কেন মোদী-রাজ কাশ্মীরে সাধারণ নাগরিকদের জঙ্গী হামলা থেকে রক্ষা করতে অক্ষম?
Terrorists In Kashmir?

কাশ্মীর উপত্যকায় গত ২ অক্টোবর ২০২১ থেকে ছ'দিনে সাতজন সাধারণ নাগরিক খুন হয়েছেন যাদের মধ্যে চার জন হিন্দু বা শিখ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের এবং তিনজন কাশ্মীরী মুসলমান। একটি নতুন জঙ্গি গোষ্ঠী যারা নিজেদের “রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট” বলে থাকে, এই হত্যার দায় স্বীকার করেছে। ২০২১-এ জঙ্গিবাহিনীর হাতে ২৮ জন সাধারণ মানুষ খুন হয়েছেন যার মধ্যে পাঁচ জন কাশ্মীরী পণ্ডিত বা স্থানীয় শিখ সম্প্রদায়ের এবং দু’জন বিহারের হিন্দু পরিযায়ী শ্রমিক। উপত্যকায় হঠাৎ করে আবার এই সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের বিপুল বিস্ফোরণ, যার নিশানায় সাধারণ নাগরিক এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ, সেখানকার শান্তি ও সুস্থিতিকে ভীষণভাবে বিপর্যস্ত করে তুলছে। কেন মোদী সরকার, ২০১৯-এর আগস্টে ৩৭০ ধারা বিলোপের পর থেকে কাশ্মীর উপত্যকা যাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, জঙ্গি হামলা থেকে সাধারণ মানুষ ও সংখ্যালঘুদের বাঁচাতে পারছে না? মোদী সরকার সমস্ত সুপরামর্শ নাকচ করে একগুঁয়ের মতো বলে গেছে — জোর করে ৩৭০ ধারা বাতিল করলেই নাকি উপত্যকায় সন্ত্রাসবাদ নির্মূল হবে। আর তার পরিবর্তে আমরা কী পেলাম — সাধারণ নাগরিকদের নিশানাকারী সন্ত্রাসবাদের নতুন উদ্যমে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা ! এখন প্রধানমন্ত্রী নিজেদের কৃতকর্মের ফল অন্যের ঘাড়ে চাপাতে পারেন না — এখন তাকে এবং তার প্রশাসনকেই জবাবদিহি করতে হবে — কেন কাশ্মীরের সাধারণ মানুষ এবং সংখ্যালঘুদের সন্ত্রাসবাদী হামলার মুখে ফেলে দেওয়া হয়েছে?

ভারতবর্ষের সর্বত্র এখন সংখ্যালঘুদের প্রতি সাম্প্রদায়িক হিংসা ও সন্ত্রাসবাদ তুঙ্গে পৌঁছেছে। নবরাত্রির সময়ে হিন্দু আধিপত্যবাদীরা মুসলিম বিক্রেতাদের ওপর হামলা করেছে; মধ্য প্রদেশে কলেজ চত্বরে “গরবা” উৎসব প্রাঙ্গণ থেকে মুসলিম ছাত্র ছাত্রীদের ঘাড় ধরে বের করে দেওয়া হয়েছে; মধ্যপ্রদেশেই হিন্দু-আধিপত্যকামীদের হাতে খ্রিস্টানরা মার খেয়েছেন; গাজিয়াবাদের দশনায় যতি নাসিনহানন্দ তার মন্দির চত্বরে ভিডিওতে মুসলিম শিশুদের হেনস্থা করেই চলেছে; ইন্দোরের কাছে পেওড়া গ্রামে একটিই মাত্র মুসলিম পরিবারের বাস-হিন্দুত্ববাদী এক জনতা তাদের ওপর হামলা চালায় এবং তাদের ভিটে থেকে উৎখাতের চেষ্টা করে; ‘শ্রীরাম সেনা হিন্দুস্তান’ নামে এক সন্ত্রাসবাদী সংগঠন আরবাজ নামে এক মুসলিম যুবককে মুণ্ডচ্ছেদ করে হত্যা করেছে; ছত্তিশগড়ের কাওয়ার্ধায় মুসলিমদের ওপর সাম্প্রদায়িক হামলা হয়েছে; উত্তরপ্রদেশের শামলীতে এক মুসলিম যুবককে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে — প্রত্যেকদিন এই তালিকা ক্রমশ দীর্ঘতর হচ্ছে।

লখিমপুর খেরির গণহত্যা এক সন্ত্রাসবাদী হামলার থেকে কোন অংশে কম নয়, যেখানে এক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর ছেলে তার ইউএসভি গাড়ি আন্দোলনরত কৃষকদের ওপর দিয়ে চালিয়ে দিয়েছে। আর ঐ অভিযুক্ত মন্ত্রীকে বরখাস্ত করার দাবিতে যে ছাত্রীরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর বাসভবনের সামনে বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন, দিল্লি পুলিশের আধিকারিকরা তাদের ওপর যৌন নিপীড়ন চালায়। এই বর্বরতার জন্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এবং প্রধানমন্ত্রী মোদী ছাড়া আর কে দায়ী হতে পারে?

কী বিচিত্র পরিহাস! জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের ২৮তম প্রতিষ্ঠা দিবসে ভাষণ দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদী মানবাধিকার কর্মীদলেরই আক্রমণের জন্য বেছে নেন। তার অভিযোগ, তারা নাকি তাদের “পছন্দমতো কিছু কিছু নির্যাতনের” ঘটনায় সরব হন! সত্যিটা হল, তার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বেছে বেছে মুসলিমদের “উইপোকা” বলেন! তাদের “মনুষ্য” পদবাচ্য বলেই মনে করেন না! কাশ্মীরের কাশ্মীরী পণ্ডিত এবং হিন্দু/শিখ সংখ্যালঘু মানুষ হোন অথবা গোটা দেশের মুসলমান সংখ্যালঘু মানুষই হোন — মোদী সরকার এবং বিজেপি তাদের অধিকার লঙ্ঘন করে চলেছে। আর ভারতের পুলিশ এবং সামরিক বাহিনী তো হেফাজতে নির্যাতন, হত্যা এবং মানবাধিকার ও নাগরিক স্বাধীনতা লঙ্ঘনের জন্য ‘বিশ্বখ্যাত’ হয়ে উঠেছে!

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারপার্সন জাস্টিস অরুণ মিশ্র এই উপলক্ষটা প্রধানমন্ত্রী মোদীর দরাজ প্রশস্তি গাওয়ার সুযোগ হিসেবে কাজে লাগিয়ে তার ভাষণে বলেন, “আপনারই জন্য জম্মু ও কাশ্মীরে এক নতুন যুগের সূচনা হয়েছে”। এই ভাষণ জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের মৃত্যুর ‘শোকবার্তা’ হিসেবেই মনে থাকবে। যদি মানবাধিকার সংস্থার চেয়ারপার্সন কোনও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান নিয়ে এমন বিবৃতি দিতেন, মনে হত তিনি প্রতিবেদকের ভূমিকায় আছেন, কিন্তু এটা শুধু চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল যে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন একটা ‘পুতুল’, একটা ক্রীড়নকে পরিণত হয়েছে! অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল-এর মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলিকে মোদী সরকার ভারত থেকে উৎখাত করেছে। শুধু তাই নয়, এই সরকার সুধা ভরদ্বাজ এবং গৌতম নওলখার মতো মানবাধিকার রক্ষার অগ্রণী ব্যক্তিত্বদের দানবীয় ইউএপিএ আইনে জেলে পুরে রেখেছে।

এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি হল, মানুষের ঐক্যবদ্ধ হওয়া ও সাম্প্রদায়িক ও বিভেদকামী শক্তিগুলিকে প্রত্যাঘাত হানা এবং সন্ত্রাসবাদ ও অধিকার লঙ্ঘনের জন্য মোদী সরকারকে দায়ী করা। উপত্যকায় এই হত্যাকে কাজে লাগিয়ে বিজেপিকে কিছুতেই মুসলিমদের বিরুদ্ধে হিংসা ও ঘৃণা ছড়াতে বা উপত্যকায় অধিকার হরণের অনুমোদন দিতে দেওয়া যাবে না।

(এম-এল আপডেট সম্পাদকীয়, ১২ অক্টোবর ২০২১)

খণ্ড-28
সংখ্যা-37