ভারতের ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলন প্রথম বর্ষ পূর্তির পথে
 Historic Farmers’ Movement

আগামী ২৬ নভেম্বর ২০২১ ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনের একবছর পূর্ণ হতে চলেছে। প্রায় বর্ষব্যাপী অস্তিত্বের মধ্য দিয়ে এই আন্দোলন দেখিয়ে দিয়েছে, চূড়ান্ত প্রতিকূল পরিস্থিতিতে জনগণের ক্ষমতায় কী বিস্ময়কর শক্তি নিহিত থাকতে পারে! শত শত কৃষক সংগঠন, তারা জনগণের সামাজিক এবং মতাদর্শগত ক্ষেত্রের এক সুবিস্তৃত অংশের প্রতিনিধিত্ব করছে। কিন্তু তারা একসাথে জুড়ে আছেন কী অভূতপূর্ব ঐক্য, অদম্য উৎসাহ উদ্দীপনা আর যৌথ শৃঙ্খলার প্রতীক হয়ে — লাগাতার প্ররোচনা, হুমকি ও ষড়যন্ত্রমূলক অপপ্রচার আর পরিকল্পিত হিংস্র আক্রমণের মুখে দাঁড়িয়েও!

গত আগস্ট মাসের শেষে দিল্লী সীমানায় অনুষ্ঠিত সারা ভারত জনতার সম্মেলন শুধু লড়াকু কৃষকদের ঐক্যই নয়, কৃষক আন্দোলনের প্রতি বিভিন্ন শ্রেণী ও অংশের মানুষের ক্রমবর্ধমান জনসমর্থনকেও তুলে ধরেছে। গত ৫ আগস্ট মুজাফ্ফরনগর মহাপঞ্চায়েত দেখিয়ে দিয়েছে ২০১৩’র ভয়ঙ্কর সাম্প্রদায়িক হিংসার এই উৎপত্তিস্থল কীভাবে কৃষকদের প্রতিরোধ এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক দুর্ভেদ্য দুর্গ হয়ে উঠছে। ২৭ সেপ্টেম্বরের ভারত বনধ্ও দেখিয়েছে কৃষকদের প্রতি দেশব্যাপী সমর্থন এবং মোদী সরকারের বিরুদ্ধে গোটা দেশের জনরোষ ক্রমশ কীভাবে একই অভিমুখে ধাবিত হয়ে একই বিন্দুতে মিলিত হতে চলেছে। সর্বনাশা কৃষি আইন, শ্রম কোড এবং বেসরকারিকরণ ছাড়াও মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব এবং দেশের সম্পত্তি বেচে দেওয়া হয়ে উঠেছে এখন প্রধান উদ্বেগের বিষয়।

ঠিক এই পটভূমিতেই লখিমপুর গণহত্যা ঘটেছে। আগেই মোদীর মন্ত্রী বনে যাওয়া অতীতের এক কুখ্যাত দুর্বৃত্ত অজয় মিশ্র কৃষকদের এমন এক উচিত শিক্ষা দেওয়ার হুমকি দিয়েছিল যাতে তারা নাকি লখিমপুর ছেড়ে পালাতে পথ পাবে না। এই গণহত্যা আসলে সেই হুমকির এক নৃশংস, ঠাণ্ডা-মাথার রূপায়ণ। এর বিরুদ্ধে লখিমপুর এবং সারা দেশের কৃষকদের সংযত ও দ্রুত, সাহসী ও সংকল্পবদ্ধ প্রতিবাদ যোগী সরকারকে পিছু হটতে বাধ্য করেছে। সরকারকে কৃষকদের সঙ্গে এক বোঝাপড়ায় বাধ্য করে তবেই তারা শহীদ সাথীদের অন্তিম বিদায় জানিয়েছেন। অজয় মিশ্র, তার ছেলে আশিস মিশ্র এবং অন্যান্যদের বিরুদ্ধে সরকারকে এফআইআর দায়ের করতে হয়েছে এবং আশিস মিশ্রকে গ্রেফতার করতে হয়েছে।

Towards the First Anniversary

 

এই বর্বর আক্রমণের মুখে দাঁড়িয়ে কৃষক আন্দোলন নিজের অবস্থানে অনড় এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় স্থিতধী থেকেছে, আর সরকারকে কয়েকটি প্রাথমিক আশু দাবি মেনে নিতে বাধ্য করেছে। সঙ্ঘ-বিজেপি বাহিনী অবশ্য এখনও আশা করছে, আরও হিংস্রতা লেলিয়ে দিয়ে কৃষকদের সম্পূর্ণ হতোদ্যম, নিশ্চুপ করিয়ে দেওয়া যাবে। হরিয়ানায় খট্টর তার দলের লোকজনকে লাঠি তুলে নিতে এবং কৃষকদের পেটাতে নির্দেশ দিয়েছেন (পুলিশ ইতিমধ্যেই একজন কৃষককে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে), মহারাষ্ট্রে মোদী সরকারের বিরুদ্ধে মুখ খোলার জন্য মুখোশধারী দুষ্কৃতিরা বর্ষীয়ান কমিউনিস্ট কৃষকনেতা সুভাষ কাকুশ্তেকে আক্রমণ করেছে, আর দিল্লীতে আইসা’র ছাত্রীরা যখন অজয় মিশ্রের পদত্যাগ দাবি করে অমিত শাহ’র বাসভবনের বাইরে বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন, শাহ’র পুলিশ তাদের যৌন নির্যাতন করে। কৃষক আন্দোলনকে নিজের সমস্ত শক্তিকে সংহত করে হুমকি ও হিংসার দ্বারা আন্দোলনকে চূর্ণ করার ছক ধ্বংস করতে হবে।

একই সঙ্গে আন্দোলনের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো, জনগণের ঐক্যকে ভেঙে দেওয়া এবং মানুষকে বিভ্রান্ত করার নিরন্তর চেষ্টা চলেছে। সাম্প্রতিক সিঙ্ঘু সীমানায় উৎপীড়নের এক ঘটনায় ধর্মীয় বিশ্বাসের জঙ্গি সমর্থক নিহাঙ্গদের একটি গোষ্ঠী এক দলিত যুবক লখবির সিং-এর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কেটে নেয়। এই ঘটনা প্রচণ্ড রূঢ় আঘাত হয়ে নেমে এসেছে; গত প্রজাতন্ত্র দিবসের বিশৃঙ্খলার পর সম্ভবত এটাই আন্দোলনে সবচেয়ে বড় ঝাঁকুনি দিয়ে যায়। পাঞ্জাব সরকার একটি বিশেষ তদন্ত টিম গঠন করেছে এবং কৃষক সংগঠনগুলিও এই ঘটনা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অনুসন্ধান করে দেখছে। বিশদে যে তথ্য উঠে আসছে, তাতে বেশ খানিকটা ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। লখবিরের পরিবার ও গ্রামের মানুষজন কিছুতেই ভেবে পাচ্ছেন না — যে মানুষ গ্রামের বাইরে ক্বচিৎ পা রেখেছেন তিনি কীভাবে সিঙ্ঘু সীমানায় পৌঁছে গেলেন! কিছু ছবি সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে যেখানে এই হত্যার দায় নেওয়া ধর্মীয় গোষ্ঠীটির প্রধান আমন সিংকে কেন্দ্রীয় কৃষি মন্ত্রী নরেন্দ্র সিং তোমরসহ বিজেপি নেতাদের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে থাকতে দেখা গেছে। বিজেপি নেতাদের সঙ্গে বাবা আমন সিং-এর বৈঠকে পাঞ্জাব পুলিশের বরখাস্ত কর্মী তথা অভিযুক্ত খুনী গুরমিত সিং-এর উপস্থিতি এই গোটা আখ্যানকে আরও সন্দেহজনক করে তুলেছে ।

জম্মু ও কাশ্মীরে নির্দিষ্ট নিশানায় সন্ত্রাসবাদী হত্যাভিযানের সাম্প্রতিক ঢেউ এবং সম্প্রতি বাংলাদেশে দুর্গাপূজা চলাকালীন সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক হিংসা কৃষক আন্দোলনের পরিসরে লালিত হিন্দু মুসলমান শিখ সম্প্রীতির উদ্দীপনার সামনে এক চ্যালেঞ্জ। আগামী বছরের শুরুতে উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড ও পাঞ্জাবের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিধানসভা নির্বাচন। তার আগে, সঙ্ঘ-বিজেপি বাহিনী সাম্প্রদায়িক মেরুকরণকে তীব্র করা ও কৃষক আন্দোলনে সামনে উঠে আসা রুটি-রুজি ও উন্নয়নের অ্যাজেন্ডা থেকে মানুষের নজর ঘোরানোর জন্য মাত্রাতিরিক্ত সক্রিয় হয়ে দিন-রাত ঘাম ঝরাচ্ছে। কৃষক আন্দোলন প্রথম বর্ষপূর্তির দিকে এগিয়ে চলেছে। ভারতকে কর্পোরেট লুঠ, সাম্প্রদায়িক হিংসা এবং ফ্যাসিস্ট আগ্রাসন থেকে বাঁচাতে, আসুন আন্দোলনের অর্জনকে রক্ষা করি এবং ছড়িয়ে দিই!

- লিবারেশন সম্পাদকীয়, নভেম্বর ২০২১ সংখ্যা

খণ্ড-28
সংখ্যা-39