০ দশকে সমাজ বদলের বিপ্লবী অভিযানে সামিল হয়ে এই এলাকায় রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বলি হন আহাদ-হাকিম-ধনঞ্জয় হালদার। ২৪ পরগণার শহরতলি থেকে নদীয়ার গ্রামে কৃষককে সংগঠিত করতে চলে আসা বিপ্লবী যুবক পুলক রায়।

এই সমস্ত শহীদদের স্মরণে কমরেড বিমান বিশ্বাসের তৃতীয় প্রয়াণ দিবস উপলক্ষে গত ১২ অক্টোবর কালীনগর গ্রামে নবনির্মীত শহীদ বেদীর উদ্বোধন হয়। লাল পতাকা উত্তোলন, নীরবতা পালন, মাল্যদানের পর কালীনগর গ্রামের সমবায় সমিতির মাঠে অনুষ্ঠিত হল স্মরণসভা। কেবল স্মৃতিচারণ নয়, শহীদ ও প্রয়াত সাথীদের স্মরণ অনুষ্ঠানে উঠে এল আজকের সময়কালে কৃষকের সংকটের কথা। যথা নদীর তীরবর্তী উর্বরা তিন ফসলি জমি থাকলেও তীব্রতর হয়ে উঠেছে সেচের অপ্রতুলতা, ফসলের অভাবী বিক্রি, কৃষি উপকরণের সীমাহীন মূল্যবৃদ্ধি, চরম গ্রামীণ বেকারত্ব। গ্রামীণ মজুরদের শ্রমের কোনও মর্যাদা নেই, সম্মানজনক মজুরি নেই। ১০০ দিনের প্রকল্পে বছরে মাত্র ৬ দিন কাজ করে দু’মাস হয়ে গেলেও মজুরি পাওয়া যায় না। সরকারি প্রতারণা আর বঞ্চনাকে ধামাচাপা দিয়ে চলছে কেবল কিছু প্রতীকী অনুদান প্রকল্প।

সভায় দিল্লী ও সারা দেশে চলমান কৃষক আন্দোলনের বার্তা গ্রামে গ্রামে নিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানানো হয়। এরাজ্যের কৃষকের দাবিগুলিকে যুক্ত করে আন্দোলন গড়ে তোলার ডাক দিলেন নেতৃবৃন্দ। আজ যখন গাড়ি চাপা দিয়ে পিষে মারা হচ্ছে কৃষকদের তখন ঘাতক আর রংবেরং-এর বিশ্বাসঘাতকদের বিরুদ্ধে কৃষক ও গ্রামীণ মজুরদের আন্দোলন গড়ে তোলার শপথ নিলেন সম্মিলিত কর্মী ও নেতৃবৃন্দ। সমগ্র কর্মসূচি সঞ্চালনা করেন ধনঞ্জয় গাঙ্গুলী। উপস্থিত ছিলেন জেলা নেতৃবৃন্দ কাজল দত্তগুপ্ত, কৃষ্ণ প্রামানিক, আলতাফ হোসেন, অমল তরফদার, ইনসান সেখ, সন্তু ভট্টাচার্য, নীহার ব্যানার্জী প্রমুখ সহ এলাকার আনসারুল হক, ঠান্ডু সেখ, মিনাজ বিশ্বাস, সুব্রত রায়, হবিবুর রহমান ও প্রয়াতদের পরিবারের সদস্যরা, ছিলেন রাজ্য নেতা বাসুদেব বসু ও জয়তু দেশমুখ।

খণ্ড-28
সংখ্যা-37