৭ নভেম্বর ২০২১। রোববারের সন্ধ্যে। রবীন্দ্র সদনের কাছে এক্সাইড মোড়ে দেখা গেল এক বছর কুড়ির যুবক পড়ে আছে ফুটপাতে। ঐ অঞ্চলে কর্তব্যরত এক সিভিক ভলান্টিয়ার (তন্ময় বিশ্বাস) তার বুট পরা পা চাপিয়ে রেখেছে মহম্মদ জাফর নামক ঐ যুবকের বুকের উপর। চলছে লাথি। সংবাদমাধ্যম বলেছে, ওই যুবক এক মহিলার ব্যাগ ছিনতাই করতে গিয়ে ধরা পড়েছিল। কারণ যাই হোক, এই নৃশংস ছবি এবং ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে প্রকাশ্যে আসার পর থেকেই উঠেছে সমালোচনার ঝড়। তার চাপে ড্যামেজ কন্ট্রোলে তৎপর হয়েছে কলকাতা পুলিশের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ।
বছরখানেক আগে আমেরিকার মিনিয়াপোলিসের রাস্তায় কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েডের গলায় হাঁটু মুড়ে বসে অত্যাচার করেছিল শ্বেতাঙ্গ পুলিশ আধিকারিক ডেরেক শভিন। শ্বাসরুদ্ধ হয়ে জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যু হয়। এই ন্যক্কারজনক ঘটনার প্রতিবাদে সারা বিশ্ব আন্দোলিত হয়। কিছুদিন আগে আসামে দরং জেলায় উচ্ছেদের প্রতিবাদে ধেয়ে আসা এক প্রান্তবাসী হতদরিদ্র মুসলিম বৃদ্ধকে রাস্তায় পুলিশ গুলি করে। তারপর সেখানেই তার মৃত্যু নিশ্চিত করতে তার বুকের ওপর পুলিশের অনুগ্রহপুষ্ট এক ক্যামেরাম্যানের বুট পায়ে লাফানোর দৃশ্য সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়। কলকাতার এক্সাইড মোড়ে গ্রিন পুলিশের বর্বরোচিত আচরণ আরও একবার মিনিয়াপোলিসের ঘটনার ও আসামের সেই খুনে স্মৃতি উস্কে দিল।
পুলিশ-প্রশাসন বরাবরই শাসকশ্রেণীর পোষ্য। ফলত, মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব করার ক্ষেত্রে তারা ক্ষমতাভোগীর বশংবদ। ছাত্র-ছাত্রী, যুবক-যুবতী, দলিত-আদিবাসী সহ সমাজের অন্যান্য অংশের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন-গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষেরা নিজেদের দাবিদাওয়া নিয়ে যখনই রাজপথের দখল নিয়েছে, তখনই সাধারণ মানুষের ন্যায্য দাবির আন্দোলনকে রুখতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়ন। জনবিরোধী বিজেপি সরকারের জমানায় তা আরও ভয়ঙ্কর হয়েছে। সমসময়ে মানুষ এনআরসি-সিএএ’র বিরুদ্ধে রাস্তায় নামছে। কৃষক বিরোধী নয়া কৃষি আইনের বিরুদ্ধে লাগাতার আন্দোলন চলছে। ক্যাম্পাস খোলার দাবিতে গোটা দেশ জুড়ে পথে নেমেছে ছাত্রসমাজ। প্রতিটি ক্ষেত্রেই সেই পুলিশী হিংস্রতার সাক্ষ্য স্পষ্ট। হাথরাসে রাতের অন্ধকারে দলিত কিশোরীর দেহ জ্বালিয়ে দেওয়া থেকে শুরু করে অতি সম্প্রতি আইসা’র ছাত্রীদের যৌনাঙ্গে পুলিশের লাথি — বিজেপি শাসিত কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারগুলোর পুলিশের বর্বরতায় আমরা শিউড়ে উঠেছি। ঐ সরকারগুলো মানুষকে ‘মানুষ’ ভাবে না। তাই তাদের পুলিশ এইভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন করতে সাহস পায়। কিন্তু আমাদের রাজ্যেও তার ছায়াপাত?
হ্যাঁ, স্বীকার করতেই হবে — এটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। আজকে পশ্চিমবঙ্গেও সাধারণ জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার চরম বিপন্ন। খেটে খাওয়া মানুষের হকের দাবিটুকু তুলে ধরার সুযোগটাও কেড়ে নিচ্ছে সরকার। স্কুল-কলেজ-অফিস-কারখানা-কোথাও কোনও ইউনিয়ন গড়ে তোলার জো নেই। অর্থাৎ কর্তৃপক্ষই শেষ কথা বলবে। শাসকশ্রেণীর চিরাচরিত চরিত্র, ছাত্র-যুবক-শ্রমিক-কৃষকের জোট বাঁধার পথ বন্ধ করে দেওয়া। কী কেন্দ্রীয় কী রাজ্য সরকারের জনস্বার্থ বিরোধী নীতি ও আচরণের বিরোধিতায় নিজ নিজ দাবিদাওয়া নিয়ে বামপন্থীরা মিটিং-মিছিলের আয়োজন করলে, পুলিশ-প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে, কোভিড পরিস্থিতিকে হাতিয়ার করে মিটিং-মিছিল বাতিল করে দিচ্ছে রাজ্য সরকার। অথচ, ক্ষমতার অপব্যবহার করে নির্লজ্জভাবে তৃণমূল সরকার কোভিড পরিস্থিতিতে জায়গায় জায়গায় জমায়েত করছে। এভাবেই দিনের পর দিন এক বিশাল অংশের মানুষের গণতন্ত্র হরণ চলছে। সেক্ষেত্রেও আমরা আন্দোলন দমনে প্রশাসনেরর অতিসক্রিয়তায় ডিওয়াইএফ কর্মী মইদুল ইসলামকে প্রাণ হারাতে দেখেছি। চাকরির দাবিতে তিনি বিক্ষোভ জানাতে শহরে এসেছিলেন। আর এই প্রশাসনের চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছি কীভাবে দুর্নীতি, তোলাবাজি, মস্তানরাজ চলছে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। খেটে খাওয়া ‘দিন আনি দিন খাই’ মানুষ মুখ বুজে গুন্ডাবর্গির জুলুম সহ্য করছে। সরকারি সম্পত্তি লুঠ হচ্ছে। প্রশাসন সেখানে নীরব দর্শক। কারণ ঐ লুঠেরারা রাজ্যের শাসকদলের মদতপুষ্ট।
বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোতে পুলিশ-প্রশাসনের ভূমিকা লক্ষ্য করছে গোটা দেশ। কতশত মানুষ ধর্ম-বর্ণ-জাত-পাতের কারণে অকালে মারা পড়ে! বছরের পর বছর সামাজিক বৈষম্য সয়ে বেঁচে থাকে লাখো লাখো মানুষ। এই রাজ্যেও কি সরকার পুলিশ-প্রশাসনকে সেইভাবেই চালানোর পথে এগিয়ে যাচ্ছে না? এক্সাইড মোড়ের ঘটনা কি সেই ভাবনাকে উস্কে দেয় না? একজন ‘সিভিক ভলান্টিয়ার’এর যে উন্মত্ত চেহারা দেখা গেল, সেখানে যে ডিউটিরত পুলিশ অফিসাররা যেভাবে যন্ত্রের মতো থাকলেন — এতো ঔদ্ধত্য আসে কোথা থেকে? এর উৎস রয়েছে পুলিশের হাতে দমনপীড়ন চালানোর ক্ষমতা তুলে দেওয়ার পলিসির মধ্যেই।
রাষ্ট্রের এই নগ্নরূপকে ধিক্কার!
- ত্রিয়াশা