প্রতিবেদন
উন্নয়নের দমনমূলক পথের ওকালতি
path of development

ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের মাধ্যমে যে জমি উদ্ধার করা যাইবে না, তাহা উদ্ধারের জন্য দরকার হইলে রাষ্ট্রক্ষমতা ব্যবহার করিতে হইবে। এইখানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিশেষ দায়। তাঁহার “জোর করিয়া জমি লওয়া হইবে না নীতি শুনিতে মধুর হইতে পারে, কিন্তু রোগীর স্বাস্থ্য উদ্ধারে অনেক সময় তিক্ত ঔষধ অপরিহার্য হইয়া ওঠে। ... সিঙ্গুরে সেই কালান্তক ব্যাধি হইয়াছিল। ডেউচা-পাঁচামি যেন সিঙ্গুর না হয়।”

ভারতে সর্বাধিক প্রচারিত প্রথম শ্রেণীর বাংলা দৈনিক হিসাবে নিজেকে প্রত্যহ বিজ্ঞাপিত করে চলা আনন্দবাজার পত্রিকা ১৫ নভেম্বরের প্রথম সম্পাদকীয় স্তম্ভে ‘পায়ে ঠেলার ব্যাধি’ শিরোনামে খোলাখুলি ‘উন্নয়নের’ বাহানায় রাষ্ট্রীয় দমনের ওকালতি করেছে। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামে হাড়-হিম করা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, ও “টাটার কেশাগ্র স্পর্শ করতে দেব না” গোছের নির্লজ্জ দমনের হুমকি সত্ত্বেও সিঙ্গুরের ‘কালান্তক’ ব্যাধির উপশম ঘটল না। আরও ঠিক কোন মোক্ষম তিক্ত ঔষধ প্রয়োগ করা গেলে সিঙ্গুরে ন্যানো কারখানার বোধন হত তা চতুরভাবে অনুচ্চারিত রেখে কার্যত আরও তীব্র রাষ্ট্রীয় হিংসার পথ অনুসরণ করার সপক্ষে পত্রিকাটি ওকালতি করেছে। সর্বাধিক প্রচারিত বাংলা দৈনিকটি এক্ষেত্রে এই কথা উচ্চারণ করতে ভুলে গেল যে এরাজ্য থেকে গুজরাটের সানন্দে একলাখি ন্যানো প্রকল্পকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও তা মুখ থুবড়ে পড়ে শিল্পক্ষেত্রে শ্রমিক অশান্তির জন্য নয়, খোদ টাটাই বলেছিলেন ওই প্রকল্পটাই ছিল তাদের এক ‘ক্রিটিকাল মিস্টেক’ (বিরাট মাপের ভুল)।

কিন্তু আজও কত বড় মাশুল গুনে যেতে হচ্ছে সিঙ্গুরকে। শিল্পের সাধনায় তছনছ করে ফেলা হল বহুফসলি উর্বর কৃষি জমিকে, নাভিশ্বাস ওঠা রাজ্যের কোষাগারকে প্রায় নিঙড়ে কর্পোরেট স্বার্থবাহী এই শিল্প প্রকল্প যে রাজ্যের পক্ষে ভালো হবেনা তা বামপন্থী অর্থশাস্ত্রী ডাঃ অশোক মিত্র সহ বেশ অনেকেই বলেছিলেন। যে নব্য উদার অর্থনীতির পৃষ্টপোষকেরা সমস্ত ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে সরকার ও রাষ্ট্রকে বহুযোজন দূরে থাকার পরামর্শ দেন, তারাই আবার নতুন নতুন শিল্পস্থাপনে সরকারি কোষাগার থেকে উদার হস্তে আর্থিক সাহায্যের (ইন্সেনটিভের জামা পরিয়ে) পাশাপাশি তাদের শিল্পস্থাপনে দানবীয় পন্থা অবলম্বনের জন্য নানা যুক্তি হাজির করেন — সবটাই উন্নয়নের বস্তাপচা স্লোগানের আড়ালে।

বীরভূমের ডেউচা-পাঁচামি কয়লাখনি প্রকল্পের রূপায়ণে রাজ্য সরকারের উদ্যোগ প্রসঙ্গেই আনন্দবাজার পত্রিকা এই পরামর্শ দিয়েছে। সম্প্রতি শিল্পতালুক নির্মাণে গোটা রাজ্যজুড়েই মমতা সরকার জমি ব্যবহারের ঊর্ধ্বসীমা শিথিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা ধাপে ধাপে পুরোপুরি তুলে দেওয়ার পথেই এগোবে। রাজ্যে ‘শিল্পায়ন ও উন্নয়নের নতুন জোয়ার, কর্মসংস্থানের বদ্ধদশা’ ঘোচাতে এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হওয়ার পথে আনন্দবাজার ‘ঈশান কোণে’ উৎখাত হয়ে যাওয়া স্থানীয় অধিবাসীদের প্রতিবাদ-প্রতিরোধের আশঙ্কা দেখতে পাচ্ছে। ‘যথাসাধ্য ও ন্যায্য ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন’এর পক্ষে কথা বললেও ‘জনস্বার্থের অজুহাতে’ এই প্রকল্প যাতে বানচাল না হয়ে যায়, সেই মর্মেই সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়েছে, “গণতান্ত্রিক দেশে তর্কবিতর্ক, আলাপ-আলোচনা, প্রতিবাদ ইত্যাদি সকলই চলিতে পারে, কিন্তু কাজে বাধা নহে। রাজ্য সরকারকে তাহা নিশ্চিত করিতে হইবে। প্রয়োজনে কঠোর হতে হবে।” আর, সেজন্য রাষ্ট্রক্ষমতা (পড়ুন রাষ্ট্রীয় দমন) ব্যবহারের নিদান দিয়েছে সম্পাদকীয় নিবন্ধ। অর্থাৎ, উচ্ছেদের পূর্বে ন্যায্য ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের পূর্বশর্ত সুনিশ্চিত না করে আলাপ আলোচনার গণতান্ত্রিক প্রসাধনীর পাশাপাশি প্রকল্প রূপায়ণের কাজকে সর্বাধিক অগ্রাধিকারে রাখার চরম অন্যায্য অগণতান্ত্রিক কুমন্ত্রণা দিয়েছে আনন্দবাজার পত্রিকা। আজ পর্যন্ত সমস্ত প্রকল্পের ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, ক্ষতিগ্রস্ত অধিবাসীদের আস্থা-বিশ্বাস আদায় ও জনগণকে সঙ্গে নিয়ে চলার গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি না করে, সরকার ও রাষ্ট্র নাম-কা-ওয়াস্তে পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণের প্যাকেজ ঘোষণা করেই প্রকল্প রূপায়ণের কাজে রক্তচোখ দেখিয়েই তা বাস্তবায়নের পথে পা বাড়িয়েছে, যা ডেকে এনেছে বিক্ষোভ, সামাজিক উত্তেজনা ও অশান্তি।

এদিকে, ঐদিনেরই আনন্দবাজার পত্রিকা আর একটি প্রতিবেদনে ‘কয়লা আছে, তাই আমলারা আসছেন!’ পাঁচামির বিস্তীর্ণ অঞ্চলে অধিবাসীদের চরম বঞ্চনা, অনুন্নয়নের কাহিনী তুলে ধরেছে। যেখানে নেই কোনও উচ্চমাধ্যমিক স্কুল, পানীয় জলের তীব্র সংকটকে নিত্য সঙ্গী করে চলে সেখানকার দিন যাপন, বেহাল রাস্তা ঘাট, সরকারি আবাস যোজনার আওতায় না-আসা পাকা বাড়ি থেকে বঞ্চিত অসংখ্য মানুষ! জনজাতি অধ্যুষিত গ্রামগুলির মাটির নিচে কয়লার বিরাট ভান্ডার খুঁজে পাওয়ার পর হোমড়া-চোমরা আধিকারিকদের আনাগোনা আজ বহুগুণ বেড়েছে, কিন্তু তাঁরা যে তিমিরে ছিলেন, রয়েছেন সেই তিমিরেই।

আর, বহু চিন্তাশীল বুদ্ধিজীবী এই ‘সম্পদের অভিশাপ’ (রিসোর্স কার্স)-র এই বিচিত্র পরিঘটনার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। নোবেল জয়ী অর্থশাস্ত্রী যোশেফ স্টিগলিটজ তার বিখ্যাত প্রবন্ধ — ‘মেকিং ন্যাচারাল রিসোর্সেস্ ইন্টু আ ব্লেসিং র‍্যাদার দ্যান এ কার্স’এ দেখিয়েছেন অনেক দেশ বা খনিজ সম্পদে অত্যন্ত সমৃদ্ধশালী অঞ্চলগুলো মানব বিকাশের নিরিখে বিভিন্ন সূচকে কী নিদারুণভাবে পিছিয়ে রয়েছে। চূড়ান্ত দারিদ্র, ভগ্নপ্রায় স্বাস্থ্যব্যবস্থা, শিশু মৃত্যুর উচ্চহার, শিক্ষার মান তলানিতে, জনগোষ্ঠীর সিংহভাগ মানুষ অপুষ্টিতে আক্রান্ত। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। ভারতের ২৩ শতাংশ লৌহ আকরিকের ভান্ডার আছে ছত্তিশগড়ে, আর সেখানে মাটির নিচে রয়েছে কয়লার বিরাট ভান্ডার। কিন্তু মানব বিকাশের সমস্ত সূচকে তার রেকর্ড রীতিমতো করুণ। অথচ সেখানে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকার মৌ স্বাক্ষরিত হয়েছে টাটা স্টিল ও আরসেলার মিত্তল, ডি বিয়ার্স কনসোলিডেটেড মাইন্স, রিও টিন্টো অ্যান্ড বিএইচপি বিলিয়নের সাথে, বিনিয়োগ হয়েছে বিপুল পরিমাণে এফডিআই। যোজনা পর্ষদের (মোদী যার বিলুপ্তি ঘটিয়ে নীতি আয়োগ বানিয়েছে) এক বিশেষজ্ঞ গোষ্ঠী ২০০৮ সালে পেশ করা এক রিপোর্টে দেখিয়েছে, ১৯৫১ আর ১৯৯০’র মাঝে ৮০ লক্ষ ৫০ হাজার তপসিলি জাতির মানুষ উৎখাত হয়েছেন নানা উন্নয়ন মূলক কর্মকান্ডের দরুণ (এরপর সম্ভবত আর কোন সরকারি রিপোর্ট বেরোয়নি)। আর, বিভিন্ন প্রকল্পের ফলে উচ্ছেদ হওয়া মানুষের মধ্যে পুনর্বাসিত হতে পেরেছেন মাত্র ২৫ শতাংশ। ওই রিপোর্ট উল্লেখ করেছে, “ভারতের বিকাশের গতিপথ স্থায়ীভাবে বসবাসকারী নাগরিকদের জীবন যাত্রায় চূড়ান্ত অস্থিরতা তৈরি করেছে। কয়েক দশক ধরে ভারতীয় রাষ্ট্র এই সমস্ত উচ্ছেদ হওয়া মানুষদের রুটিরুজির বিকল্প কোনও পথ দেখাতে পারলো না।”

২০১১ সালের ৫ জুলাই সুপ্রিম কোর্ট এক জনস্বার্থ মামলায় ঐতিহাসিক রায় দেয়। মাওবাদীদের মোকাবিলা করতে ছত্তিসগড় সরকার গড়ে তোলে সালওয়া জুদুম ঘাতক বাহিনী। এর বৈধ্যতাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে নলিনী সুন্দর সহ বেশ কিছু প্রথিতযশা বুদ্ধিজীবী (যাদের মধ্যে কয়েকজন ভীমা কোরেগাঁও মিথ্যা মামলায় কারান্তরালে) মামলা করেন। সেই মামলায় সালওয়া জুদুমকে বেআইনী ঘোষণা করেই শীর্ষ আদালত ক্ষান্ত থাকেনি, বিকাশের গতিকে ও ‘সামাজিক সুস্থিতিকে বজায় রাখতে’ রাষ্ট্রকে বজ্রমুষ্ঠিতে শাসন করার দমনমূলক ন্যারেটিভ পরিত্যাগ করে সাংবিধানিক শাসনকে ফিরিয়ে আনতে আদেশ দেয়। শুধু তাই নয়, বিরল এই রায়দানে ছত্রে ছত্রে আর্থিক বিকাশের চরম জনবিরোধী দমনমূলক গতিপথকে তীব্র সমালোচনা করেছে শীর্ষ আদালত।

গণতন্ত্রের ধ্বজা ওড়ানো, বঙ্গ সমাজের স্বঘোষিত নীতিবাগীশ আনন্দবাজার তার আসল চেহারা নিজেই উন্মোচিত করল।

- অতনু চক্রবর্তী

খণ্ড-28
সংখ্যা-40