আদিবাসী সংযুক্ত মোর্চা :
সর্বভারতীয় আদিবাসী অধিকার কনভেনশন থেকে গঠিত হল আদিবাসী সংঘর্ষ মোর্চা। তেরোটি রাজ্য থেকে আগত বিভিন্ন ভাষাভাষী আদিবাসী জনসমুদায়ের শতাধিক প্রতিনিধি কনভেনশনে অংশ নেন। বিভিন্ন অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধি উঠে আসে। দেশ জুড়ে আদিবাসীদের বহুবিধ লড়াই আন্দোলনকে সমন্বিত ও ঐক্যবদ্ধ করার প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন সকলেই। এই লক্ষ্যে ‘আদিবাসী সংঘর্ষ মোর্চা’-র ঘোষণা গৃহীত হয়। এই কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে কনভেনশন থেকে জাতীয় স্তরে আহ্বায়কমণ্ডলী, জাতীয় পরিষদ, উপদেষ্টা মণ্ডলী ও সংহতি পরিষদ — এই চার স্তর বিশিষ্ট কাঠামো নির্বাচন করা হয়। এর মধ্যে একমাত্র সংহতি পরিষদেই অ-আদিবাসী সাথী-বন্ধুরা থাকতে পারবেন। জাতীয় পরিষদ মূল নীতি নির্ধারক সংস্থা যা নিজেকে উন্মুক্ত রাখবে আগামী চলার পথে নতুন নতুন সংগ্রামের আদিবাসী প্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্ত করে নিতে।
আদিবাসী অধিকার কনভেনশনের স্থান ও সময় দুইই ছিল বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। ১৫ নভেম্বর বিরসা মুণ্ডার জন্মজয়ন্তী এবং ঝাড়খণ্ড রাজ্যেরও প্রতিষ্ঠা দিবস। ঝাড়খণ্ড ভারতের একমাত্র রাজ্য যার সাথে আদিবাসী পরিচিতি ও সংগ্রামের গভীর ইতিহাস জড়িত। ঝাড়খন্ডের রাঁচি শহরের উপকণ্ঠে ‘বাগইচা’ ফাদার স্ট্যান স্বামীর সামাজিক প্রতিষ্ঠান। এখানেই অনুষ্ঠিত হল আদিবাসী অধিকার কনভেনশন।
কনভেনশনের পূর্বসন্ধ্যায় বাগইচার মুক্ত মঞ্চে ধামসা মাদল আর বিভিন্ন ভাষা ও ভঙ্গীর গান ও নাচ বৈচিত্র্যের মাধ্যমে ঐক্যের আবেগ তৈরি করে। ঝাড়খণ্ড জনসংস্কৃতি মঞ্চের সাঁওতালি টিম ‘অঞ্জোম’, নাগপুরি টিম ‘প্রেরণা’ ও ‘মান্দর’ ও মুণ্ডারি টিম ‘সেঙ্গেল’-এর নৃত্যগীত প্রদর্শনে ঐতিহ্য ও আধুনিকতার বৈপ্লবিক মেলবন্ধন গভীর আত্মবিশ্বাসের জন্ম দেয়। এই সন্ধ্যাতেই সভাকক্ষে স্বাগত ভাষণে মনোজ ভক্ত বলেন, ভাষার বাধার দেওয়াল হঠিয়ে দিয়ে লড়াই-সংঘর্ষ আমাদের এক করে দেয়। বিরসা মুণ্ডা থেকে শুরু করে ফাদার স্ট্যান স্বামী, ঝাড়খণ্ড রাজ্য গঠনের লড়াই থেকে শুরু করে সিএনটি-এসপিটি বাঁচানোর লড়াই বা পাথালগাঢ়ি, বিধানসভার ভেতরে বাইরে কিংবদন্তি নেতা মহেন্দ্র সিং-এর লড়াই ও শাহাদাত থেকে শুরু করে বিজেপিকে রাজ্যের ক্ষমতা থেকে অপসারন — অজস্র লড়াই, অনেক বিজয় ও শাহাদাতের ঝাড়খণ্ডে সকলকে স্বাগত জানিয়ে তিনি নতুন লড়ায়ের অঙ্গীকার ও এক বৃহত্তর প্ল্যাটফর্মের দিশা নিয়ে কনভেনশন থেকে বেরনোর আহ্বান রাখেন। উড়িষ্যার লড়াকু জননেতা তিরুপতি গোমাঙ্গ কনভেনশন পরিচালনার রূপরেখা পেশ করেন। কর্ণাটকের সাথী ক্লিফটন ডি রোজারিও কনভেনশনের বিষয়-প্রবেশ ভাষণে আদিবাসী পরিচিতির স্বীকৃতি, পঞ্চম তপশীল, বনাধিকার আইন, আদালতের ভূমিকা ও ঐক্যবদ্ধ হওয়ার বাস্তবতা তুলে ধরার সাথে সাথে কর্ণাটকের কফি বাগিচাগুলির আদিবাসীদের বঞ্চনা লাঞ্ছনা এবং এমনকি বর্তমান সময়েও কীভাবে চলতি বাসে আদিবাসীরা সীটে বসার অধিকারটাও পায় না সে বিষয়ে বর্ণনা করেন। ঝাড়খণ্ডের লড়াকু জননেত্রী দয়ামনী বারলা বলেন, দেশের লুটেরারাও বিরসা জয়ন্তিতে ‘নমন’ করবে, লুটেরাগুলো সব একজোট, আমাদেরও একজোট হতে হবে। তিনি বলেন, আরএসএস বিজেপি আদিবাসী স্বীকৃতি দিতে চায় না, ওরা ঝাড়খণ্ডের নাম দিতে চেয়েছিল বনাঞ্চল, কিন্তু আদিবাসীরা লড়াই করে ঝাড়খণ্ড আদায় করেছে। দয়ামনি বলেন, কেবল কিছু সরকারি চাল-ডাল পাওয়ার লড়াইয়ে আটকে থাকলে হবে না, কর্পোরেটদের কাছে দেশ বেচে দেওয়ার বিরুদ্ধে জোট বাঁধতে হবে, আদিবাসীদের ঘোষণা করতে হবে যে কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী প্রতিটি ইঞ্চি জমির ও আমাদের প্রকৃতি পরিবেশ বাঁচানোর বাঁচানোর দায়িত্ব আমাদের, এই কনভেনশন থেকে আদিবাসী সংঘর্ষ মোর্চা প্রথম সেই বিউগল বাজানোর কাজ করুক।
১৫ নভেম্বর সকালে বাগইচা চত্বরে বিরসা মুণ্ডার মূর্তিতে মাল্যদান করে সকলে জমায়েত হন চত্বরের অন্যপ্রান্তে “পাথাল গাঢ়ি”-র সামনে। পুঁতে রাখা এই পাথরের ফলক নিজেই পাথালগাঢ়ি আন্দোলনের দ্যোতক ও স্মারক। এই পাথরের ফলকের দুই পৃষ্ঠে লেখা আছে তিলকা মাঝি থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত বিভিন্ন শহীদ ও রাষ্ট্রীয় গণহত্যার কথা। সর্বশেষ সংযোজিত নাম ফাদার স্ট্যান স্বামীর। এই পাথালগাঢ়িকে ও তার পাশে রাখা ফাদার স্ট্যান স্বামীর প্রতিকৃতিকে কেন্দ্র করে ঘিরে দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা জানান হয় এবং পাথালগাঢ়ি আন্দোলনের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সংক্ষেপে তুলে ধরা হয়। এরপর সভাকক্ষে কনভেনশনকে সম্বোধিত করেন কমরেড দীপঙ্কর ভট্টাচার্য। বিরসা মুণ্ডার “আবুয়া দিশম, আবুয়া রাজ” শ্লোগানের কথা টেনে বিরসাকে ভগৎ সিংহের আগের এক ভগৎ সিং বলে বর্ণনা করেন এবং আদিবাসী সংগ্রামকে কৃষক শ্রমিকের সংগ্রামের সাথে ঐক্যবদ্ধ হিসেবে তথা দেশ বাঁচানোর লড়াইয়ের অগ্রভাগের শক্তি হিসেবে ব্যাখ্যা করেন। কনভেনশনের প্রস্তাবনা পেশ করেন দেবকি নন্দন বেদিয়া। ঝাড়খণ্ডের প্রেমচাঁদ মুর্মু, পশ্চিমবাংলার সরস্বতী বেসরা, কার্বি আংলঙের ইংইপি, কর্ণাটকের কাব্য, গুজরাটের কমলেশ, ইউপির বেগন রাম, মহারাষ্ট্রের শ্যাম গোহেল সহ বিভিন্ন প্রতিনিধিরা নিজেদের বক্তব্য ও অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। পূর্বে উল্লিখিত চার স্তর বিশিষ্ট কাঠামো নির্বাচিত হয়। সম্মেলন পরিচালকমণ্ডলী হিসাবে ছিলেন, প্রতিমা ইংইপি, রবি ফাংচো, সুমন্তি ইক্কা, তিরুপতি গোমাঙ্গ, দেবকিনন্দন বেদিয়া ও জেভিয়ার কুজুর। কনভেনশনের শেষে সুমন্তি এক্কার ধন্যবাদ জ্ঞাপন ভাষনের মধ্যে দিয়ে সম্মেলন সমাপ্ত হয়।