খবরা-খবর
বাংলাদেশ সীমান্তের কয়েক কোটি ভারতীয় জীবন কাটায় বিএসএফ-এর সন্ত্রাসের মাঝে
BSF terror

সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকার নির্দেশিকা জারি করে বিএসএফ-এর অধিক্ষেত্র তিনগুণের বেশি বাড়িয়ে দিয়েছে। অর্থাৎ প্রকৃত সীমান্ত থেকে ৫০ কিলোমিটার ভেতর পর্যন্ত এলাকা বিএসএফ-এর ক্ষমতার আওতায় আসবে। ক্ষমতা বলতে আইন অনুযায়ি তিনটি — তল্লাশি, বাজেয়াপ্তকরণ ও গ্রেপ্তারি। এতদিন প্রকৃত সীমান্তরেখা থেকে ১৫ কিলোমিটার ভেতর পর্যন্ত বিএসএফ-এর অধিক্ষেত্র ছিল এবং গ্রেপ্তারির অধিকার ছিল না। পশ্চিমবঙ্গে বরাবর তিনটি দেশের সাথে ভারতের সীমানা আছে। তার মধ্যে নেপাল ও ভুটানের সীমানায় এরকম বিএসএফ নেই, আছে কেবল বাংলাদেশ সীমানায়। বাংলাদেশের সাথে সুদীর্ঘ ২,২১৬ কিলোমিটার সীমান্ত আছে। সীমান্ত থেকে ৫০ কিলোমিটার ভেতরে বর্ধিত অধিক্ষেত্রের হিসেবে কুচবিহার, জলপাইগুড়ি, উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর, মালদা, মুর্শিদাবাদ, নদীয়া ও দুই চব্বিশ পরগণা — নয়টি জেলার প্রায় সমগ্র এলাকা বিএসএফ-এর আওতায় চলে যাবে। বিএসএফ-এর অধিক্ষেত্র বৃদ্ধি আসলে যুক্তরাষ্ট্রীয়তা ও আইনের শাসনের ওপর হামলা। এবিষয়ে দেশব্রতী ২৮ অক্টোবর ২০২১ সংখ্যায় প্রকাশিত লেখা দ্রষ্টব্য। কিন্তু এতদিন যে ১৫ কিলোমিটার ভেতর পর্যন্ত বিএসএফ-এর অধিক্ষেত্র প্রসারিত ছিল সেই এলাকার মানুষদের অভিজ্ঞতা কী? কীরকম ক্ষমতাধর বিএসএফ এই এলাকায়?

গত ৩০ অক্টোবর কলকাতায় ইউনিভার্সিটি ইন্সটিটিউট হলে এই বিষয়ক একটি সভা ও জনশুনানী সংগঠিত করে ‘বাংলার মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চ’ (মাসুম)। উপস্থিত ছিলেন কোচবিহার, মুর্শিদাবাদ, উত্তর দিনাজপুর, উত্তর ২৪ পরগণা, নদীয়া প্রভৃতি সীমান্ত এলাকায় বসবাসকারী এবং বিএসএফ-এর হাতে অত্যাচারিত ও এমনকি নিহত মানুষের পরিবার ও পরিজন। তাঁরা তাঁদের জীবনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। এই সভায় আহুত বক্তাদের মধ্যে ছিলেন সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের নেতা কার্তিক পাল। তাঁর কথায়, “সীমান্তবাসীদের জীবনের যে কাহিনী উঠে এল তা খুবই হৃদয় বিদারক। সীমান্তবাসীদের কেন্দ্রীয় সরকার ক্রমাগত ‘নিজভূমে পরবাসী’ করে তুলছে। ফসল উৎপাদন করা ও বাড়িতে বা বাজারে নিয়ে যাওয়ার ওপর বিভিন্ন অবৈধ বিধিনিষেধ আরোপ করে রাখে বিএসএফ। বাজার করতে যাওয়া ব্যক্তি কতটা কি নিতে পারেন তাও ঠিক করে দেয় বিএসএফ। একজন ২ কেজি লবণ নিয়ে যাচ্ছেন কিন্তু নির্দেশ অনুযায়ী ১ কেজি জলে ফেলে দিয়ে ১ কেজি বাড়িতে নিয়ে যেতে পারলেন। কেউ মাংস কিনে নিয়ে যাচ্ছেন, মেপে দেখা গেল ৬০০ গ্রাম। ৫০০ গ্রাম নিয়ে যেতে পারবেন। ফলে তাকে রেখে চলে যেতে হল। যখন তখন যে কোনও ব্যক্তিকে চোরাচালনকারি হিসাবে চিহ্নিত করে কেস দিতে বা ধরে নিতে পারে। মৎস্যজীবীরাও অত্যাচারিত। পদ্মায় মাছ ধরতে গেলে তাদের দিয়ে বিএসএফ প্রথমে ব্যক্তিগত কাজ করিয়ে নেয়, তারপর ২ ঘন্টা মাছ ধরতে অনুমতি দেয়। এইরকম অনেক কাহিনীর সাথে মেরে দেওয়া, মহিলাদের ওপর যৌন নির্যাতনের ঘটনাও রয়েছে অজস্র। সীমান্তে বসবাসটাই কঠিন হয়ে পড়েছে।”

উক্ত সভায় জারি করা বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “সীমান্তবাসীদের ওপর নিয়মিত অত্যাচার, নির্যাতন, হত্যা, শ্লীলতাহানি চলে … সীমান্তে অসংখ্য মানুষকে হত্যা করেছে বিএসএফ। এখন তারা গুম খুনের খেলায় পারদর্শী হয়ে উঠেছে। দেহ লোপাট করে দিচ্ছে … বিএসএফ-এর হুকুম না মানলেই নির্যাতন ও মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দেয় নিরিহ গ্রামবাসীকে। এছাড়া ফসল লুঠ তো আছেই। রাজ্য সরকারের স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না, কার্যত তাকে সমর্থন করছে। স্থানীয় থানা বিএসএফ-এর বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ নেয় না; নিলেও তদন্ত হয় না … আইনি কোনও বিধান না থাকা সত্ত্বেও রাজ্য প্রশাসনের জেলা শাসকরা বেআইনি ও অসাংবিধানিকভাবে একনাগারে দীর্ঘকাল ধরে সীমান্ত এলাকায় ফৌজদারি কার্যবিধির ১৪৪ ধারা লাগু করছে … বাংলাদেশ সীমান্তে বসবাসকারী কোটি কোটি মানুষের কাছে আজ আতঙ্ক হচ্ছে এনডিপিএস মামলা। স্থানীয় থানা ও বিএসএফ যে কোন মুহহূর্তে যে কোনও মানুষকে এনডিপিএস মামলা দিয়ে পাঠাবে। বাংলাদেশ সীমান্তে থাকা পুলিশ থানাগুলির দায়ের করা মিথ্যা অভিযোগে হাজার হাজার মানুষ আজ জেলের ভেতরে; বিএসএফ-কে সন্তুষ্ট করার জন্য এবং অসাধু উপায়ে অর্থোপার্জনের উদ্দেশ্যে পুলিশ এই অসাধু কাজ চালিয়ে যাচ্ছে … আন্তর্জাতিক চোরাচালান, নারী পাচার, মাদক পাচার — এই সকল দুষ্কর্মই কিছু অসাধু বিএসএফ-এর সহযোগিতায় এবং স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের ছত্রছায়ায় ও শুল্ক আধিকারিকদের সাহায্যে ফুলে ফেঁপে উঠেছে।” মাসুমের পক্ষ থেকে প্রশ্ন তোলা হয়েছে যে সবকিছু জানার পরেও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ও রাজ্যের প্রশাসন কি ঘুমিয়েই থাকবে?

border of bangladesh

 

‘মাসুম’ সংস্থাটি দীর্ঘদিন সীমান্তে বিএসএফ-এর সন্ত্রাস ও মানবাধিকার প্রশ্নে তথ্যানুসন্ধানের কাজ করছে। ‘হিউম্যান রাইটস্ ওয়াচ’ নামক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন কর্তৃক এ’বছর ফেব্রুয়ারি মাসে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে দেখা যাচ্ছে যে ‘মাসুম’ ২০১১ সাল থেকে বাংলাদেশ সীমান্তে বিএসএফ দ্বারা ভারতবাসীকে হত্যা করার ১০৫টি ঘটনার তথ্যানুসন্ধান করেছে, যদিও এরকম হত্যার প্রকৃত সংখ্যাটা আরও অনেক বেশি বলে জানিয়েছেন তাঁরা। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের কাছে তাঁদের জমা দেওয়া ঘটনাগুলির মধ্যে সাম্প্রতিক দুটি ঘটনা হল, ২০২০ সালে কুচবিহার জেলায় ১৬ বছর বয়সী সামশের প্রামানিককে প্রথমে বাঁশ দিয়ে পিটিয়ে ও তারপর গুলি করে হত্যা করা হয় এবং ২৩ বছর বয়সী সাহিনুর হককে তার বাড়ির সামনেই গুলি করে হত্যা করে বিএসএফ। পুলিশ কেবলমাত্র ‘অস্বাভাবিক মৃত্যু’র কেস দেয়।

কমরেড কৃষ্ণ প্রামাণিক তিন দশক আগের একটি ঘটনার কথা জানিয়েছেন, “১৯৯১ সালের ১৭ মার্চ নদীয়ার তেহট্ট ব্লকের দেবনাথপুরে ১১ জন কৃষককে বিএসএফ গুলি করে হত্যা করেছিল। বর্ডার সংলগ্ন এই গ্রাম থেকে গরু চুরি করে নিয়ে যাচ্ছিল দুষ্কৃতিরা। বিএসএফ-এর সাথে দুষ্কৃতীদের সংযোগ ছিল। তাই কৃষকের পক্ষ থেকে দুষ্কৃতি ধরার জন্য চাপ দিলে বিএসএফ উল্টে কৃষকদের মারে। কৃষকরা বিএসএফ-কে ঘিরে ধরে একটা ঘরে আবদ্ধ করে রাখে। সংশ্লিষ্ট ব্লক উন্নয়ন আধিকারিককে জানানোর পরে বিএসএফ-এর নিরাপত্তার জন্য একজন পুলিশকে পাহারায় বসানো হয়। বিএসএফ ব্যাটেলিয়ান খবর পাওয়ার পরে দলবেঁধে এসে থানার পুলিশকে লাথি মেরে ফেলে দেয়, তারপরে আটক বিএসএফ-কে উদ্ধার করে। এরপরই বিএসএফ বাহিনী বাজারের দোকানে বসে থাকা লোকজনকে এলোপাথারি গুলি চালায়। মোট ১১ জনকে হত্যা করে ও ৬ জনকে আহত করে রাগ মেটে তাদের। ঘটনাটি আলোড়ন তৈরি করেছিল। বিক্ষোভ আন্দোলন হয়েছিল। হত্যাকারী বিএসএফ-এর শাস্তির দাবি উঠেছিল। জেলা পুলিশ সুপার ও বিএসএফ যৌথ মিটিং করে জনগণের প্রস্তাব মেনে নিয়েছিল। কিন্তু ওই পর্যন্তই। বাস্তবে কিছুই হয়নি। কোনও শাস্তি হয়নি। এই ঘটনা দেখিয়ে দেয় যে বিএসএফ গণহত্যা করেও রেহাই পেয়ে যায়, জনগণের নিরাপত্তার পরিবর্তে নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করে।”

সীমান্ত সুরক্ষার নামে ভারতের নাগরিকদের ওপর এই সন্ত্রাস কায়েম করে রেখেছে বিএসএফ। বলাই বাহুল্য, সীমান্ত লাগোয়া গ্রামগুলিতে বসবাসকারী মানুষের সিংহভাগই প্রান্তিক, তপশিলি জাতিভুক্ত অথবা মুসলমান, এবং দরিদ্র খেটে খাওয়া মানুষ। সীমান্তের ১৫ কিলোমিটার বরাবর এলাকায় এই সন্ত্রাস সীমাবদ্ধ ছিল বলেই কি এতদিন ওপেন সিক্রেটের নীরবতা ছিল? এখন ৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তারিত হলে বহু জেলা বা ব্লক শহর, গঞ্জ, জাতীয় সড়ক বিএসএফ-এর এরকম রাজত্বের আওতায় চলে আসবে। অত্যাচারের তীব্রতা এক না হলেও সন্ত্রস্ত করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারবে অনেক গভীর পর্যন্ত।

কার্তিক পাল জানিয়েছেন, “নতুন অর্ডার জারি হওয়ার কয়েকদিনের মধ্যেই বিজেপির বর্তমান রাজ্য সভাপতির সাথে বিএসএফ আধিকারিকের গোপন বৈঠক কেন হল, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠে গেছে। বিএসএফ-এর মাধ্যমে বিজেপি এবং কেন্দ্রের সরকার বাংলায় প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ ও রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তার করতে তৎপর। কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ বাড়ছে। রাজ্য সরকার এই আদেশের বিরোধিতা করেছে। কিন্তু বিডিও অফিস ও পঞ্চায়েতগুলির ভূমিকা ভালো নয়। এই প্রশ্নে আমাদের মনোযোগ বাড়ানো দরকার। বিশেষ করে সংশ্লিষ্ট জেলাগুলির নজরদারি দরকার। জেলায় জেলায় স্থানীয়ভাবে এইসব বিষয় নিয়ে বিক্ষোভ সংগঠিত করা প্রয়োজন।”

খণ্ড-28
সংখ্যা-38