খবরা-খবর
জলে জ্বলে জীবন ...
burns in water

“আমার ঘরটা দেখে যান দাদা, আমার প্যারালাইজড শ্বশুর এই মাচাতে এভাবেই শুয়ে ছিলেন ক’টা দিন, পিঠের নিচেই জল ... ভোটের সময়ে সবাই বলে ঘর দেবে, কিন্তু আজ অবধি একটা ত্রিপলও দিলো না কেউ, পঞ্চায়েতে এল দেখলাম, কারা যে পেল ... আমাদের নেই” — বলে চলেন একের পর এক বাড়ির মহিলারা ... “জানেন বাচ্চাগুলোকে খাওয়ানোর গুঁড়ো দুধটাও জোটাতে পারিনি ক’দিন, কেউ কেউ রামকৃষ্ণ মিশনের দেওয়া চিঁড়ে পেয়েছে”। সোনার ফসল ফলায় যে, তার বান ভেসে জোটে না আহার! কৃষিজীবি মানুষের হাতে সোনা ফলে — হয় বাংলায় নয় বম্বেতে। বয়স্করা এখনও ক্ষেতমজুরিতে লেগে আছেন, যদিও অন্যের জমিতে। গ্রামের কমবয়সী ছেলেরা সোনার কাজে রাজ্যের বাইরে। কিছু গ্রামের মানুষ আবার বাইরে যান না, এলাকাতেই ঘরে ঘরে চলে দর্জির কাজ। সব কিছুই মাইক্রোফিনান্সের ঋণনির্ভর। জানুয়ারী থেকে মে’র মধ্যে টুকটাক চাষবাস, বাকি ৭ মাস দুয়ারে বন্যার প্রহর গোনা। তবে বিগত ৩/৪ বছর সেটা কম থাকলেও এবার আচমকা আঘাত! ডিভিসি জল ছাড়লেই টইটম্বুর, তার উপর অতিবর্ষণ, ভরা কোটাল চলতে থাকলে জল আর নামার নাম নেই। পিলারের উপর দাঁড়ানো পাকা বাড়িগুলোর একতলা অবলীলায় জলতলে আর বাড়ি মাটির হলে তা বারবার বাঁধা আর বারবার কাদা! ইতিউতি এসবই বাংলার বারোমাস্যা। হুগলীর আরামবাগ মহকুমার খানাকুল থানার খানাকুল–২ নং ব্লকের প্রায় ১৫টা অঞ্চলের চিত্র কমবেশি একই। তারকেশ্বর-গড়েরঘাট বাস রাজহাটি পেরোলেই ভূমি ক্রমশ নিচু থেকে আরো নিচু অতএব আরো দুর্গতি!

অগস্টের মাঝামাঝি আমাদের তরফে প্রথমবার যাওয়া হয় মাড়োখানা পঞ্চায়েতের চাঁদকুণ্ডু ও সুন্দরপুর গ্রামে। বাস থেকে নামার পর টোটো নিয়ে খানিকটা ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ে কেবল জমির কয়েকটা আল জেগে আছে, সেখান থেকে ঘরের দোরগোড়ায় যাওয়া-আসার ভরসা কিছুদিনের জন্য নৌকাই। যত বেশি ভেতরের গ্রাম, জল নামতে সময় লাগে তত বেশি, বাস রাস্তার দুই ধারের বাড়িগুলোরও দেওয়ালের প্রায় ৮/১০ ফুট উচ্চতা পর্যন্ত উঠে যায় জল। বাড়ির ভিতরে মানুষ-গরু-ছাগল কোথাও কোথাও যৌথ যাপন। যাদের দো’তলা তাদের তবু উপরে ওঠার জায়গা থাকে, বাকিরা কেউ মাচায়, কেউ বা গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে। পাড়ার ফুটবল মাঠটা জল বাড়লেই যে চেহারা নেয় তার মাঝে ক্লাবঘরটাকে দেখলে মনে হয় তলিয়ে যাওয়া কোনো প্রাচীন সভ্যতার এক খণ্ড সাক্ষী যেন আবার জেগে উঠেছে নদীর বুকে! গ্রামগুলোতে প্রায় শ’দেড়েক তপশিলী জাতিভুক্ত পরিবার, অতীতে দীর্ঘকালের বামপন্থী সমর্থনভিত্তি, এবার ভোট পড়েছে পদ্মফুলে! এলাকায় হনুমানের প্রতি একটা বিশেষ ভক্তি চোখে পড়ে। স্থানীয় একজন জানালেন যে, ব্যাপারটা অনেক বছরেরই, কোথাও হনুমান মারা গেলে সেখানে কেউ কেউ শ্রাদ্ধানুষ্ঠানও করত, তবে ইদানীং কয়েক বছর যাবৎ সে’সব জায়গায় নাকি ভক্তির তোড়ে হনুমান মন্দির অবধি বানিয়ে ফেলা হচ্ছে। যদিও গোষ্ঠীকোন্দলের (কেবল ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে নয়, সময় নিয়ে লালনপালন করা সাম্প্রদায়িকতার গেরুয়া অন্তঃসলিলা স্রোত এই ঝামেলার গোড়ায় যে অনবরত জল দিয়ে চলে তা কথা বললেই বোঝা যায়) পরিণতিতে এখানে আপাত ভাবসাব দেখে মনে হয় শাসক ও বিরোধী দুই’ই তৃণমূল তবে কিনা এবার এমএলএ হয়েছেন পদ্মফুলের সুশান্ত ঘোষ। কিন্তু গ্রামবাসীরাই জানালেন যে, অনেক আশা নিয়ে আনা নতুন বিধায়ককেও বড় রাস্তা থেকে তেমন ভেতরে ঢুকতে দেখা যায়নি। কিছুটা দূরেই জগৎপুর পঞ্চায়েতের সংখ্যালঘু অধ্যুষিত বনহিজলী গ্রামের অধিকাংশ ভোট জোড়া ফুলে গেলেও থৈ থৈ জলছবিতে ভেদ নাই। বছর বছর কেমন বাঁধ বাঁধা হয়? তাতে আসলে ঠিক কার কী লাভ? বন্যা ঠেকাতে কত যে ‘মাস্টার প্ল্যান’ এর ঢাক বাজলো, অতঃপর সে’সব প্ল্যানের প্রতিমা বন্যার জলেই বিসর্জন। জমানা পাল্টে পাল্টে মাস্টারি চলে, ‘মাস্টার প্ল্যান’ আর পৃথিবীর আলো দেখেনা। মাড়োখানার শেষপ্রান্তে পানশিউলী বাজার — মুণ্ডেশ্বরী আর রূপনারায়ণ নদীর মিলনস্থলে। ওখানটায় কোনো নদীই ৭০-৮০ মিটারের বেশি চওড়া মনে হল না। মুণ্ডেশ্বরীর ওপারের ভূখণ্ড হাওড়ার আমতা আর রূপনারায়ণের ওপারটা পূর্ব মেদিনীপুরের দাসপুর পঞ্চায়েত। আরো খানিক চলে গেলে ঘাটাল। বছরের পর বছর ধরে একই চলছে। বর্ষা এলেই মানুষ আতঙ্কে দিন কাটান। বাঁকুড়া, বর্ধমান, হুগলী, হাওড়ার বিস্তৃত অঞ্চলের মানুষ যখন জলে ভাসেন, তখন কে কত স্কোর করবে তার প্রতিযোগিতা! মমতা ব্যানার্জি ও তার সরকার বলে চলেন ‘ম্যান মেড বন্যা’। কিন্তু তাদের তরফ থেকে জবাব মিলছে না যে, কেন পরপর তিন অর্থবর্ষে (২০১৮-১৯, ১৯-২০, ২০-২১) রাজ্য সেচ দপ্তরের বরাদ্দের মাত্র ২০ শতাংশ ব্যয় করা হয়েছে? এই অভিযোগ সত্য হলে অনুমান করা যায়, নদী, খাল সংস্কার কতটা হয়েছে! বন্যা কবলিত মানুষের বিকল্প আবাস, রাস্তাঘাটের কতটা কী হয়েছে! আর অন্যদিকে কেন্দ্রের সরকার বছরের পর বছর বলেই চলেছে, “আমরা আগাম জানিয়ে ডিভিসির জল ছেড়েছি”! ব্যাস, দায় শেষ? নদীর কেন ড্রেজিং হয় না, নতুন জলাধার তৈরি করে জল সংরক্ষণ হয়না, রেসকিউ সেন্টার কেন তৈরি হয় না? কোনও জবাব নেই।

বিভিন্ন মানুষের সহযোগিতাকে পাথেয় করে ৫ সেপ্টেম্বর মাড়োখানার দু’টি গ্রামে ১৪৫টি পরিবারকে কিছু খাদ্যদ্রব্য আর পানীয় জল পরিশোধক পৌঁছে দিয়ে আসা হয়।

burns in water

 

এরপর ৩ অক্টোবর সন্ধ্যায় আবার পাশের পঞ্চায়েতের এক বন্ধুর থেকে খবর পাই, হরিশচকে এমন একটা জায়গায় বাঁধ ভেঙেছে যেখান থেকে প্রায় ১০-১৫ হাজারের মতো মানুষ ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারেন। ডিভিসির ছাড়া জলের তোড়ে আচমকা এই কাণ্ড ঘটায় গ্রামবাসীরা অধিকাংশই একটা বিছানার চাদর তোলারও সময় পাননি। সাবলসিংহপুর, মাড়োখানা, হীরাপুর, রামচন্দ্রপুর, মাইনান সহ প্রায় ১৭টা গ্রাম পুরো ডুবে গিয়েছে যেখানে মেন রাস্তার উপর আবার ৭ ফুট পর্যন্ত জল উঠেছে। যে বন্ধুর থেকে খবর পাই তার বাড়ির একতলাটাও তখন জলের তলায়। এবারের মতো অবস্থা নাকি ১৯৭৮ সালের পরে আর হয়নি। পরেরদিন তার পাঠানো ভিডিয়োতে দেখলাম, জাস্ট তাসের ঘরের মতো ভেসে গেলো সাবলসিংহপুর পঞ্চায়েতের আজগুবিতলার একটা কাঠের ব্রিজ।

অবস্থা শোনা মাত্র পার্টির তরফে বন্যাদুর্গত মানুষদের দ্রুত পুনর্বাসন, বন্যারোধী নতুন আবাস, খাদ্য, পরিস্রুত পানীয় জল, ফসল ও গবাদি পশুর ক্ষতিপূরণ, স্বাস্থ্য পরিষেবার সম্প্রসারণের দাবি জানিয়ে এবং ফি বছর বন্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য সরকার কী পরিকল্পনা করছে তার জবাব চেয়ে জেলাশাসককে চিঠি পাঠানো হয়। ৬ অক্টোবর ঐ ব্লকেরই নতিবপুর ১নং পঞ্চায়েতের জয়রামপুর, শাহ পাড়া, বাবুজান পাড়া, সীতাপুর গ্রাম ও সংলগ্ন এলাকায় পরিস্থিতি দেখতে পৌঁছায় পার্টির হুগলী জেলা কমিটির নেতৃত্বে ছাত্র-যুবদের টিম। এই গ্রামগুলির অধিকাংশ মানুষ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। রাজ্যের শাসকদলের কর্মীদের একাংশ আমাদের চলার পথে নজরদারি শুরু করে সাথে সাথে, তাতে অবশ্য উল্টে তাদের প্রতিই মানুষের ব্যপক ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ আমাদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় আরেকবার চলে এল।

বাদল চাচার ভাঙা ঘরে বিদ্যুৎ ছিলো না সেদিন, তারমধ্যেই তাঁর বাড়িতে অন্তত একটা নারকেল নাড়ু খেতেই হবে — এই আদরের ওম পেতেই তো আমাদের বেরিয়ে পড়া সভ্যতার খোঁজে মাঠ-প্রান্তরে। ছোট ছেলের ঘরের দেওয়ালটা ধ্বসেছে জলের তোড়ে, সেদিন সকালে মেঝের হাঁটুজল গোড়ালিতে নামতেই চাচী শুরু করেছেন দেওয়ালের নড়ে যাওয়া বাখারিগুলোয় নতুন করে মাটি লেপন। এভাবেই বারবার পড়ে গিয়েও আবার উড়ান দেয় ইচ্ছেডানা-স্বপ্নগুলো জ্বলে। সম্মান, স্বাচ্ছন্দ্য ও অধিকারের সাথে বাঁচার ও বাঁচানোর স্বপ্নগুলো, ইচ্ছেগুলো বাস রাস্তা থেকে মাটির দাওয়া অবধি পৌঁছে দেওয়ার জন্য আলপথগুলো জেগে থাকা খুব দরকার, বারবার সেগুলো তলিয়ে গিয়ে আলপথকে জলপথ হতে দেওয়া চলে না। তাই ছাত্রদল মাটিতে থাকে কারণ স্বপ্নটা বিছানার থেকেও বেশি জরুরি জল-কাদায় দাঁড়িয়ে দেখা — হেই সামালো — লিবারেশন মানে মুক্তি। একুশের ডাক উপেক্ষা করা শুধু কঠিন নয়, অসম্ভব। লক্ষ্য থাকুক ডিজিটাল বৈষম্যের উল্টো ফুটে দাঁড়িয়ে আগামীতে সাধ্যমত মেঠো পাঠশালার বিকল্প নির্মাণে, ভরসা থাকুক অনেক কাঁধে। মানবিক ত্রাণ কাজে নিশ্চয়ই আমাদের সকলকে ঝাঁপাতেই হয়, কিন্তু সেটাই যেন একমাত্র কাজ না হয়ে পড়ে, কারণ তা দিয়ে কেবল সাময়িক সাহারা হয়। দিন বদলাতে হলে প্রশ্নোত্তর চলুক।

- সৌরভ 

খণ্ড-28
সংখ্যা-38