ভ্যাক্সিন নিয়ে মোদীর এত বগল বাজানোর পেছনে বাস্তব সত্যটা কী?
Reality Check On Vaccine

পিএম নরেন্দ্র মোদী এক ভাষণে এবং একটি প্রতি-সম্পাদকীয় পাতায় দাবি করেছেন যে তাঁর নেতৃত্বে ভারত টীকাকরণে ‘ঐতিহাসিক’ ও চমকপ্রদ বিজয় অর্জন করেছে, ২০২১-র ২১ অক্টোবর কোভিড১৯-র ১০০ কোটি ডোজ প্রদান সম্পন্ন হয়েছে।

ভ্যাক্সিন নিয়ে এই আত্মগরিমা প্রচারের সাথে সাথে চেষ্টা করা হচ্ছে মোদীকে ‘ভ্যাক্সিন ম্যান’ হিসেবে তুলে ধরার। কোভিডের প্রথম ঢেউয়ে লকডাউনে ও দ্বিতীয় ঢেউয়ের সংকটে ভারতে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন গেছে। এই অপরাধসম অপদার্থতার মূল নায়ক হিসেবে নরেন্দ্র মোদী দেশ বিদেশে পরিচয় লাভ করে। এখন সেই ইমেজ মেরামত করতে তাঁকে ‘ভ্যাক্সিন ম্যান’ বানিয়ে প্রচার চালানো হচ্ছে। গঙ্গায় বয়ে চলা লাশের পর লাশ আর অক্সিজেনের অভাবে খাবি খেতে খেতে মরে যাওয়ার ভয়ঙ্কর দৃশ্যগুলি যে জনস্মৃতিকে আজও তাড়িয়ে ফেরে তা বিলক্ষণ জানেন নরেন্দ্র মোদী। কেন্দ্রের ও উত্তরপ্রদেশের বিজেপি সরকারকে চরম ধিক্কার জানিয়ে ২০২১ সালের ৫ মে এলাহাবাদ হাইকোর্ট বলেছে, “হাসপাতালগুলিতে শুধুমাত্র অক্সিজেন সরবরাহ না করার ফলে কোভিড রোগীদের এই মৃত্যু অপরাধমূলক কাজ, গণহত্যার থেকে কম কিছু নয়”। এখন উত্তর প্রদেশে নির্বাচন আসন্ন। মোদী সরকার তার অপরাধের ফলশ্রুতির দুঃসহ স্মৃতি চাপা দিতে এখন টীকাকরণের ক্ষেত্রে এই ঐতিহাসিক সাফল্যের মনগড়া রিংটোন বাজিয়ে চলেছে।

কিন্তু খতিয়ে দেখলে বোঝা যায় যে মোদীর এই বগল বাজানোর পেছনে কোনও বাস্তব সাফল্য নাই। মোদী সরকার ঘোষণা করেছিল তিনমাসের মধ্যে ১০০ কোটি ডোজ সম্পন্ন করার। তার বদলে লাগিয়েছে নয়মাস। ঘোষণা করেছিল ২০২১-র মধ্যে সমস্ত প্রাপ্তবয়স্কদের টীকাকরণ সম্পন্ন হয়ে যাবে — এই লক্ষ্য ভারতে এখনও সুদূরপরাহতই হয়ে আছে।

ভারতে ১৮ বছর ও তার বেশি বয়সিরা কোভিড১৯ ভ্যাক্সিন পাওয়ার যোগ্য ধার্য হয়েছে। অন্য প্রায় সমস্ত দেশই কিন্তু ১২ বছর ও তার বেশি বয়স্কদের ভ্যাক্সিন দিয়েছে। সুতরাং ভারতে জনসংখ্যার মোট যত শতাংশকে টীকার যোগ্য ধরা হয়েছে তা অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক কম। টীকাযোগ্য এই জনসংখ্যার মধ্যেও মাত্র ৩১ শতাংশ মানুষের পূর্ণ টীকাকরণ হয়েছে, এবং একটা ডোজ অন্তত পেয়েছে এরকম অংশ মাত্র ৭৫ শতাংশ।

অন্যান্য দেশের তুলনায় ভারতের এই করুণ পারফরম্যান্সকে জনসংখ্যার আধিক্যের দোহাই দিয়ে বৈধতা দিতে চাওয়া হয়। কিন্তু এই অজুহাত ধোপে টেঁকে না। ভারতের থেকে অনেক বেশি জনসংখ্যার দেশ হয়েও চীন তাদের ৭১ শতাংশ জনতার সম্পূর্ণ টীকাকরণ সম্পন্ন করেছে।

ভারত ভ্যাক্সিনের অর্ডার দিতেই অপেক্ষা করেছে জানুয়ারি মাস পর্যন্ত। টীকাকরণের কাজ শুরু হওয়ার মাত্র পাঁচ দিন আগে অর্ডার দিয়েছে। অন্যান্য দেশগুলি যেমন অনেক আগে থেকেই ভ্যাক্সিনের অর্ডার দিয়ে রেখেছিল, ভারত তা করেনি। আর, যে পরিমাণ ভ্যাক্সিন আনা হয় তাতে মাত্র ২০ শতাংশ জনসংখ্যাকে একটি মাত্র ডোজ দেওয়া যাবে। ভ্যাক্সিন সংগ্রহে এই বিলম্ব তীব্র ভ্যাক্সিন সংকটের জন্ম দেয় এবং কোভিড১৯-র দ্বিতীয় ঢেউয়ের ভয়ঙ্কর ধাক্কার সামনে ভারতের জনতাকে অসহায় ও বিপর্যস্ত করে তোলে।

মোদী দাবি করছেন, সব ভারতবাসী বিনি পয়সায় টীকা পেয়েছে। মিথ্যা দাবি। বাস্তবে প্রায় সব দেশেই কোভিড১৯ ভ্যাক্সিন একদম ফ্রি। কিন্তু ভারত সেইসব গুটিকয় দেশের মধ্যে অন্যতম যেসব দেশের মানুষকে টাকা খরচ করে ভ্যাক্সিন নিতে হয়েছে। ভ্যাক্সিন দালালদের সাথে নিজেদের মত চুক্তি করে নেওয়ার দায় পিএম মোদী রাজ্যগুলির ঘাড়েই চাপিয়ে দেয়। এরফলে ভ্যাক্সিনের দামে চরম নৈরাজ্য চলতে থাকে, যতক্ষণ পর্যন্ত না সুপ্রিম কোর্ট হস্তক্ষেপ করে এবং সরকারকে বাধ্য করে ভ্যাক্সিনের কোনও না কোনও মূল্যসীমা বেঁধে দিতে।

মোদী যে দাবি করছেন ‘টীকাকরণে কোনও ভিআইপি কালচার নাই’, সেটাও মিথ্যা। প্রত্যেক মাসে যে পরিমাণ ভ্যাক্সিন আহরণ করা হয়েছে তার ২৫ শতাংশ পাওয়ার অধিকার সরকার দিয়ে দিয়েছে প্রাইভেট হাসপাতালগুলিকে, এবং তুলনামূলক সুবিধাভোগীরা সেসব কিনে নিতে পেরেছে আর গরিব মানুষকে দিনের পর দিন লাইন দিতে হয়েছে সরকারি কেন্দ্রগুলিতে।

ভ্যাক্সিন আহরণে অনেক দেরি করায় তীব্র ভ্যাক্সিন ঘাটতি; এপ্রিল ২০২১-এ কুম্ভ মেলায় বিপুল জমায়েতকে উৎসাহ দেওয়া; হিন্দু উপাসকদের কোভিড১৯ হবে না বলে বার্তা প্রচার; কুম্ভে করোনা টেস্টের ডেটা জাল করে মিথ্যা নিরাপত্তাবোধ তৈরি করা; আর, হাসপাতালে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন সরবরাহ করতে ব্যর্থ হওয়া — সব মিলিয়ে দ্বিতীয় ঢেউয়ের আকার, মাত্রা ও ভয়াবহতাকে বহুগুণ বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য পিএম মোদী ও বিজেপির অন্যান্য নেতারাই ব্যক্তিগতভাবে দায়ি। তখন থেকেই পিএম মোদী দ্বিতীয় করোনা ঢেউয়ের মৃত্যুর পরিসংখ্যান চাপা দিতে মরিয়া। উনি মাত্র ৪ লক্ষ মৃত্যু স্বীকার করেছেন, যদিও বাস্তবে মৃত্যুর সংখ্যা ৪০ লক্ষের কাছাকাছি। এমনকি আজও কোভিড১৯’এ এতিম হওয়া অনেক বাচ্চা ও অনেক সাথীহারা নারী বা পুরুষ বাঁচার জন্য লড়ে যাচ্ছেন, সরকার থেকে কোনও সহযোগিতা পাওয়া তো দূরের কথা স্বীকারই করা হচ্ছে না। প্রথম ঢেউয়ের সময় প্রধানমন্ত্রীর নিষ্ঠুর ও অপরিকল্পিত লকডাউন অগুন্তি পরিযায়ি শ্রমিকের জীবন কেড়ে নিয়েছিল এবং ভারতকে গভীরতর কর্মহীনতায় নিমজ্জিত করেছিলো। এখন পিএম মোদী তাঁর গোদি মিডিয়াকে কাজে লাগিয়ে নিজের অপরাধসম করোনা-ব্যর্থতাকে বদলে দিতে চাইছেন ভ্যাক্সিন-সাফল্যের মনগড়া কাহিনীতে।

বিশ্বের পণ্ডিতদের এক সভা থেকে একটি ‘দুর্বৃত্ত গ্যালারি’ প্রস্তুত করা হয়েছে বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে যাদের ভুল নির্দেশনা ও নীতির ফলে কোভিড১৯’এ বিপুল সংখ্যক প্রাণ ঝরে গেছে, অন্যথায় এইসব প্রাণহানি এড়ানো যেত। এই দুর্বৃত্ত তালিকায় নরেন্দ্র মোদীর নাম এক নম্বরে আছে। তালিকায় আছে ব্রাজিলের জাইর বলসনারো, বেলারুশের আলেক্সন্ডার লুকাশেঙ্কো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং মেক্সিকোর আন্দ্রেই ম্যানুয়েল লোপেজ ওব্রাডর। জীবনহানি ঘটানোর অপরাধে এইরকম নেতাদের কাঠগড়ায় তোলা দরকার।

একথা স্মরণ করার মতো যে ব্রাজিলে সংসদীয় প্যানেল ১,২০০ পাতার একটি রিপোর্ট পেশ করে সুপারিশ করেছে যে জাইর বলসনারোর ওপর ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’এর চার্জ আনা হোক। কারণ কোভিড১৯ সংক্রান্ত নীতির ক্ষেত্রে তাঁর অপদার্থতা ৬ লক্ষ ব্রাজিলিয়র জীবন কেড়ে নিয়েছে। এই রিপোর্টে ব্রাজিলে ভারত বায়োটেকের প্রাক্তন বিজনেস পার্টনার প্রেচিসা মেডিকামেন্টসকেও অভিযুক্ত করা হয়েছে প্রতারণা ও জালিয়াতির সাথে সাথে ‘সংগঠিত অপরাধ চালানো’র অভিযোগে। ভারতেও কেন্দ্রীয় সরকার ও সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারগুলিকে কোভিড১৯ ও লকডাউন বিপর্যয়ের জন্য কাঠগড়ায় তোলা দরকার যারা বাস্তবতই ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধী’।

(এমএল আপডেট সম্পাদকীয়, ২৬ অক্টোবর ২০২১)

খণ্ড-28
সংখ্যা-38