সম্পাদকীয়
ছিনিমিনি খেলা চলছে জনস্বাস্থ্য নিয়ে
 public health

পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ‘স্বাস্থ্যসাথী’ চিকিৎসা বিমা প্রকল্প চালুর এখনও বছর গড়ায়নি, এখনও কার্ড বিলি লক্ষ্যমাত্রা থেকে বহু পেছনে পড়ে রয়েছে, এরমধ্যে সরকারপক্ষ শোনাতে শুরু করেছে এমন নানা পর্যালোচনী নির্দেশিকা, যেসব ঠেকছে পরস্পর বিরোধী হিসেবে। যেমন একদিকে বলা হচ্ছে, রোগীকে ‘রিফিউজ’ করা —‘রেফার’ করা যাবে না, অন্যদিকে পূর্বশর্তারোপ করা হচ্ছে সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হতে গেলে ‘স্বাস্থ্যসাথী’ বা সিজিএইচএস, ডব্লিউবিজিএস, ইএসআই — কোনও না কোনও ধরনের কার্ড লাগবেই। না থাকলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে স্বাস্থ্যসাথী কার্ডের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। এতই যদি সদিচ্ছা তাহলে গোড়া থেকেই এই ব্যবস্থা চালু করা হয়নি কেন? যখন ‘দুয়ারে’ কার্ড বিলিবন্টনের পরিকাঠামো পর্যাপ্ত নয় বলে প্রমাণিত হচ্ছে তখন হাসপাতালে তার ব্যবস্থা কি নিশ্চিত করে তোলা হবে? নাকি শোনানো হচ্ছে স্তোকবাক্য! এই সন্দেহ জাগে এজন্য কারণ সরকার পক্ষের কথায় ও কাজে প্রায়শই ধোঁকা খেতে হয়। সরকার দাবি করছে কার্ড পেয়ে গেছে প্রায় ২.৩০ কোটি পরিবার, সেইমতো পরিষেবা পাওয়ার আওতায় এসে যাওয়া জনসংখ্যা কমবেশি ৮ কোটির মতো। যদিও অনুন্নত জেলাগুলোতে কার্ড বণ্টন কর্মসূচি যথেষ্ট অবহেলিত। ফলে যত কোটি পরিবারকে কার্ড দিয়ে দেওয়ার পরিসংখ্যান সরকার জানাচ্ছে তার যথার্থতা নিয়ে জিজ্ঞাসা থেকেই যাচ্ছে। রাজ্য সরকার উপরন্তু বড় গলা তুলে দাবি করছে ইতিমধ্যেই ‘জাল’ কার্ড ধরা পড়েছে বিপুল সংখ্যায়, যার উপভোক্তার সংখ্যা আনুমানিক ৫০ লক্ষের মতো। কেবলমাত্র একজন সদস্য ভিত্তিক উপভোক্তার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১০ লক্ষের মতো। সরকারি অনুমানে এই সংখ্যাটিও যথেষ্ট গোলমেলে। স্বাস্থ্য প্রশাসন বলছে এহেন ভূয়ো কার্ডের প্রমাণ হল, হয় তাতে আধার নম্বর উল্লেখ নেই, নয়তো একই আধার নম্বর উল্লেখ রয়েছে একাধিক কার্ডে। কিন্তু তাতে কি তথ্যপ্রমাণ হয় যে, জাল? সরকার কি করে দাবি করতে পারে এইসমস্ত অসঙ্গতির দায় সরকারি দায়িত্বে কার্ড তৈরির বেলায় হয়নি? সরকারের দাবি মতো ভুতুড়ে কার্ডের সংখ্যা প্রমাণ হলে তো মোট বিলি হওয়া কার্ডের সংখ্যা অনেক কমে আসবে। এবিষয়ে আমজনতাকে রাখা হচ্ছে ধোঁয়াশায়। নাকি এরমধ্যে রয়েছে এক বড় সংখ্যায় উপভোক্তাদের ছেঁটে ফেলতে ‘গল্প’ তৈরির চেষ্টা, অথবা প্রকল্পটি থামানো-গোটানোর ‘খেলা’! এরকম ‘খেলা’ কেন্দ্রের মোদী সরকার তো বহুত দেখিয়েছে। সরকারি গণবণ্টন ব্যবস্থার ক্ষেত্রে, এমএনআরইজিএ খাতে, বা রাজ্যে রাজ্যে ভ্যাক্সিন কোটা বিলির ক্ষেত্রে। সংখ্যাতত্ত্বে জল মেশানোয়, বৈষম্য চালানোয় মোদীর খাতায় কোনও অভাব দ্বিধা রাখা হয় না।

মমতা সরকারও নেয় একই হীন কৌশলের আশ্রয়, যেখানে প্রতিটি ক্ষেত্রবিশেষে জনপ্রিয়তাবাদী সংস্কারসূচি রূপায়ণের পদক্ষেপ করা হয় এক বর্গের জন্য প্যাকেজ চালু করা হয় অন্য আরেক বর্গের জন্য অনুসৃত প্যাকেজ প্রত্যাহারের বিনিময়ে। যেমন স্কুলের মেয়েদের জন্য সাইকেল প্রদানের প্রকল্প চালু হয়েছে, বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে নির্মাণ শ্রমিকদের সাইকেল পাওয়ার সুযোগ। নয়া উদারবাদী অর্থনীতির ধাঁচায় সস্তা জনপ্রিয়তাবাদী ফায়দা লুটে নেওয়ার এটাই জারিজুরি। বেসরকারি হাসপাতাল ও নার্সিং হোম ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে রাজ্য সরকার এখনও ব্যর্থ। প্রয়োজনীয় কার্যকরি পদক্ষেপ করছে কি! এক্ষেত্রে মালিক ও দালালচক্রের আঁতাত গজিয়ে ওঠা অস্বাভাবিক নয়। বিশেষ করে সরকারি হাসপাতাল ব্যবস্থা যখন অপ্রতুল, সেখানে যখন রিফিউজ আর রেফারে হয়রান হতে হয়, তখন নিরুপায় হয়ে দ্বারস্থ হতে হয় বেসরকারি হাসপাতাল ও নার্সিংহোমের, আর তার সুযোগ নিয়ে উত্তরোত্তর হয়রান করায় কর্তৃপক্ষ। সরকারের হিসেব মতো রাজ্যে কার্ড গ্রহণযোগ্য নিরাময় কেন্দ্রের সংখ্যা মোট আনুমানিক ৩,৩০০। রাজ্যের ৮-৯ কোটি জনসংখ্যার তুলনায় কম। সরকারি হাসপাতালে যেমন, তেমনি বেসরকারি হাসপাতালেও রোগীর পরিচিতি থেকে শুরু করে ভর্তিতে, রোগ নির্ণয়ে ও চিকিৎসায় চলে দীর্ঘসূত্রিতা। সরকার বলছে বেসরকারি হাসপাতালবর্গ চিকিৎসার নামে কার্ডের বিনিময়ে কেবলই বাড়াচ্ছে ভূয়ো বিল। এইসব যদি শুরু হয়ে থাকে তবে সরকার জরুরি কড়া ব্যবস্থা নিক। তা না করে মুখ্যমন্ত্রীর মুখে মাঝেমধ্যে ‘বাড়াবাড়ি করলে লাইসেন্স বাতিলের’ হুঙ্কার কার্যত প্রতিপন্ন হয় বায়বীয়ই।

এযাবত পর্যালোচনা থেকে কতগুলো জরুরী গণদাবি উঠে আসে। প্রথমত, যুদ্ধকালীন পদক্ষেপে স্বাস্থ্যসাথী কার্ড বিলির লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে হবে। কার্ড থাকুক না-থাকুক কোন অজুহাতে একজনও উপভোক্তার চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার কেড়ে নেওয়া চলবে না। সরকারের তত্ত্বাবধান কার্যকরি করতে হবে জেট গতিতে, ঝেঁটিয়ে দূর করতে হবে গতানুগতিক আমলাতান্ত্রিকতাকে, জায়গা করে দিতে হবে জনগণের গণতান্ত্রিকতাকে, সমাজ-সংগঠনের গণতদারকিকে। আর প্রয়োজনে সজাগতা বহুগুণ বাড়াতে হবে, সাহসী ব্যবস্থা নিতে হবে মুনাফাখোর স্বাস্থ্য ব্যবসায়ীদের।

খণ্ড-28
সংখ্যা-38