প্রতিবেদন
হায় কঙ্গনা!
Kangana

“আমরা আসল স্বাধীনতা পেয়েছি ২০১৪য়, মোদীজী ক্ষমতায় আসার পর।” গত ১১ নভেম্বর অভিনেত্রী কঙ্গনা রানাওতের মন্তব্য বিজেপির ধামাধরা ‘টাইমস-নাও’ চ্যানেলে।

কঙ্গনা রানাওত প্রকাশ্যে ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানোর জন্য কুপরিচিত বটে। আরএসএস-বিজেপির হিন্দুরাষ্ট্রের প্রচারকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে তার অধ্যাবসায় ও প্যাশন লক্ষণীয়। বিজেপি শাসিত কেন্দ্রীয় সরকারের জনবিরোধী প্রতিটি পদক্ষেপ — নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন, কৃষি আইন, শ্রম কোড লাগু করার কুন্ঠাহীন সমর্থন জানিয়ে, বিদ্বেষেভরা উস্কানিমূলক বক্তব্য রেখে, পেয়েছেন পদ্মশ্রী পুরস্কার। কঙ্গনার সাম্প্রতিক মন্তব্যের পর জনপরিসরে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। রাজনৈতিক মহলে ও নেট দুনিয়ায় কঙ্গনার পদ্মশ্রী খেতাব ফিরিয়ে নেওয়ার দাবিও উঠেছে।

কঙ্গনা রানাওত যিনি নারী স্বাধীনতা, বলিউড ইন্ড্রাস্ট্রির নেপোটিজম (স্বজনপ্রীতির) বিষয়ে মুখ খুলে নেট দুনিয়ায় সুপরিচিত হয়েছিলেন, তার বিজেপি-সংঘের রাজনীতির সাথে ঘনিষ্ঠতা ও উগ্র-জাতিয়তাবাদী, ধর্মীয়-বিদ্বেষী চেহারার প্রকট হওয়া সমাপতন নয়, বরং আরএসএস’এর লিঙ্গ রাজনীতির পরিচায়ক বটে।

ইতিহাসবিদ তনিকা সরকার আরএসএস’এর মহিলা সংগঠন নিয়ে গবেষণায় দেখিয়েছেন, কীভাবে নারীর আওয়াজকে হিন্দুরাষ্ট্রের গ্রহণযোগ্যতার জন্য প্রচার প্রোপাগান্ডায় ব্যবহার করে আরএসএস।

ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের লড়াই থেকে শুরু করে স্বাধীনতাত্তোর ভারতে, ঔপনিবেশিকতাবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে মেয়েরা সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। জল-জঙ্গল-জমির অধিকারের লড়াই থেকে মজদুরদের ন্যায্য মজুরির লড়াইতে আদিবাসী, দলিত ও শ্রমিক শ্রেণীর নারীদের উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। অন্যদিকে, শুধুমাত্র পুরুষদের নিয়ে উগ্র হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির পৃষ্ঠপোষক রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘ ১৯২৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ১১ বছর পর ১৯৩৬ সালে আরএসএস’এর নারী সংগঠন রাষ্ট্রীয় সেবিকা সঙ্ঘের নির্মাণ হয়। রাষ্ট্রীয় সেবিকা সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতা লক্ষ্মীবাই কেলকার আরএসএস’এর প্রতিষ্ঠাতা হেডগেওয়ারের কাছে আরএসএস’এর সদস্যপদের আর্জি নিয়ে গেলে প্রত্যাখ্যাত হন। প্রতিষ্ঠানের প্রায় ১০০ বছর পরেও আরএসএস’এর সদস্যপদের অধিকার একমাত্র পুরুষদের।

হিন্দুরাষ্ট্রের প্রবক্তা গোলওয়ালকার ‘বাঞ্চ অফ থটস্’এ লিখছেন, সমাজে পারিবারিক ও হিন্দুরাষ্ট্রের মূল্যবোধ টিঁকিয়ে রাখা মেয়েদের প্রধান কর্তব্য। সমসাময়িক কালে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে মেয়েরা সক্রিয় রাজনীতিতে অংশ নিলেও, আরএসএস’এর মহিলা শাখার কর্মীদের দায়িত্ব দেওয়া হয় বাড়ির চারকোণের মধ্যে ভবিষ্যতের স্বয়ংসেবকদের শৃঙ্খলা ও সংস্কার শেখানোর। সেবিকা সংগঠন শুরু হওয়ার বহু বছর পরেও, শুধুমাত্র উচ্চবর্ণ, শহুরে, উচ্চ-মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত পরিসরেই সদস্য বিস্তারের কাজ চলে।

পরবর্তীতে ১৯৯০’র দশকে, ভারতে নয়া-উদারবাদের প্রাক্কালে, মেয়েদের রাজনৈতিক পরিচিতিকে ব্যবহারের পথ নেয় আরএসএস। ‘নারী-শক্তি’কে ঊর্ধ্বে তুলে ধরার নামে হিন্দু মেয়েদের উপর চাপানো হয় ধর্মীয় হানাহানির আগুনকে জাগিয়ে তোলার দায়িত্ব। বিদ্বেষের উদ্দ্যেশ্যে উচ্চবর্ণ হিন্দু-নারীর গৈরিক-জাগরণের রাশ থাকে পুরুষ চালিত আরএসএস’এর হাতেই। এই নিয়ন্ত্রণ এমনই যে, গুজরাটে মুসলিম মেয়েদের উপর পুরুষতান্ত্রিকতার নিষ্ঠুরতম নিদর্শন চলাকালীন গৈরিক নারীশক্তির মধ্যে থেকে কোনো প্রতিবাদ উঠে আসে না বরং নির্মম হিংসায় সহায়ক শক্তি হিসাবে কাজ করে গৈরিক নারী।

রাম-জন্মভূমির প্রচারাভিযানে দুর্গা বাহিনীর সাধ্বী ঋতম্বরা, বিজেপির উমা ভারতী, বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সাধ্বী প্রাচীরা মুসলিমদের বিরুদ্ধে প্রোগ্রাম সংগঠিত করার কাজে, বহু মানুষ, বিশেষ করে মহিলাদের সংগঠিত করতে সফল হয়। হিন্দু-রাষ্ট্র তৈরির কাজে প্রাণপাত করার পরেও এই হিন্দুত্ববাদী দক্ষিণপন্থী সংগঠনগুলির তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক নেতৃত্ব, আরএসএস’এর কোনও কমিটি কাঠামোতে মহিলাদের স্থান হয়নি। অগুনতি সংখ্যালঘু মানুষের রক্ত ঝরিয়ে, অসংখ্য মসজিদ গুঁড়িয়ে, গণধর্ষণ সংগঠিত করা সফল হলে, এই মেয়েদের আবার ফিরে যেতে বলা হয় অন্দরমহলে। নাৎসি জার্মানিতে ইহুদিদের জেনোসাইড সমাধায় সফল হিটলার একইভাবে তার সমর্থক মহিলাদের নির্দেশ দিয়েছিল, “গো ব্যাক টু ইয়োর কিচেনস”। সংক্ষেপে নারীর জন্য হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্টরা দুটি ভূমিকা নির্দিষ্ট করেছে, একটি হিন্দু-রাষ্ট্রের স্নেহশীলা জননী, অন্যটি দ্বেষের বার্তাবাহক।

একবিংশ শতাব্দীতে, সোশ্যাল মিডিয়ার ইনফ্লুয়েন্সরদের যুগে কঙ্গনা — সাভারকার, গোলওয়ালকারদের বার্তাবাহক মাত্র। ‘বাঞ্চ অফ থটস্’ বইয়ের ‘শহীদরা মহান কিন্তু আদর্শ নয়’ চ্যাপ্টারে, গোলওয়ালকার, ভারতের স্বাধীনতার জন্য মৃত্যুবরণ করা শহীদদের বর্ণিত করেছেন ‘ব্যর্থতা' হিসাবে। পরাধীন ভারতে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসন যখন তুঙ্গে, আরএসএস’এর প্রবক্তা গোলওয়ালকার নিজেদের শত্রু হিসাবে চিহ্নিত করছেন ভারতীয় মুসলিমদের। আন্দামানের সেলুলার জেলে, ব্রিটিশ-রাজের প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্য জানিয়ে ‘বীর’ সাভারকারের লেখা মুচলেকা, স্বাধীনতা আন্দোলন চলাকালীন আরএসএস’এর ব্রিটিশ-আনুগত্যের অন্যতম সাক্ষ্য।। কঙ্গনা রানাওতের বক্তব্য আসলে দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি আরএসএস’এর বিশ্বাসঘাতকতার পুনরুচ্চারণও বটে। যে বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাসকে মেকী দেশপ্রেমের নামে ভুলিয়ে দিতে চায় আজকের মোদী-যোগী নেক্সাস।

একদিকে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য ধর্ম-লিঙ্গ নির্বিশেষে সংগ্রামী মানুষদের আত্মত্যাগ, অন্যদিকে হিন্দুরাষ্ট্রের লক্ষ্যে ব্রিটিশরাজের প্রতি আনুগত্য, একদিকে গনতান্ত্রিক মূল্যবোধ, অন্যদিকে মৌলবাদের দাপট — এই দুই পরস্পরবিরোধী ধারার সংঘাতের মধ্যে দিয়ে স্বাধীন ভারতের নির্মাণ। আজ, আরএসএস চালিত বিজেপি সরকার দেশের মানুষের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে, নিজেদের পকেট ভরতে কর্পোরেট পুঁজিপতিদের হাতে তুলে দিচ্ছে দেশের জনসম্পদ। লক্ষ-কোটি টাকার বিনিময়ে কর্পোরেট মিডিয়া হাউসগুলিতে প্রচার করা হচ্ছে মিথ্যা ইতিহাস। সত্য সন্ধানের চেষ্টা করলে, তকমা মিলছে দেশদ্রোহীর।

আজ স্বাধীনতার ৭৫ বছর পর, আমরা আবারও সেই সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে, যখন নয়া ভারতকে দিশা দেখানোর জন্য সঠিক ‘পক্ষ’ বেছে নেওয়া জরুরী হয়ে পড়েছে।

- সম্প্রীতি মুখার্জি 

খণ্ড-28
সংখ্যা-40