ক্রিপ্টোকারেন্সি: রাজনৈতিক অর্থনীতির নতুন দুনিয়ার উদয়?
Cryptocurrency_0

(ক্রিপ্টোকারেন্সির প্রচলন এক নতুন ব্যাপার, আর এনিয়ে নতুন আলোচনাও উঠছে। এসম্পর্কে এখনই ঠিক-বেঠিক, ভালো-মন্দ ইত্যাদি অবস্থান না নিয়ে এখানে চর্চার এক প্রাথমিক প্রতিবেদন পরিবেশন করা হল। লিখেছেন অনিন্দ্য ভট্টাচার্য)

কতকটা নিঃশব্দে কিন্তু ত্বড়িত গতিতে ‘ক্রিপ্টোকারেন্সি’ বা ‘ডিজিটাল মুদ্রা’র অবাধ ব্যবহার বেড়ে চলেছে। বহুজনের এখনও এবিষয়ে ধারণা অস্পষ্ট। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রকে এনিয়ে বিস্তারিত আলোচনাও হয়েছে। সরকার ভাবছে কড়া নিয়ন্ত্রণের কথা। বাস্তবতা হল, ‘ডিজিটাল মুদ্রা’ আধুনিক রাজনৈতিক-অর্থনীতির খোলনলচেই বদলে দেওয়ার পথে। যখন বলছি খোলনলচে বদলে দেওয়ার পথে, তখন এর সুদূরপ্রসারী তাৎপর্যকে অনুধাবন করতে হবে।

কী এই ‘ক্রিপ্টোকারেন্সি’? অল্প কথায়, এ হল এক ‘ডিজিটাল মুদ্রা’ যার মাধ্যমে সমাজ-সংসারের যাবতীয় বিনিময়যোগ্য কাজ সারা যায়। অর্থাৎ, কেনাবেচা থেকে শেয়ার বাজারে লিস্টিং, সম্পদ থেকে ওয়ালেট — সর্বত্রই এই ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবহারযোগ্য। একে বস্তুরপে দেখা যায় না (যেমনটা চালু মুদ্রা দ্রষ্টব্য), হাত দিয়ে স্পর্শ করা যায়না, পকেটে করে বাজারে নিয়ে যাওয়া যায় না, কিন্তু টাকাপয়সার মতোই একটি সম্পূর্ণ সত্তা। উপরন্তু, এর কোনও কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা নেই। যেমন, টাকাপয়সার মুদ্রণ ও উৎপাদনের ক্ষেত্রে আমাদের দেশে টাঁকশাল আছে, সেগুলোর নীতি নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণের জন্য কর্তৃত্বকারী সংস্থা আছে (রিজার্ভ ব্যাঙ্ক), ক্রিপ্টোকারেন্সির ক্ষেত্রে এমন কোনও বিধিব্যবস্থা বা নিয়ন্ত্রক সংস্থা নেই। এর যা কিছু উৎপাদন ও যাবতীয় গতিবিধি তা সবই কম্পিউটার নেটওয়ার্ক ব্যবস্থার মধ্যেই। এ এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতি।

এই ডিজিটাল মুদ্রা কীভাবে কাজ করে? প্রথমে বলে নেওয়া যাক, বহুশ্রুত ‘বিটকয়েন’ কিন্তু ক্রিপ্টোকারেন্সির একমাত্র মুদ্রা নয়, অন্যতম তো বটেই। ‘লাইটকয়েন’, ‘রিপল’ ইত্যাদি বহু ধরনের আরও ক্রিপ্টোকারেন্সি আছে যা বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন মাত্রায় জনপ্রিয়। ২০০৯ সালে জাপানের এক সাইবার বিশেষজ্ঞ সাতোশি নাকামোতো এই মুদ্রার আবিষ্কারক ও তার চলনবলনের কারিগর। মতান্তরে কথিত, সাতোশি নাকামোতো কোনও ব্যক্তি বিশেষ কেউ নন, একটি গোষ্ঠী অথবা কিছু ব্যক্তির সমষ্টি যারা একযোগে এমন একটি ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছে। ক্রিপ্টোকারেন্সি আসলে একটি সফটওয়্যার যা ব্লকচেন প্রযুক্তির অধীনে কম্পিউটার নেটওয়ার্ক ব্যবস্থাপনায় বিবিধ আদানপ্রদানকারীদের মধ্যে পরস্পরের আস্থার ভিত্তিতে চলমান একটি লেনদেন ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থায় যখন স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে যুক্ত হয়ে মানুষ ক্রিপ্টোকারেন্সি মারফত নানারকম লেনদেনে লিপ্ত হচ্ছেন তখন কিছুটা পরিসরে তার সমাজ-গ্রাহ্যতা তৈরি হয়ে যাচ্ছে। ধরা যাক, চার বন্ধু মিলে ঠিক করল যে তারা পরস্পরের মধ্যে কড়ি দিয়ে লেনদেন করবে। সেই মোতাবেক, তারা নির্দিষ্ট পরিমাণ কড়ির বিনিময়ে পরস্পরের মধ্যে কেনাবেচা শুরু করল। ফলে, ওই চারজনের পরিসরে কিন্তু কড়ি-ব্যবস্থা একটা মান্যতা পেল। যদি এমত অভিমত আরও সম্প্রসারিত হয়, তাহলে এই পরিসরটা আরও বৃহৎ হবে এবং তার একটা সমাজ-গ্রাহ্যতা তৈরি হবে। এবার এই সম্প্রসারণ যদি আরও ব্যাপক হয়, তাহলে এমনটা হতেই পারে যে কড়ির সঙ্গে টাকাপয়সার একটা লেনদেনের ব্যবস্থাও তৈরি হয়ে যাবে। ক্রিপ্টোকারেন্সির ক্ষেত্রে ঠিক এটাই হয়েছে। অর্থাৎ, আপনি যে পরিমাণ ক্রিপ্টোকারেন্সির অধিকারী, তার সঙ্গে টাকাপয়সা বা ডলারের একটা বিনিময় মূল্যও তৈরি হয়ে গেছে। এ এক অভিনব অবস্থা। বলা যায়, রাজনৈতিক অর্থনীতির এক পালাবদলের ইঙ্গিত।

এখন প্রশ্ন হল, ক্রিপ্টোকারেন্সি কি পুঁজিবাদের গর্ভগৃহে আঘাত হানছে? নাকি, পুঁজিবাদের এক নতুন অবয়ব নির্মাণ করছে! এই প্রশ্নের উপযুক্ত উত্তর পেতে হলে আরও কিছুকাল আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু নিঃসন্দেহে অন্তত এ কথাটুকু বলা যেতে পারে — চিরায়ত পুঁজিবাদ থেকে এ অন্যতর এক বাঁক বদল। এনিয়ে বহু বিতর্ক আছে, বিভ্রান্তি আছে, সংশয়ও দেখা দিয়েছে, কিন্তু এটা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার, পুঁজিবাদী অর্থনীতির অন্যতম এক জীবনরেখা যে মুদ্রা ব্যবস্থা, তা যদি কেন্দ্রীয় কোনও নিয়ামক সংস্থার অধীনে আর না থাকে, মুদ্রানীতির ওপর রাষ্ট্রের যদি আর কোনও নিয়ন্ত্রণ না থাকে, তাহলে তা অবশ্যই এক আমূল পরিবর্তনের স্মারক। এতে করে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে কিনা, তা অবশ্যই হলফ করে বলার সময় এখনও আসেনি। কিন্তু পুঁজিবাদের যে নতুন এক ঘরানা গড়ে উঠবে, তা কতকটা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। আর তা অন্যান্য আনুষঙ্গিক পরিবর্তনগুলির মধ্য দিয়েও বেশ স্পষ্টত বোঝা যাচ্ছে।

এনিয়ে তো কোনও সংশয় নেই যে আমরা পুরনো ভূ-রাজনৈতিক-সামরিক রাষ্ট্রিক অবয়ব থেকে ক্রমশ প্রবেশ করছি এক ভার্চুয়াল-তথ্যভিত্তিক-প্রযুক্তিআবদ্ধ দুনিয়ার দিকে! সাবেক রাষ্ট্রের সঙ্গে নব-উত্থিত ভার্চুয়াল দুনিয়ার (ফেসবুক, গুগল, মাইক্রোসফট, অ্যাপেল সহ আরও বহু) দ্বন্দ্ব-সংঘাতও বেশ প্রকট। মাঝে মধ্যেই ভার্চুয়াল দুনিয়ার মহারথীদের সংসদে অথবা নানাবিধ নিয়ন্ত্রক সংস্থার দফতরে ডেকে কড়কে দেওয়ার রীতিও সমানে চলেছে। অ্যালগরিদম’এর প্রকৌশলে নৈতিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক নানারকম ঝঞ্ঝা সৃষ্টি করে সমাজকে সরগরম করে তোলা, ‘পেগাসাস’ ধরনের কারুকৌশলে নিভৃতে, গোপনে ব্যক্তিগত তথ্যকে অপহরণ করা, মায় কোনও দেশে রাজনীতির গতিপথকে বদলে দেওয়া — সব ধরনের কাজেই ভার্চুয়াল দুনিয়া এখন এতটাই পারঙ্গম যে সাবেক রাষ্ট্রকে তাদের সামনে অনেক সময়েই বড় অসহায় দেখায়। তদুপরি, প্রযুক্তির বাহুবলে রাষ্ট্র নিজেদের পারদর্শী করতে এইসব ভার্চুয়াল দুনিয়ার সর্বশেষ প্রযুক্তিকে আবাহন করে (যেমন আমাদের দেশে ‘পেগাসাস’এর ব্যবহার), আর এইভাবে তারাও প্রকারান্তরে বেশি বেশি করে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে ওইসব ভার্চুয়াল কারবারীদের ওপর। দিনে দিনে এই প্রবণতা রাষ্ট্রের অসহায় আত্মসমর্পণের নামান্তর হয়ে ওঠা সময়ের অপেক্ষা মাত্র।

এই প্রেক্ষাপটে ক্রিপ্টোকারেন্সির ক্রম-জনপ্রিয়তা রাজনৈতিক অর্থনীতির এক নতুন আঙ্গিকের দিকে আমাদের নিয়ে চলেছে। ইতিমধ্যে ‘দ্য গ্রেট রেজিগনেশন’এর নব-প্রবণতা (শুধু আমেরিকায় নয়, ভারত সহ বহু দেশে) এক নতুন ধরনের শ্রমবাহিনীর উত্থানের জমিকে উর্বর করে তুলছে। স্থায়ী চাকরির জমানার অবসান হতে চলেছে, সে জায়গায় গিগ কর্মের উদয়ের সঙ্গে সঙ্গে কাজের বহুমাত্রিকতা জন্ম নিচ্ছে, যেখানে কর্মত্যাগ ও কর্মপ্রাপ্তি বহুজনের পক্ষেই আয়াসসাধ্য হয়ে উঠছে। এক অর্থে, কেউ কেউ বলছেন, এর ফলে শ্রমবাহিনীর দর কষাকষির সক্ষমতাও বাড়ছে। যদিও তা সত্যি কিনা, তা খতিয়ে দেখার আছে; কিন্তু প্রখর এই বাস্তবটাকে কেউ অস্বীকার করতে পারছেন না যে — কাজ আছে চাকরি নেই। এমতাবস্থায় ক্রিপ্টোকারেন্সি যদি আগামী কয়েক বছরের মধ্যে বিনিময়ের এক অন্যতম মুদ্রা হয়ে ওঠে, তাহলে মানুষে মানুষে অর্থনৈতিক লেনদেনের এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হবে। কারণ, যেহেতু এই ডিজিটাল মুদ্রার কোনও নিয়ন্ত্রক কর্তা নেই, আদানপ্রদানকারীর পরস্পর আস্থার ওপরেই এর চলাচল, অতএব, তা রাজনৈতিক অর্থনীতির এক নতুন বয়ান নির্মাণ করবে। কেমন হতে পারে সে নতুন দুনিয়া, তা অবশ্য আরও গভীর আলোচনার বিষয়।

খণ্ড-28
সংখ্যা-43