প্রতিবেদন
সাড়ে দশ বছরের তৃণমূল শাসনে নিয়োগে দুর্নীতি নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে
ten and a half years

সাড়ে তিন দশকের ‘বামপন্থী’ শাসনের পরে পশ্চিমবঙ্গের জনসাধারণ কীভাবে দুর্নীতি ও সাম্প্রদায়িকতাকে অনায়াসে মেনে নিতে পারল তা ৭০ বছরের ‘কমিউনিস্ট’ শাসনের পরে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ও পুতিনের মতো স্বৈরতন্ত্রীকে রাশিয়ার জনগণের মেনে নেওয়ার কারণের থেকে কম কিছু গবেষণার বিষয় নয়। বামফ্রন্ট তথা সিপিআই(এম)-র চরম শত্রু বা সমালোচকও এমনটা বলতে পারবেনা যে ‘বামপন্থী’ বামফ্রন্টীয় মন্ত্রী, নেতারা তুমুল দুর্নীতিগ্রস্ত ছিলেন। এমনটাও বলা যাবে না যে নেতারা অতীব সাম্প্রদায়িক ছিলেন। তাহলে সরকার থেকে সরে যাওয়ার ১০ বছরের মধ্যে (বা তারও অনেক আগে থেকে) এত সহজে কীভাবে সরকারের ব্যবস্থাপনায় রন্ধ্রে এত দুর্নীতি প্রকট হয়ে উঠছে।

ক্ষমতাসীন তৃণমূল সরকার ২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে প্রতিনিয়ত একের পর এক দুর্নীতির খবর সামনে আসছে, যার সূত্রপাত সারদা-রোজভ্যালি-আইকোর-এমপিএস প্রভৃতি ‘চিটফাণ্ড’ নিয়ে হাজার কোটি টাকা তছরূপের কাহিনী সামনে আসার মধ্য দিয়ে। বিধায়ক-সাংসদ-মন্ত্রী-শান্ত্রীরা গ্রেফতার হল, কেউ আবার বিজেপি বনে গিয়ে ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে গেল। বিধায়ক-সাংসদ-মন্ত্রীদের সাথে সাংবাদিকদের হাজতবাসও হল। তবে ৮ বছর বাদেও সেই দুর্নীতির রহস্য পুরোপুরি উদঘাটন হল না, শাস্তি হলনা অপরাধীদের। টাকা ফেরত পেলেন না হতভাগ্য আমানতকারীরা। তৃণমূল কংগ্রেসের নেত্রী বা নেতারা যাই বলুন না কেন সারদা-রোজভ্যালির দুর্নীতি তছরূপ, ডেলোতে মিটিং এসব বাস্তব। যেমন ছবির মতো পরিস্কার ভিডিও ছবিতে মুকুল-সুব্রত-শোভন-ফিরহাদ-সৌগত-শুভেন্দু’দের নারদ কেলেঙ্কারিতে টাকা নেওয়া। ৫ বছর বাদেও কোনো শাস্তি নেই। এমনভাবে সরকারগুলি, কেন্দ্রে ও রাজ্যে চলছে এবং চলেছে যে, নেতাদের বিধায়ক মন্ত্রীদের উৎকোচ নেওয়া মোটামুটি আইনসিদ্ধ হয়ে গেছে, কেবল বিধানসভা বা সংসদে এব্যাপারে একটা আইন প্রণয়নে বাকি আছে মাত্র।

ওদিকে গরু পাচার, কয়লা পাচারের মতো কোটি টাকার দুর্নীতিতেও জড়িয়ে পড়ছে তৃণমূল নেতার নাম, এমনকি দলের সেকেণ্ড-ইন-কম্যাণ্ডের নামও এসে পড়ছে। কয়লা পাচারের অন্যতম প্রধান খলনায়ক বিনয় মিশ্র যুব তৃণমূলের সম্পাদক ছিলেন, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠও এবং তিনি ফেরার। ফলে কয়লা পাচারের দুর্নীতিতে তৃণমূল কংগ্রেসের সংযোগ আছে বলাই যায়। এর পাশাপাশি মেট্রো ডেয়ারিকে জলের দরে কেভেন্টার গোষ্ঠির কাছে বেচে দেওয়াটিও একই রকম দুর্নীতির পর্যায়ে পড়ে। নাহলে কেনই বা সরকার যে পরিমাণ শেয়ার (৪৭ শতাংশ) বিক্রি করে মাত্র ৮৫ কোটি টাকা পেল, শেয়ার কেনার পরেই তার এক-তৃতীয়া়ংশের কম (১৫ শতাংশ) বিক্রি করে ১৩৫ কোটি টাকা পেল কেভেন্টার! ফলে ওই হিসেবে সরকার ৩৪০ কোটি টাকা কম দামে শেয়ার বিক্রি করেছে।

দুর্নীতির প্রশ্নে সবথেকে বেশি সামনে এসেছে বিদ্যালয়ের চাকরি। বিদ্যালয়ের শিক্ষক, গ্রুপ ডি, গ্রুপ সি সর্বস্তরেই নিয়োগের ক্ষেত্রে, এমনকি বদলির ক্ষেত্রে যে অবাধ বেনিয়ম আসছে ধারাবাহিকভাবে তা সারা রাজ্যের শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের নৈতিকতাকে প্রশ্নচিহ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে, এবং রাজ্যের শাসক দলের পাহাড় প্রমাণ দুর্নীতির চূড়ায় সোনার কলস স্থাপন করছে। এসএসসি’র নিয়োগের অনিয়ম, প্যানেলের উপরের দিকে থাকা প্রার্থীকে টপকে শেষের দিকে থাকা প্রার্থীকে নিয়োগ করা এসব বারবার ধরা পড়েছে। এমনিতেই নিয়োগ পদ্ধতিকে এতটাই বেনিয়মের ধাঁধায় জড়িয়ে ফেলা হয়েছে যে, এসএসসি’র কোনবারের নিয়োগই আদালতে না গিয়ে শেষ হয়নি। অতি সম্প্রতি বিদ্যালয়গুলিতে গ্রুপ ডি পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে বেনিয়মের কথা সামনে এসেছে। উচ্চ আদালতের মাননীয় বিচারপতি শিক্ষাকর্মীদের নিযুক্তিতে অনিয়মের তদন্ত করার ভার সিবিআই’এর উপর ন্যস্ত করেছিলেন। যদিও ওই আদালতের ডিভিসন বেঞ্চ সে রায়কে পাল্টে তদন্তের ভার অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির তত্ত্বাবধানে করার আদেশ দিয়েছেন। তবে প্যানেল পাল্টে বা বাতিল হওয়া প্যানেল থেকে যে নিয়োগ হয়েছে তা মোটামুটি বোঝা যাচ্ছে। কীভাবে কেন এবং কারা তা কোন উৎকোচের বিনিময়ে করল সেটাই রহস্য ও তা উদঘাটন প্রধান বিবেচ্য। প্রতিদিন শিক্ষক বা শিক্ষাকর্মী নিয়োগ নিয়ে উচ্চ আদালতকে হস্তক্ষেপ করতে হচ্ছে। এসএসসি’র শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম তথা দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্যানেলভুক্ত চাকরিপ্রার্থীরা ধারাবাহিক আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। মুখ্যমন্ত্রী-শিক্ষামন্ত্রীরা বিবিধ প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন ও তা ভাঙছেন। ওদিকে আন্দোলনরত ছাত্রদের গ্রেফতার করে মামলা চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ওইসব আন্দোলনকে গোড়াতেই ধ্বংস করার জন্য করোনার জুজু ও তদুদ্ভুত ডিজ্যাস্টার ম্যানেজমেন্ট আইন তো আছেই। দুর্নীতির বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক আন্দোলন করা ওই আইনে অপরাধ, নিয়োগে ও বদলিতে দুর্নীতি জায়েস্।

কেবল স্কুল সার্ভিস কমিশনেই বা বিদ্যালয়ে চাকরির ক্ষেত্রেই দুর্নীতির বা অনিয়মের দেখা মিলেছে তাই নয়, পাবলিক সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষাতেও তেমন অভিযোগ উঠেছে, এমনকি ওয়েস্ট বেঙ্গল সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় তেমনটাই অভিযোগ। অতি সম্প্রতি প্রকাশিত ক্লার্কশিপ পরীক্ষার ফল ঘোষণার পরে তাকে প্রত্যাহার করে নতুন করে প্রকাশ করাও হয়েছে, কমিশনের চেয়ারম্যানকে অপসারণের পরে। এমনিতেই পশ্চিমবঙ্গে স্থায়ীপদে কর্মী নিয়োগ প্রায় বন্ধ, উপরন্তু যেটুকু হয় তাতেও ভুরি ভুরি বেনিয়ম বুঝিয়ে দিচ্ছে যে চাকরি পেতে কোনো না কোনো অর্থ লেনদেন স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাছাড়া, সিভিক ভলান্টিয়ার বা অন্যান্য অস্থায়ী, কন্ট্রাকচুয়াল কর্মী নিয়োগের কোনো রীতি পদ্ধিতিই নেই, ফলে সেগুলি সরকারি দলের নেতাদের সোনার খনি।

ইমারতি দ্রব্যের সরবরাহে সিন্ডিকেটের কথাতো সকলেরই জানা। এমনটা নয় যে তা কেবল তৃণমূল শাসনেই ঘটেছে। সারাদেশ জুড়েই ইমারতি দ্রব্যের যোগানদার ও বিল্ডিং কন্ট্রাক্ট এবং প্রোমোটিং-এর ব্যবসা প্রায় মাফিয়াদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। যে রাজ্যে যারা ক্ষমতায় আসীন তারাই তার রস আস্বাদন করে থাকে। বামফ্রন্ট আমলেও এলাকার দুলাল, লক্ষ্মণদাদারা ছিল। কিন্তু তৃণমূল শাসনে পুরসভার কাউন্সিলরারা ফুলে ফেঁপে রসালো হয়ে উঠেছে। কাউন্সিলরদের বেতন মাসিক ১০ হাজার টাকা। সেই জনপ্রতিনিধিরা কীভাবে বৈভবশালী হয়ে ওঠেন তা অবশ্যই আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিহীন সম্পদ সংক্রান্ত তদন্তের উপজীব্য হয়ে উঠতে পারে। এলাকায় প্রোমোটারদের থেকে বর্গফুটপিছু অর্থ, নিজের তাঁবে থাকা বিল্ডিং মেটেরিয়াল যোগানদারের কাছ থেকে মাল নিতে বাধ্য করা, নিজের ওয়ার্ডের রাস্তা, ফুটপাথ সংক্রান্ত পুরসভার কন্ট্রাক্টরদের কাছ থেকে কাটমানি নেওয়া এসবই নিয়মসিদ্ধ হয়ে গিয়েছে। কেউ যদি সেটা না নেন তিনি ব্যতিক্রম যা নিয়মকে প্রতিষ্ঠিত করতেই সাহায্য করে।

এইসব কারণে এককথায় বললে অত্যুক্তি হবেনা, তৃণমূল আমলে দুর্নীতি সর্বত্র এক নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে।

- অমিত দাশগুপ্ত

খণ্ড-28
সংখ্যা-44