প্রকল্প কর্মীদের অভূর্তপূর্ব সর্বভারতীয় ধর্মঘট
project workers

বিভিন্ন রাজ্যে এআইসিসিটিইউ অন্তর্ভুক্ত ইউনিয়নগুলি প্রধান ভূমিকায়

আশা, অঙ্গনওয়াড়ি, মিড-ডে-মিল কর্মী এবং অন্যান্য বিভিন্ন প্রকল্প কর্মীদের যুক্তমঞ্চ ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২১ একদিনের ঐক্যবদ্ধ ধর্মঘট সফলভাবে পালন করলেন। তাঁদের বিভিন্ন দাবির মধ্যে আশু দাবি ছিল কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা, ঝুঁকিপূর্ণ কাজের ভাতা এবং কোভিড ডিউটির জন্য বীমার ব্যবস্থা। এরসঙ্গে রয়েছে দীর্ঘদিনের অপূর্ণ দাবি — স্থায়ীকরণ, শ্রমিক/কর্মী হিসাবে স্বীকৃতি আদায়, ন্যূনতম বেতন, সামাজিক সুরক্ষা, পেনশন এবং বেসরকারিকরণের বিরোধিতা। ধর্মঘট হয়েছে দেশের উত্তর থেকে দক্ষিণে এবং পূর্ব থেকে পশ্চিমে। ধর্মঘটে বহুসংখ্যক কর্মীদের প্রাণবন্ত যোগদান — তৃণমূল স্তর থেকে ব্লক ও গ্রামে বিভিন্ন রূপের ক্রিয়াকান্ডে অংশগ্রহণ দেখা গেছে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে (খবরের কাগজ, টিভি এবং সমাজ মাধ্যমে) ধর্মঘটের খবর গুরুত্ব পেয়েছে। এই একদিনের ধর্মঘটে পরিষ্কারভাবে দেখা গেল সমগ্র করোনাকালে মোদীর সরকার প্রকল্প কর্মীদের সাথে যে ক্রীতদাসসুলভ পাশবিক ব্যবহার করেছে তার বিরুদ্ধে কর্মীদের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ ও ক্রোধের সাথে তীব্র লড়াইয়ের দৃঢ় মানসিকতা।

প্রকল্প কর্মীদের সর্বভারতীয় ফেডারেশনের (এআইসিসিটিইউ অন্তর্ভুক্ত) আহ্বায়ক শশী যাদব বিজ্ঞপ্তিতে বলেছেন “এই ধর্মঘট ঐতিহাসিক এবং সরকার, প্রশাসনের তরফ থেকে সমস্ত রকমের হুমকি, চোখরাঙানি, বহুরকমের বাধা বিপত্তি কাটিয়ে কর্মীরা ধর্মঘটকে সফল করার জন্য তাঁদের অভিনন্দন”। তিনি সব ইউনিয়নের অগ্রণী কর্মীদের ও অন্যান্য কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নকেও অভিনন্দন জানিয়েছেন। অভিনন্দনের বার্তা দিয়েছেন কৃষক সংগঠনগুলিকে, অন্যান্য সংগঠনকে, সাধারণ জনগণকে ধর্মঘটে সমর্থন জানানোর জন্য। কর্মীদের বলেছেন ভবিষ্যতে আরও বড় আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত হবার কথা।

দিল্লীতে মান্ডি হাউস থেকে ‘দিল্লী আশা কামগর ইউনিয়ন’ এক প্রতিবাদী মিছিল সংগঠিত করে যেখানে শত শত আশা কর্মীরা অংশগ্রহণ করেন। দিল্লী পুলিশ মান্ডি হাউস থেকে যন্তর মন্তরে মিছিলের অনুমতি না দেওয়ার জন্য মোদী সরকার এবং দিল্লী পুলিশের নিন্দা করে সংগঠকরা বলেন দিল্লী সহ সারা দেশে অঘোষিত জরুরি অবস্থা চলছে। প্রতিবাদী ঐ সভায় এআইসিসিটিইউ’র সম্পাদক রাজীব ডিমরি সহ অন্যান্য অনেক নেতা এবং আশা কর্মীরা বক্তব্য রাখেন। সভাশেষে শ্বেতা রাজ, এআইসিসিটিইউ রাজ্য সম্পাদক সন্তোষ রায়ের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি টীম কেন্দ্রীয় শ্রম এবং কর্মসংস্থান মন্ত্রী ভূপেন্দ্র যাদবকে দাবিদাওয়া সম্বলিত স্মারকপত্র দেন ও দাবিগুলি সম্পর্কে তাকে অবহিত করেন। ধর্মঘটের আগে ১৭ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রীর জন্মদিনে তাকে আশা কর্মীরা তাঁদের দাবি নিয়ে পোস্টকার্ড পাঠানোর মাধ্যমে একটি প্রচার অভিযান সংগঠিত করেন।

বিহারে আশা, মিড-ডে-মিল, অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীরা এবং অন্যান্য প্রকল্পের কর্মীরাও উৎসাহভরে হাজারে হাজারে অংশগ্রহণ করেন। সরকারের সমস্ত নিষেধাজ্ঞাকে উড়িয়ে দিয়ে ধর্মঘটকে সফল করেন। নেতৃত্ব দেন বিহার রাজ্য আশা কার্যকর্তা সঙ্ঘর নেত্রী শশী যাদব এবং মিড-ডে-মিল কর্মীদের নেতৃত্ব দেন বিহার রাজ্য বিদ্যালয় রসোইয়া সঙ্ঘর নেত্রী সরোজ চৌবে। পাটনা সহ দুই ডজন জেলায় আশা কর্মীদের ধর্মঘটের প্রভাব পড়ে।

ইউপি’তে এআইসিসিটিইউ’র নেতৃত্বে হাজার হাজার আশা, মিড-ডে-মিল এবং অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীরা অংশগ্রহণ করেন। বিশেষত রায় বেরিলি, এলাহাবাদ, লক্ষ্মৌ, কানপুরের মিছিল দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এখানেও প্রত্যেক কেন্দ্রে দাবিসনদ পেশ হয়। উত্তরাখন্ডে সারা রাজ্যে বিশেষত নৈনিতাল, হলদোয়ানি, বাজপুর, দেরাদুন ইত্যাদি শহরে হাজারে হাজারে আশাকর্মী ও অন্যান্য প্রকল্প কর্মীরা অংশ নেন ধর্মঘটে। নেতৃত্বে ছিলেন কমলা কুঞ্জওয়াল, রিতা কাশ্যপ, কৈলাশ পান্ডে ও অন্যান্যরা। লক্ষ্যণীয় ব্যপার হল এরআগে প্রায় একমাস যাবৎ সিটু ও অন্যান্য ইউনিয়নের সাথে এই আশা কর্মীরা ধর্মঘট করেছেন তাও তাঁরা এক মূহুর্তও দ্বিধা না করে এই সর্বভারতীয় ধর্মঘটে যোগ দেন।

এআইসিসিটিইউ’র নেতৃত্বে বহু অন্তর্ভুক্ত ইউনিয়নের প্রকল্প কর্মীরা বিক্ষোভ প্রদর্শন ও ধর্মঘটে সামিল হন ছত্তিসগড়ের রায়পুর, কোরবা, আসামের ডিব্রুগড়ে, মহারাষ্ট্রের কোলাপুরে, পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগণায়।

প্রকল্প কর্মীদের দাবিসনদ

১) কোভিড ডিউটিরত প্রকল্প কর্মীদের সম্মুখসারির কর্মী হিসাবে ঘোষণা করতে হবে। অবিলম্বে সর্বসাধারণের জন্য বিনামূল্যে ভ্যাকসিন এবং সম্মুখসারির কর্মীদের জন্য অগ্রাধিকার দিতে হবে। ভ্যাকসিন তৈরি দ্রুত বাড়াতে হবে এবং সরকারী নিয়ন্ত্রণে বন্টন করতে হবে এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সকলের ভ্যাকসিন প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।

২) প্রকল্প কর্মী যারা অতিমারী-নিয়ন্ত্রণে যুক্ত এবং অন্যান্য সম্মুখসারির কর্মী, স্বাস্থ্য কর্মীদের জন্য সমস্ত রকমের প্রতিরোধক পোষাক ও যন্ত্রের যোগান নিশ্চিত করতে হবে। সম্মুখসারির কর্মীদের মাঝে মাঝেই কোভিড১৯ পরীক্ষা করতে হবে। কোভিড আক্রান্ত হলে সম্মুখসারির কর্মীদের হাসপাতালে ভর্তির ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দিতে হবে।

৩) স্বাস্থ্যক্ষেত্রে জিডিপি’র ৬ শতাংশ ধার্য করতে হবে। সরকারী স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এবং পরিকাঠামো ঢেলে সাজাতে হবে, যাতে কোভিড সংক্রমণ বেড়ে গেলে হাসপাতালে শয্যা, অক্সিজেন এবং অন্যান্য চিকিৎসার সুযোগ পাওয়া যায়। এরজন্য প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ করতে হবে। কোভিড-হীন রোগীদের চিকিৎসার ব্যবস্থাও সরকারী হাসপাতালে নিশ্চিত করতে হবে।

৪) কর্মরত অবস্থায় সম্মুখসারির কর্মীদের মৃত্যুর ঝুঁকির জন্য ৫০ লক্ষ টাকার বীমা করতে হবে এবং তাদের পরিবারের প্রত্যেকের জন্যও বিনামূল্যে কোভিড চিকিৎসা করতে হবে।

৫) কোভিড ডিউটিরত সমস্ত চুক্তিবদ্ধ ও প্রকল্প কর্মীদের মাসিক দশ হাজার টাকা কোভিড ঝুঁকি ভাতা দিতে হবে। সমস্ত প্রকল্প কর্মীদের বকেয়া বেতন এবং ভাতা অবিলম্বে মেটাতে হবে।

৬) ডিউটিরত সমস্ত কর্মীদের, যারা কর্মরত অবস্থায় কোভিডে আক্রান্ত হয়েছে তাদের ক্ষতিপূরণ বাবদ ন্যূনতম দশ লক্ষ টাকা দিতে হবে।

৭) শ্রমিক বিরোধী শ্রমকোড প্রত্যাহার করতে হবে। প্রকল্প কর্মীদের শ্রমিকের বর্গে যুক্ত করতে হবে। সমস্ত প্রকল্প কর্মীদের নাম ই-শ্রম পোর্টালে ‘নিষ্পত্তির অপেক্ষায়’ বর্গে পঞ্জীকৃত করতে হবে।

৮) কেন্দ্রীয় উদ্যোগভূক্ত প্রকল্প যেমন আইসিডিএস, এনএইচএম এবং এমডিএমএস — এগুলির স্থায়ীকরণ এবং প্রয়োজনীয় অর্থ বাজেটে বরাদ্দ করতে হবে। আইসিডিএস এবং এমডিএমএস প্রকল্পের সুবিধাভোগীদের জন্য অবিলম্বে উচ্চমানের রেশন যোগান দিতে হবে এবং পরিযায়ীদেরও এই প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

৯) ৪৫তম এবং ৪৬তম আন্তর্জাতিক শ্রম সম্মেলনের প্রস্তাব অনুযায়ী প্রকল্প কর্মীদের শ্রমিক হিসাবে মান্যতা দিতে হবে, ন্যূনতম বেতন প্রতিমাসে ২১,০০০ টাকা, পেনশন প্রতি মাসে ১০,০০০ টাকা, ইএসআই এবং পিএফ চালু করতে হবে।

১০) বর্তমানে চালু বীমা প্রকল্প (ক) প্রধানমন্ত্রী জীবন জ্যোতি বীমা যোজনা, (খ) প্রধানমন্ত্রী সুরক্ষা বীমা যোজনা, (গ) অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী বীমা যোজনা — এগুলি সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে হবে এবং সমস্ত প্রকল্প কর্মীদের এতে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

১১) মিড-ডে-মিল কর্মীদের ন্যূনতম মজুরি দিতে হবে যখন গ্রীষ্মকালীন ছুটি ও অন্যান্য ছুটি চলবে। কোন কেন্দ্রীভূত রান্নাঘর বা চুক্তিপ্রথায় এগুলো চালানো চলবে না।

১২) করোনা-কালের জন্য মাসিক মাথাপিছু দশ কেজি খাদ্যশস্য দিতে হবে। মূল্যবৃদ্ধি রদ করতে হবে, আয়করহীন পরিবারগুলিকে ছয়মাসের জন্য মাসিক ৭,৫০০ টাকা দিতে হবে; কাজ এবং আয়ের ব্যবস্থা করতে হবে সকলের জন্য।

১৩) স্বাস্থ্যক্ষেত্রে (হাসপাতাল সহ), পুষ্টিক্ষেত্রে (আইসিডিএস এবং এমডিএমএস) এবং শিক্ষাক্ষেত্রের মতো মৌলিক পরিষেবাকে বেসরকারীকরণ করার পরিকল্পনা প্রত্যাহার করতে হবে। এনডিএইচএম এবং নয়া অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ২০২০ প্রত্যাহার করতে হবে। পাবলিক সেক্টর এন্টারপ্রাইজেস এবং পরিষেবাক্ষেত্র বেসরকারীকরণের প্রচেষ্টা বন্ধ কর।

১৪) সমস্ত প্রকল্প-বিরোধী কৃষি আইন প্রত্যাহার কর।

১৫) সরকারী প্রকল্পের সুবিধা প্রাপকদের নাম ডিজিটাইজেশনের নামে বাতিল করার চক্রান্ত বন্ধ কর। ‘পোষণ খোঁজা’ ‘পোষণ বটিকা’ ইত্যাদির নামে অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের হয়রানি বন্ধ কর।

১৬) খাদ্যের অধিকার এবং শিক্ষার অধিকারের মতো সবার জন্য স্বাস্থ্য অধিকারের আইন করতে হবে।

১৭) অর্থের সংস্থানের জন্য মহাধনীদের ওপর ট্যাক্স বসাও। ‘সেন্ট্রাল ভিস্টা প্রকল্প’র মত সমস্ত প্রকল্প বাতিল কর।

খণ্ড-28
সংখ্যা-36