সিদ্ধান্ত
অযোধ্যা পাহাড় সংলগ্ন গ্রামগুলির আন্দোলনের পাশে সিপিআই(এমএল)
movement of villages


[ প্রতিনিধি দলের পক্ষ থেকে দেওয়া রিপোর্ট ]

গত ১ নভেম্বর ‘সারা বাংলা আদিবাসী অধিকার ও বিকাশ মঞ্চ’ ও সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের একটি প্রতিনিধি দল পুরুলিয়ার অযোধ্যায় যায়। বেশ কিছুদিন যাবৎ যে গণ আন্দোলন সেখানে চলছে তার সংহতিতে। ‘ঠুড়গা পাম্পড স্টোরেজ প্রকল্প’ তৈরির বিরুদ্ধে। অযোধ্যা পাহাড়ের কোলে প্রকৃতি ও আদিবাসী জনগোষ্ঠি এই প্রকল্পের ফলে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা। অযোধ্য পাহাড়ের আদিবাসী নেতৃত্ব গত ৯ অগাস্ট এক সমাবেশের ডাক দিয়েছিল। সেখানে জঙ্গল বাঁচাও কমিটি, প্রকৃতি বাঁচাও আদিবাসী বাঁচাও মঞ্চ, ভারত জাকাত মাঝি পরগনা মহল এবং অন্যান্য সংগঠন যোগ দিয়েছিল। বিভিন্ন জেলার আদিবাসী ও অ-আদিবাসী মানুষ একজোট হয়ে এই সমাবেশকে সফল করেন। ৮ অক্টোবর তাঁরা পুরুলিয়া জেলা শাসককে ডেপুটেশন দেন এবং সেখানে ধর্ণায় বসেন, পরে জেলা শাসকের আশ্বাসে তখনকার মত অবস্থান উঠিয়ে নেন। হাইকোর্টেও এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে আইনি লড়াই চলছে। হাইকোর্টে প্রাথমিক সাফল্যও কিছু পাওয়া গেছে। আদিবাসী অধিকার মঞ্চ ও পার্টির প্রতিনিধি দল গত সোমবার ওখানে পৌঁছায়। দলে ছিলেন হুগলী জেলার পাগান মুর্মু ও গোপাল রায়, বাঁকুড়া জেলার রামনিবাস বাস্কে, মঙ্গল মুর্মু এবং পার্টির রাজ্য কমিটির সদস্য ফারহান হোসেন খান।

পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া জেলার অযোধ্যা পাহাড় প্রকৃতিপ্রেমিদের কাছে একটি আকর্ষণীয় স্থান। আবার আদিবাসীদের কাছে, বিশেষত সাঁওতাল সমাজের মানুষদের কাছে এই ‘আযোদিয়া বুরু’ পবিত্র স্থান, একে ঘিরে রয়েছে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রথা ও ঐতিহ্যের ধারা। ইদানীং কালে এই এখানকার আদিবাসীদের মধ্যে একটা আশঙ্কা ও ভয়ের সৃষ্টি হয়েছে। তাই এখানকার মনুষজন কিছুটা সংগঠিতভাবে এই আশঙ্কা বা ভয়কে পরাস্ত করতে চাইছেন। এই পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার কারণ পাহাড় এখন কর্পোরেটদের গ্রাসে চলে যাচ্ছে। স্থানীয় মানুষদের সাথে কথা বলে যা জানা যায় —

Ayodhya hills

 

১) এখানকার পর্যটনকে ঘিরে একটি বেআইনি জমি-চক্র চলছে। বাইরে থেকে আসা অ-আদিবাসী ব্যবসায়ি প্রথমে কোনও আদিবাসী মানুষের নামে থাকা বনের জমি অন্য কোনও আদিবাসী মানুষের নামে কিনে নেয়। পরে দ্বিতীয় জনের কাছ থেকে একটা লম্বা সময়ের মেয়াদে সেই জমি লিজ নিয়ে সেখানে লজ বানিয়ে ব্যাবসা শুরু করে। যে পরিমাণ জমি তারা লিজ নিচ্ছে কোনও এক আদিবাসীর কাছ থেকে তার চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণ বনের জমি দখল করে এইসব লজ বানানো হচ্ছে। এই বেআইনি কাজে প্রশাসনের মদত থাকছে। ফলত পর্যটন শিল্প এখানকার আদিবাসীদের অর্থনৈতিক স্বস্তি দেওয়ার বদলে দুর্নীতি ও জমি লুটের ক্ষেত্রে পর্যবসিত হয়েছে।

২) ইতিমধ্যে ‘পুরুলিয়া পাম্পড স্টোরেজ প্রজেক্ট’ (PPSP) নামে যে প্রকল্পের দরুণ একটি লোয়ার (পাহাড়ের নীচে) ও একটি আপার (পাহাড়ের ওপরে) ড্যাম বানানো হয়েছে তাতে বিশাল অংশের বন ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। বনের এই অংশ হাতিদের বিচরণ ও বিশ্রাম নেওয়ার জায়গা ছিলো। এরপর থেকে হাতিদের লোকালয়ে প্রবেশ ব্যাপক বেড়ে গেছে বলে জানাচ্ছেন স্থানীয়রা।

৩) এখানে যে নতুন ঠুড়গা পাম্পড স্টোরেজ প্রজেক্ট (TPSP) হচ্ছে তা এখানকার মানুষকে ধোঁকা দিয়ে। পঞ্চায়েত থেকে কোনও একটা মিটিং ডেকে সেখানে টিফিন পেতে গেলে সই লাগবে, এই বলে কিছু পরিমাণ মানুষের সই নিয়ে সেটাকেই গ্রামসভার স্বীকৃতি বলে দেখানো হয়েছে।এই প্রকল্প নিয়ে কোনও চর্চা আলোচনা না করে, কোনওরকম উল্লেখ না করেই এ কাজ করা হয়েছে। এখানে প্রজেক্ট হলে মূল বনভূমিটাই ধ্বংস হয়ে যাবে। ১১টা গ্রাম সম্পূর্ণভাবে উচ্ছেদ হওয়ার মুখে। এখানকার মানুষের অনুমান অনুযায়ী এই প্রজেক্টের মধ্যে দিয়ে সরকারের লাভের পরিমাণ খুব কম। এই প্রজেক্টকে দেখিয়ে এখানকার পাহাড়ের কাঠ ও পাহাড়ে সুড়ঙ্গ কেটে মাটির নীচের যে মূল্যবান মাটি রয়েছে তা পাচার হওয়ার সন্দেহ করছেন এখানকার মানুষ, যা PPSP করার সময় দেখা গিয়েছিলো। পূর্ব অভিজ্ঞতাতে তাঁরা দেখেছিলেন কীভাবে মানুষের কাছ থেকে জমি কিনে, পরে কিছু মাটি পাড়ে লাগানো হয়েছিলো আর বেশিরভাগটা ট্রাকে করে ত্রিপলের প্যাকিং দিয়ে বাইরে পাঠানো হয়েছিলো।

৪) এই প্রকল্পকে রুখে দেওয়ার জন্য এখানকার নেতৃত্ব সুপেন হেমব্রম, নকুল বাস্কেরা চেষ্টা করে যাচ্ছেন। সাথে সাথে পাহাড়ের মানুষের চাহিদাগুলির দাবিও তাঁরা করে যাচ্ছেন। এখানকার নেতৃত্ব মনে করছেন অধিকাংশ মানুষ তাঁদের সাথে রয়েছে। কিছু মানুষ প্রোজেক্ট হলে কাজ পাবে বলে প্রচার করছেন, আর কিছু জনকে (মূলত তৃণমূলকর্মী) আগের থেকেই টাকা দিয়ে রাখা হয়েছে যারা এই প্রজেক্টের পক্ষে দাঁড়াচ্ছে। যেহেতু এই প্রজেক্ট নিয়ে হাইকোর্টে কেস চলছে তাই এখানকার স্থানীয় নেতৃত্ব এখন মূলত গ্রামসভাগুলি গঠনের চেষ্টা করছেন।

৫) পুলিশ ইতিমধ্যে বিপর্যয় মোকাবিলা আইনে একটি মামলা দিয়েছে স্থানীয় নেতৃত্বদের বিরুদ্ধে, গত ২৮ সেপ্টেম্বর। ওখানে সেদিন অরণ্যের অধিকার আইন সম্পর্কে একটি সচেতনতা যাত্রা চলছিল। যদিও এই দমন করার চক্রান্তকে আমল দিচ্ছেন না স্থানীয় আদিবাসী সমাজের মানুষজন।

লিডারদের সাথে খোলামেলা আলোচনা পার্টি ও আদিবাসী অধিকার ও বিকাশ মঞ্চের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, “আপনাদের সাথে লড়াই-এর সংহতিতে আমরা রয়েছি, ভবিষ্যতে প্রয়োজনে আমরা সাথে থাকবো”।

অযোধ্যা হিল টপে ছাতনি গ্রামের বাসিন্দা এবং এই আন্দোলনের অন্যতম নেতৃত্ব নকুল বাস্কে বলেন, “আমাদের হাতিয়ার ফরেস্ট রাইটস এক্ট। এটাকে কাজে লাগিয়ে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি। আমরা এই প্রকল্প চাই না। একেই রোজগারের লোভ দেখিয়ে সহজ সরল গ্রামবাসীদের জমি অনির্দিষ্টকালের জন্যে লিজ নেয়া তার পাশাপাশি মাপের বেশি জমি দখল করে নিচ্ছে দিকুরা। যার ফলে কাটা পড়ছে অনেক জঙ্গলের গাছ। এগুলোর সঙ্গে কিছু গ্রামের নাম পরিবর্তন করে দেওয়া হচ্ছে। যার ফলে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামের ইতিহাস ও ঐতিহ্য। আমরা এর তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি।”

খণ্ড-28
সংখ্যা-39