প্রতিবেদন
পেগাসাস কাণ্ডে তদন্ত : ফোনে নজরদারির মূল চক্রীদের চিহ্নিত করে শাস্তি দিতে হবে
Pegasus Case

এবছরের জুলাই মাসে প্যেগাসাস স্পাইওয়্যার দিয়ে নাগরিকদের ফোনে আড়িপাতার বিষয়টা প্রকাশ পাওয়ার পর থেকে মোদী সরকার যা বলে এসেছে, সুপ্রিম কোর্টের কাছে নিজের যে অবস্থান রেখেছে তা ক্রমশ এই আশঙ্কাকেই তীব্র করছিল যে সরকার কিছু লুকোনোর চেষ্টা করছে। গত ২৭ অক্টোবর প্যেগাসাস নজরদারি কাণ্ডে তদন্ত কমিটি গঠনের সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্ত সেই সন্দেহ পোষণেই শুধু সায় দিল না। গোপনীয়তার ঐ অভিপ্রায়ের পিছনে কোনো অবৈধ প্রয়াস থাকলে তার উন্মোচনের উপায়ও হয়ে উঠল তদন্তের ঐ সিদ্ধান্ত। নাগরিকদের ফোনে এই নজরদারি, তাদের কথপোকথনে আড়িপাতার পিছনে কোনো বেআইনি কাজ হয়নি বলেই সরকার বলে আসছিল। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের কাছে দেওয়া দু’পাতার হলফনামায় সরকার সুস্পষ্টভাবে বলল না যে, নাগরিকদের ফোনে নজরদারিতে তাদের সক্রিয় ভূমিকা ছিল কিনা। এরআগে ১৩ সেপ্টেম্বর এই বিষয়ে শুনানির সময় প্রধান বিচারপতি এন ভি রমনা সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতার জবানিতে অসন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে ধানাইপানাই না করে পরিষ্কার করে বলতে বলেন — নাগরিকদের ফোনে নজরদারিতে সরকার প্যেগাসাসকে কাজে লাগিয়েছিল কিনা। সলিসিটর জেনারেল মোদী সরকারের বহু ব্যবহৃত যুক্তির আশ্রয় নিয়ে বলেন — বিষয়টার সঙ্গে দেশের নিরাপত্তা জড়িত, আর তাই কেন্দ্রীয় সরকার এই বিষয়ে বিষদে জানিয়ে কোনো হলফনামা জমা দিতে চায় না। প্রত্যুত্তরে প্রধান বিচারপতি সলিসিটর জেনারেলকে জানিয়ে দেন, “আমরা জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে জড়িত বিষয় জানতে চাইছি না। আমাদের একমাত্র দেখার বিষয় হল, কোনো সরকারি সংস্থা আইনের বাইরে গিয়ে দেশের নাগরিকদের উপর নজরদারি করতে কোনো সফটওয়্যার কাজে লাগাচ্ছে কিনা।” সে দিনের শুনানির দেড়মাস পর তদন্ত কমিটি গঠনের সিদ্ধান্তের কথা জানাতে গিয়েও প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ বলেছে (বেঞ্চের আর দুই বিচারপতি হলেন সূর্য কান্ত ও হিমা কোহলি), “জাতীয় নিরাপত্তা এমন কোনো জুজু নয় যে তার উল্লেখ করলেই বিচারবিভাগ নিরস্ত হয়ে যাবে। …” “রাষ্ট্র জাতীয় নিরাপত্তার প্রসঙ্গ উত্থাপন করলেই তা আদালতকে নীরব দর্শকে পরিণত করতে পারে না।” আর তাই দেশের নিরাপত্তার বিষয়টাকে উপেক্ষা না করেও সুপ্রিম কোর্ট দেশের নাগরিকদের অধিকারের সুরক্ষায় প্রয়াসী হয়ে প্যেগাসাস কাণ্ডের সত্য উন্মোচনে তদন্ত কমিটি গঠনে মনস্থ করে। এই কমিটির সদস্য সংখ্যা হল তিন — নেতৃত্বে থাকবেন সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি আর ভি রবীন্দ্রন, আর সহায়তা করবেন অবসরপ্রাপ্ত আইপিএস অলোক যোশী এবং সাইবার বিশেষজ্ঞ সন্দীপ ওবেরয়। এই কমিটি প্রযুক্তিগত বিশেষজ্ঞদের সাহায্য নেবে এবং দু’মাসের মধ্যে রিপোর্ট জমা দেবে। প্রসঙ্গত, নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের নিয়ে তদন্ত কমিটি গড়ার প্রস্তাব সরকার দিয়েছিল। কিন্তু তাতে সত্য উদঘাটনের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবেনা মনে করে সুপ্রিম কোর্ট সেই প্রস্তাবে অনাস্থা জ্ঞাপন করে তাকে প্রত্যাখ্যান করে।

আদালত ব্যক্তির নিজস্ব পরিসরের গোপনীয়তার অধিকারকে মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি দিয়েছে। এই অধিকারের সুরক্ষায় আদালত অঙ্গীকারবদ্ধ। রাষ্ট্র কি ব্যক্তির নিজস্ব পরিসরে হানা দিতে, সেইক্ষেত্রে নজরদারি চালাতে পারে? বিশেষ জরুরি অবস্থা দেখা দিলে কেন্দ্র ও রাজ্য উভয় সরকারই ১৮৮৫ সালের ‘ইণ্ডিয়ান টেলিগ্ৰাফ আইন’ এবং ২০০০ সালের তথ্যপ্রযুক্তি (সংশোধনী) আইন-এর বলে বাছাই করা ব্যক্তিদের মোবাইলে, ইমেল অ্যাকাউন্টে, হোয়াটসঅ্যাপ বার্তায় নজরদারি চালাতে পারে। কিন্তু সেরকম কোনো পরিস্থিতির উদ্ভব কি ভারতে হয়েছিল? ব্যক্তিগত পরিসরকে, ব্যক্তিদের একেবারে নিজস্ব গোপন মুহূর্তকে, বার্তার আদানপ্রদানকে ঠাওর করাটা কি বৈধ পথেই হয়েছিল? আর তা যদি না হয়ে থাকে তবে এই মৌলিক অধিকারের লঙ্ঘন আদালতের চোখে অপরাধ বলেই বিবেচিত হবে। তদন্তের সিদ্ধান্তের পিছনে এটাও আদালতের কাছে একটা কারণ হয়ে থেকেছে।

সরকার তার ওপর নজরদারি চালাচ্ছে, একথা কেউ জানতে পারলে তার সিড়দাঁড়া দিয়ে আতঙ্কের হিমশীতল স্রোত নেমে আসাটাই স্বাভাবিক। সাংবাদিকদের ক্ষেত্রে এমনটা হলে তা অবশ্যই সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতার বিপর্যয়ের সুনিশ্চিত শর্ত হয়ে ওঠে। বেশ কিছু সাংবাদিকের ফোন আড়িপাতার শিকার হওয়ায় এবং শীর্ষ আদালতের কাছে আবেদনকারীদের মধ্যে সাংবাদিকরা থাকায় সংবাদপত্রের স্বাধীনতার সুরক্ষাও আদালতের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়েছে। আদালতের রায়ে সাংবাদিকদের ওপর এই নজরদারি “সংবাদপত্রের জনগণের প্রহরী হওয়ার ভূমিকার ওপর আক্রমণ, যা সঠিক এবং বিশ্বাসযোগ্য তথ্য পরিবেশনের সংবাদপত্রের সামর্থের ক্ষয় ঘটাতে পারে।” সাংবাদিকদের কাছে, বিশেষত তদন্তমূলক সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে, খবর ও তথ্যের উৎস হয়ে ওঠে বেশ কিছু গোপন সূত্র। সরকারের বিষ নজরে থাকা সাংবাদিকদের উপর চাপ সৃষ্টি করে সরকার যদি সাংবাদিককে খবর ও তথ্য জোগানো ব্যক্তির সন্ধান পেতে চায় তবে তা সেই সূত্রের সঙ্গে ন্যায়নিষ্ঠ সাংবাদিকতাও বিপন্ন হয়ে পড়ে। সংবাদপত্রের স্বাধীনতার সঙ্গে এই সূত্রদের সুরক্ষার ভাবনাও আদালতের তদন্তের সিদ্ধান্ত গ্ৰহণে প্রভাব ফেলেছে।

যে প্যেগাসাস স্পাইওয়্যার দিয়ে ফোনে নজরদারি চালানো হয়েছে সেটির প্রস্তুতকারক ইজরায়েলি সংস্থা এনএসও। এবং তারা জানিয়েছে, কোনো সরকার বা পুরোদস্তুর সরকারি সংস্থা ছাড়া অন্য কাউকে তারা প্যেগাসাস বিক্রি করেনা। ঘটনা এই হওয়ায় ভারতীয় নাগরিকদের ফোনে নজরদারিতে কোনও বিদেশী সংস্থাও কি জড়িত? তা যদি হয়ে থাকে তবে ভারতীয় নাগরিকদের তথ্য কি বিদেশী সংস্থার হস্তগত হয়েছে? এই নজরদারির ফলে বিদেশী সংস্থার হাতে দেশের স্বার্থ ও নিরাপত্তা বিপন্ন হয়ে পড়ার সম্ভাবনাও শীর্ষ আদালতের তদন্তের সিদ্ধান্তের পিছনে অন্যতম কারণ হয়েছে।

ফোনে আড়িপাতার শিকার যারা হয়েছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী, নাগরিক আন্দোলনের কর্মী, আইনজীবী, বিরোধীপক্ষের নেতা, সুপ্রিম কোর্টের জনৈক বর্তমান বিচারপতি, এক নির্বাচন কমিশনার, প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ-এর বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার অভিযোগ আনা সুপ্রিম কোর্টের মহিলা কর্মী ও তার পরিবারের দশ সদস্য এবং অন্যান্যরা। এদের সংখ্যাটা এক হাজারেরও বেশি হওয়ায়, যাদের নাম পাওয়া গেছে সেই সংখ্যাটাও বড় এবং স্থানাভাবে তাদের উল্লেখ এখানে সম্ভব নয়। তবে, স্পাইওয়্যার দিয়ে ফোনে ঢুকে তথ্য হাতিয়ে (এবং ফোনে এমনকি অনিষ্টকর তথ্য চালান করেও, যেমন ভীমা কোরেগাঁও-এর ঘটনায় অভিযুক্তদের ফোনে অনুপ্রবিষ্ট করা হয়েছে বলে অভিযোগ) তাদের ব্ল্যাকমেইল করা, হুমকি দেওয়া, মামলায় জড়ানোর দুরভিসন্ধিকে একেবারে খারিজ করা যায়না। তবে, ফোনে হানাদারির জন্য যাদের বাছা হয়েছে সেই ব্যক্তিদের কথা বিচার করলে নজরদারির অভিপ্রায়ের বড় অংশই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যকে নির্দেশিত করে।

প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ জানিয়েছে, “কমিটি গঠন করাটা ছিল একটা দুরূহ কাজ”। কেননা, নিরপেক্ষ, দক্ষ ও যোগ্য ব্যক্তিদের খুঁজে পাওয়াটা সমস্যা হয়ে দেখা দিচ্ছিল। প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা গেছে, তদন্ত কমিটির সদস্য হতে যাদের অনুরোধ করা হয়েছিল তাদের অনেকেই সবিনয়ে সেই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন। গত ১৩ সেপ্টেম্বরের শুনানির সময় প্রধান বিচারপতি জানিয়েছিলেন, দিন কয়েকের মধ্যেই কিছু নির্দেশ জারি করা হবে। কিন্তু কমিটি গঠনের সিদ্ধান্তের কথা জানাতে যে প্রায় দেড় মাস সময় লেগে গেল তা কাজটার সমস্যাসংকুলতাকেই জানান দিল। এই ধরনের কমিটি গঠনের বিরুদ্ধে সরকারের চাপ থাকাটা অভাবিত নয়, এবং তদন্ত কমিটির সদস্য হতে যাঁরা চাননি, সরকারের রোষ এড়ানোর অভিপ্রায়ই বোধকরি তাদের ক্ষেত্রে নির্ধারক শর্ত হয়েছে। যে প্রশ্নটা এখন সাধারণ জনগণের মনে উঁকি দিচ্ছে তা হল — তদন্ত কমিটিকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া হবে তো? সরকারের কাছে তথ্য সংগ্ৰহের প্রয়োজনীয়তায় মোদী সরকার সহযোগিতা করবে তো?

প্যেগাসাস কাণ্ডে সুপ্রিম কোর্টের তদন্তের সিদ্ধান্তে সাধারণ জনগণ উৎসাহিত। মোদী জমানায় সিবিআই, ইডি, আইটি, এনআইএ’র মত সাংবিধানিক ও প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের স্বায়ত্ততা ও নিরপেক্ষতা হারিয়ে সরকারের আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠানে, বিরোধীদের বিপর্যস্ত করার সংস্থাতেই পর্যবসিত হয়েছে যা গণতন্ত্রের বিপন্নতারই নির্দেশক। এমনকি বর্তমান প্রধান বিচারপতির আগের সময়ে সুপ্রিম কোর্টের কয়েকজন প্রধান বিচারপতি মোদী সরকার ও বিজেপির সুবিধায় নিজেদের নিয়োজিত করেছিলেন বলেও অভিযোগ ওঠে। এই প্রেক্ষাপটে মোদী সরকারের অসহযোগিতা ও ‘জাতীয় নিরাপত্তার’ জুজুকে উপেক্ষা করে প্যেগাসাস কাণ্ডে তদন্তের নির্দেশ ন্যায়ালয়ের ন্যায়সঙ্গত ও বলিষ্ঠ পদক্ষেপ হয়েই দেখা দিচ্ছে। শীর্ষ আদালতের কাছে সাধারণ জনগণের প্রত্যাশ্যা — ব্যাপক সংখ্যক ভারতীয় নাগরিকের ফোনে নজরদারির জন্য যারা দায়ী তাদের খুঁজে বার করে শাস্তি দিতে হবে। ভারতীয় গণতন্ত্রের পথভ্রষ্টতায় তদন্তের এই পদক্ষেপ ইতিবাচক ব্যঞ্জনায় মূর্ত বলেই দেখা যাচ্ছে। শীর্ষ আদালতের গঠন করা কমিটি তাদের অভীষ্ট পূরণে সফল হবে, সেই আশা নিয়ে আমরা সাগ্রহে তাকিয়ে থাকব।

খণ্ড-28
সংখ্যা-38