সম্পাদকীয়
জন্মেই কেন নিথর হতে হয়?
frozen at birth

এক কন্যা সন্তানকে জন্মের চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে শ্বাসরোধ করে মেরে ফেলা হল। মেরেছেন অন্য কেউ নয়, শিশুকন্যার জন্মদাত্রী বছর একুশের মা। এহেন সদ্যোজাতিকা হত্যার ৯৫ শতাংশই ঘটে থাকে হাসপাতাল/নার্সিং হোমের বাইরে, বাড়িতে বা অন্যত্র। সেটা এবার ঘটল নার্সিং হোমেই। অথচ আউটডোরে প্রসূতি বিভাগে বড় বড় করে বোর্ডে লেখা থাকে “কন্যাভ্রূণ হত্যা দন্ডনীয় অপরাধ”। তা সত্বেও কেন ঘটল এমনটি? চলবে তার আর্থ-সামাজিক-পারিবারিক-মনোবৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান। স্বামী বা শ্বশুরবাড়ির দিক থেকে কোন ‘অবাঞ্ছিত’ চাপ ছিল বলে খবর নেই। বরং প্রকাশিত হিমশৈলের খবর যদি সত্যের স্বীকারোক্তি হয় তবে মৃতকন্যার মায়ের আক্ষেপ আত্মবিলাপ উড়িয়ে দেওয়ার নয়। মেয়ে হয়ে জন্মানো আর প্রতিপালিত হওয়ার কত জ্বালা সেটা তাঁদের সাত বোনের বাবা-মায়ের দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণা থেকে হাড়ে হাড়ে জানা আছে। তাই কি এক কন্যেতেই পুনরাবৃত্তির ভয়াতঙ্কে শেষ করে দিলেন আত্মজাকে! চরম সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর এই মন-মানসিকতা অবশ্যই সমর্থন করার নয়। কিন্তু ‘পাষাণ’ বলে ধিক্কার জানানো বা খুনী সাব্যস্ত করে সাজা দেওয়ার মধ্যে কোনও প্রতিষেধক টোটকা নেই। বরং অনুভব করা দরকার কী গভীর শঙ্কা-ভয়ে চেপে বসলে তবে একজন মা এরকম ঘটিয়ে ফেলেন। কেন আজও এক দুঃস্বপ্ন সমান নিরাপত্তায় ও সুযোগে বাঁচার মৌলিক চাওয়া-পাওয়া কেড়ে নেয়! দুশ্চিন্তার কারণগুলি রয়েছে আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার গভীরে? আজও কেন ছেলেমেয়েতে ভাগ করা, তফাত করা, বৈষম্য করা হয়, মেয়েরা কেন কেবল লিঙ্গ-ভিত্তিক একচক্ষুর শিকার হয়ে চলছে?

দৃষ্টিভঙ্গীর দোষে দুষ্ট যেমন সমাজ, তেমনি রাষ্ট্র ব্যবস্থায়ও চলছে মূলত একই পুরুষ পক্ষপাতের দূষণ ছড়ানো ইঞ্জিন, তা সরকার ডবল ইঞ্জিনের হোক বা সিঙ্গল ইঞ্জিনের। তবে মেয়েদের অধিকার সবচেয়ে নৃশংস ও ন্যক্কারজনকভাবে কাটা পড়ছে ডবল ইঞ্জিনের তলায়। ‘ডবল ইঞ্জিন’ মানে একইসাথে কেন্দ্র-রাজ্যে ক্ষমতায় থাকা কেবলমাত্র নয়, ক্ষমতায় রয়েছে বিজেপি-আরএসএস-ও বটে। অন্যদিকে সিঙ্গল ইঞ্জিনের সরকারগুলির রাজ্যেও মেয়েদের বাঁচার অধিকার পীড়িতই হচ্ছে অধিক। বাংলায় তৃণমূল আমলেও নিরাপত্তাহীনতা থেকে নিস্তার মিলছে না।

এরাজ্যে জনসংখ্যায় প্রতি হাজার পুরুষের তুলনায় নারীর সংখ্যা ৯৫০। অন্যান্য পরিসংখ্যানগত প্রতিতুলনা পুনরুল্লেখের প্রয়োজন হয় না। সাক্ষরতা, প্রাথমি শিক্ষা-মধ্য শিক্ষা-উচ্চ শিক্ষা, জীবিকা ও অন্যান্য প্রশ্নে সবেতেই মেয়েদের বা মহিলাদের দুরবস্থা অনেক বেশি। মমতা সরকার কিছু সংস্কার কর্মসূচি নামিয়েছে। ‘কন্যাশ্রী’, ‘রূপশ্রী’, ‘স্বাস্থ্যসাথী’, ‘লক্ষীর ভান্ডার’; এর ফলে জনপ্রিয়তাও তুলনায় বেশি পাচ্ছে। কিন্তু আবার কিছু আশু জ্বলন্ত বিষয়ে এই সরকার অত্যন্ত নিস্পৃহ অসংবেদী উদাসীন আচরণ করে চলছে। যেমন আশা এবং মিড ডে মিল কর্মীদের ন্যূনতম সম্মানজনক বেতন ব্যবস্থার দাবি কানে তুলছে না। স্কুল শিক্ষাক্ষেত্রে কর্মপ্রার্থী মেয়েরা তাদের ন্যায়সঙ্গত দাবিতে দিনরাত রাস্তায় পড়ে থাকছেন, কোনও কোনও অংশ বদলির যুক্তিসঙ্গত দাবি জানিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু সরকারের তরফ থেকে পাচ্ছেন নির্মমতা। উত্তরবঙ্গে জেলায় জেলায় একটানা ব্যাপক সংখ্যায় শিশুমৃত্যুর ঘটনা ঘটে গেল। এ তো নিছক শিশু মৃত্যুর মিছিল নয়, এক অর্থে শিশু হত্যার সিরিয়াল। সরকার একে ‘পরিবেশগত সচেতনতার অভাবের পরিণামবশত ফিবছরকার চিত্র’ বলে দায় এড়ানোর ছেঁদো কথা বলছে। তর্কের জন্য যদি ধরেই নেওয়া হয় ‘সচেতনতার অভাব’ হল এই পরিণামের পিছনে মূল কারণ। তাহলেও পাল্টা প্রশ্ন রয়ে যায়, আবশ্যিক সচেতনতা বাড়াতে কেন সরকার দুয়ারে যায় না? ভোট চাওয়ার সময় তো বেশ যায় !

শিশু সময় থেকেই সন্তানদের প্রতি দায় পরিবার, সমাজ, সরকার প্রত্যেকের রয়েছে। বিশেষ করে রয়েছে কন্যা সন্তানের প্রশ্নে হেয় করে দেখার মনোভাব দূর করার গুরুত্ব। ভাগ্য নির্ধারণের দায় সবচেয়ে বেশি সমাজ ও রাষ্ট্রের চালক-পরিচালকদের। তাই পাল্টাতে হবে কন্যা সন্তানের প্রতি বৈষম্যের দৃষ্টিভঙ্গী এবং অবহেলার অবস্থান। পরিবার যেখানে দায়িত্ব পালন করে উঠতে পারে না, সাধ্যের বাইরে চলে যায়, সেখানে কোন অজুহাতেই রাষ্ট্র দায়িত্ব দায়-দায়িত্ব অস্বীকার করতে পারে না, কাঠগড়ায় তুলতে হবে শাসকশ্রেণীকে।

খণ্ড-28
সংখ্যা-37