সম্পাদকীয়
প্রশ্ন কর্মসংস্থান : কেন্দ্রের তালে রাজ্য
State at the Center

পশ্চিমবঙ্গ সরকার বেকারি কমাতে এবার বিদেশে কর্মসংস্থানের চেষ্টা চালাবে বলছে। মূল পরিকল্পনাটি কেন্দ্রের — ভাবনায় ও ব্যবস্থাপনায়, তাতে সামিল হচ্ছে রাজ্যও।

বেকারি হ্রাসের প্রশ্নে মোদী সরকারের মূলত কোনও অবদান নেই। বরং করে আসছে গুচ্ছের প্রতিশ্রুতির প্রতারণা। বছরে দু’কোটি কর্মসংস্থান তো করেইনি। উপরন্তু সরকারি ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান লাগাতার লাটে তুলে দিচ্ছে। ব্যাপক বিলগ্নীকরণ, কর্মসংকোচন ও বেসরকারিকরণ তার প্রমাণ। উধাও হয়েছে লক্ষ লক্ষ কাজ, পদ। সরকারি সম্পদ চালান করে দেওয়া হচ্ছে লুটেরা পুঁজিপতিদের হাতে। অন্যদিকে যথেষ্ট ধরা পড়ে গেছে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ আওয়াজের আবহে কর্মসংস্থানের ধোঁকাবাজি। ২০২০-২১’র অতিমারীতে এটাও উন্মোচিত হয়ে গেছে যে, আজকের ভারত প্রধাণত পরিযায়ী জীবিকা-নির্ভর দেশ। সিএমআইই’র মূল্যায়নে নথিবদ্ধ বেকারির সর্বভারতীয় গড় ৬.৯ শতাংশ। রাজ্যওয়ারি বেকারির হার সবচেয়ে বেশি হরিয়ানায় — ২৬.৪ শতাংশ। এই গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো মোদী সরকার বানিয়েছে শ্রমজীবী স্বার্থবিরোধী এক মারাত্মক ‘লেবার কোড’। যারফলে উপরন্তু কাজের অধিকার ও কর্মসংস্থান কচুকাটা করার একচেটিয়া লাইসেন্স পেয়ে যাবে নিয়োগ কর্তৃপক্ষ।

কর্মসংস্থানের প্রশ্নে রাজ্যের মমতা সরকারও দ্বিচারিতা করে চলছে। ক্ষমতায় এসে বলেছিল বেকারের কর্মসংস্থান করা থাকবে বিশেষ লক্ষ্য। তারপরে কি করেছে! বিগত বিধানসভা নির্বাচনেও বস্তুত মিথ্যাচার চালিয়েছে। বলেছে, ক্ষমতায় আসার দশ বছরের মধ্যে ১ কোটি ২০ লক্ষ কর্মসংস্থান করে দিয়েছে। কিন্তু বাস্তবে প্রশ্ন থেকে গেছে কোনও কোনও ক্ষেত্রে কোথায় কোথায় বেকারের হাতে কত কত কাজ মিলেছে? মজুরি বা বেতনের নমুনাই বা কী! বিশেষত যুবশক্তি ও নারীসমাজের কর্মসংস্থান হয়েছে কত? এসবের কোনও বিস্তৃত রিপোর্ট রাজ্য সরকার প্রকাশ করেনি। রাজ্যের বর্তমানে বেকারির ভাগ ৬.২ শতাংশ। সর্বভারতীয় গড়ের তুলনায় সামান্য কম মাত্র। কর্মসংস্থান কেন্দ্রে কর্মপ্রার্থী হিসেবে নাম নথিভুক্ত করার সংখ্যা ৩০ লক্ষ ৫০ হাজারের কাছাকাছি। ২০২০-তে নতুন নাম লিখিয়েছে লক্ষাধিক বেকার। ধরেই নেওয়া যায় অনথিভুক্ত বেকারির আরও কয়েকগুণ বেশি। অতিমারীকালীন সময়ে বোঝা গেল বেকারির চাপ বেড়েছে কত! বেসরকারি ক্ষেত্রে এর নিরসন কত কি কবে হবে সবই অনিশ্চিত। আদৌ হবে কিনা কে বলতে পারে! তবু সরকারি তথা সরকার পরিচালিত পরিপোষিত ক্ষেত্রে শূন্যপদে নিয়োগ করা হচ্ছে না। রাজ্য সরকারের বিভিন্ন বিভাগ মিলে মোট শূন্যপদের সংখ্যা ২ লক্ষেরও বেশি। এছাড়া স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় মিলে শূন্যপদ রয়েছে ১ লক্ষ ৫০ হাজারের মতো। এই দুইয়ের যোগফলে সাড়ে তিন লক্ষের মতো চাকরির ব্যবস্থা এখনই হতে পারে, যুদ্ধকালীন পদক্ষেপে হওয়া উচিত। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সেচ ও বিভিন্ন পরিকাঠামো খাতে বাজেট বরাদ্দ বাড়ানো দরকার। কিন্তু এসব নিয়ে রাজ্য সরকারের কোনও হেলদোল নেই। সেই দায় কার্যত এড়িয়ে চলছে। আর যেসব কর্মসংস্থান করে দেওয়ার কেরামতি জাহির করছে তা মূলত অস্থায়ী চরিত্রের — চুক্তিপ্রথায় ও ঠিকা প্রথায়। চুক্তিপ্রথায় মানে — করানো হয় স্থায়ী কর্মচারির কাজের সম স্তরের সম পরিমাণ কাজ, পাশাপাশি বসে কাজ, সমান সুবিধা স্রেফ ছুটিছাটায়, কিন্তু সম বেতনে নয়; নিয়োগ করা হয় বেতনকাঠামো, পিএফ, গ্র্যাচুইটি বিহীন অর্দ্ধেক পারিশ্রমিকে এবং কোনও কোনও ক্ষেত্রে হয়ত কয়েকবছর অন্তর বড়জোর এককালীন কিছু ইনক্রিমেন্ট মেলে মাত্র। স্থায়ী কর্মচারী হিসেবে কাজ করালে যেখানে বছরে বেতন ব্যয় দাঁড়াবে প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা, সেখানে সম পরিমাণ কাজের জন্য মমতা সরকার খরচ করছে দু’হাজার কোটি টাকার মতো। অর্ধেকেরও কম টাকায় দায় সারা হচ্ছে। এইভাবে রাজ্য সরকার কর্মসংস্থানের দায়বদ্ধতা এড়িয়ে চলছে। কাজ পাওয়ার যাবতীয় ভাগ্য খোলার শর্ত দেখিয়ে দিচ্ছে বেসরকারি উদ্যোগ কি খোলে সেদিকে। বেসরকারি বিনিয়োগ টানতে পরের পর সরকারি আয়োজন অনুষ্ঠান হয়ে আসছে, কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থশ্রাদ্ধ হয়েছে, কাজের কাজ কিছুই হয়নি। এতসব অপদার্থতার প্রেক্ষাপটে রাজ্য সরকার এখন আবার কেন্দ্রের পরিকল্পনার শরিক হিসাবে বিদেশে কর্মসংস্থান করে দেওয়ার কথা বলছে। কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত করে ও প্রশিক্ষণ দিয়ে, অনেকটা জার্মান মডেলে। কেন্দ্রীয় সরকার এরকম এক কোটি কর্মপ্রার্থীর নাম তালিকাভুক্ত হওয়ার পরিসংখ্যান শোনাচ্ছে, যারমধ্যে নাকি এই রাজ্যের প্রার্থীদের নাম-ধামও রয়েছে। কিন্তু এক কোটি লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে পশ্চিমবাংলার কোটা কত তা না করা হচ্ছে খোলসা করে বলা, না করা হচ্ছে ভালো করে খতিয়ে দেখা। রাজ্য ব্যগ্র হয়ে পড়ছে কেন্দ্রের তালে।

খণ্ড-28
সংখ্যা-39