প্রতিবেদন
এনসিআরবি রিপোর্টে গার্হস্থ্য হিংসার পরিসংখ্যান কমিয়ে দেখানো হয়েছে কি?
Has the NCRB report

গার্হস্থ্য হিংসা সংক্রান্ত ভূয়ো পরিসংখ্যানও সংসদীয় আলোচনা ও সংসদীয় প্রতিবেদনের ভিত্তি হয়ে উঠেছে। সর্বোপরি এই পরিসংখ্যানের পিছনে সরকারি উদ্দেশ্যটি শুধুমাত্র পরিসংখ্যানেই সীমাবদ্ধ নয়, বিষয়টি তার থেকেও গুরুতর।

এনসিআরবি’র রিপোর্ট অনুসারে গার্হস্থ্য হিংসার পরিসংখ্যান ব্যাপক হ্রাস পেয়েছে, কিন্তু পারিবারিক হিংসার ঘটনা প্রকৃত অর্থে বেড়েইছে। এনসিআরবি রিপোর্ট অনুযায়ী গার্হস্থ্য হিংসা সুরক্ষা আইনের অধীনে ২০১৮ সালে মোট ৫৭১টি মামলা নথিভুক্ত করা হয়েছিল। এই আইনে মামলা নথিভুক্ত করা হয়েছিল ২০১৯ সালে ৫৫৩টি এবং ২০২০ সালে ৪৪৬টি। ২৮টি রাজ্য ও ৮টি কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলে অর্থাৎ মোট ৩৬টির মধ্যে ২৬টিতে গার্হস্থ্য হিংসা আইনে মামলার সংখ্যা উল্লেখ হয়েছে শূন্য। মধ্যপ্রদেশে মামলার সংখ্যা সর্বাধিক রেকর্ড করেছে, মামলা গড়িয়েছে ১৮০টি। যদি উপরোক্ত রিপোর্ট বিশ্বাস করতে হয় তাহলে তো বুঝতে হয় ভারত থেকে গার্হস্থ্য হিংসা দ্রুত বিদায় নিচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন জাগে এই পরিসংখ্যানের সত্যতা নিয়ে।

এই পরিসংখ্যানের সত্যতা যাচাই করার জন্য ঘটনা ধরে ধরে তালাশ করার অতিরিক্ত প্রচেষ্টার প্রয়োজন নেই। আপনি আপনার সাধারণ বোধ থেকেই বলতে পারেন যে এই পরিসংখ্যান ভুলে ভরা। তবু নারী ও শিশু উন্নয়ন মন্ত্রকের ২০২০’র ২২ সেপ্টেম্বরের প্রেস বিবৃতি ফিরে দেখতে পারেন। সেখানে গার্হস্থ্য হিংসার তথ্যের উল্লেখ রয়েছে। এনসিআরবি রিপোর্ট শুধুমাত্র ফৌজদারি মামলার রিপোর্ট নয়। তাতে গার্হস্থ্য হিংসা আইন ২০০৫ অনুসারে নথিভুক্ত মামলাগুলির জন্য এনসিআরবি’র রিপোর্টে একটি আলাদা বিভাগ তৈরী করা হয়েছে। তবে সেখানে শুধুমাত্র পরিসংখ্যান লিপিবদ্ধ করা হয়।

ভূয়ো পরিসংখ্যান নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। ২০২০ সালের ২০ মার্চ লোকসভায় নারী ও শিশু উন্নয়ন মন্ত্রকের কাছে একটি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল গার্হস্থ্য হিংসার অবস্থা সম্পর্কে। জানতে চাওয়া হয়েছিল ২০১৫, ২০১৬, ২০১৭ ও ২০১৮ সালে মোট নথিভুক্ত গার্হস্থ্য হিংসা বিষয়ক মামলার বৃত্তান্ত প্রসঙ্গে। প্রশ্নের উত্তরে নারী ও শিশু উন্নয়ন মন্ত্রী স্মৃতি ইরানি বলেছিলেন, গার্হস্থ্য হিংসাজনিত মামলা নথিভুক্ত হয়েছে ২০১৬ সালে ৪৩৭টি, ২০১৭ সালে ৫১৫টি এবং ২০১৮ সালে ৫৭৯টি। এইসমস্ত তথ্য পরিসংখ্যান নেওয়া হয়েছে এনসিআরবি রিপোর্ট থেকে। কিন্তু এই পরিসংখ্যান প্রকৃত বাস্তবতা থেকে বহু দূরে এবং প্রশ্নোত্তরের ও আলোচনার অংশ হয়ে উঠেছে।

বিষয়টি শুধু এটুকুতেই সীমাবদ্ধ নয়। ২০২১’র ১৫ মার্চ সংসদীয় স্থায়ী কমিটি লোকসভা ও রাজ্যসভায় নারী ও শিশুদের প্রতি অপরাধ সংক্রান্ত প্রতিবেদন পেশ করে। ঐ রিপোর্টে ব্যবহৃত তথ্য নেওয়া হয়েছে এনসিআরবি’র রিপোর্ট থেকে। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে এই পরিসংখ্যান সঠিক নয়। এটি একটি গুরুতর ব্যাপার। কারণ তথ্য ও প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ভবিষ্যতের নীতি ও অগ্রাধিকার নির্ধারণ করা হয়।

গার্হস্থ্য হিংসা সুরক্ষা আইনের কার্যকরী রূপায়ণের প্রশ্নে সরকারের দুর্দশার কারণ হল পর্যাপ্ত তথ্যের অভাব। মহিলা আন্দোলনের দীর্ঘ ধারায় এই আইনটি অর্জিত হয়েছে। কিন্তু গত ১৫ বছর ধরে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার এই আইনের দুর্দশাই করেছে। আইনে সুরক্ষা প্রদানের কর্মকর্তা নিয়োগের বিধান রয়েছে। নির্যাতিতা নারীর ন্যায়বিচারের পুরো বিষয়টি নির্ভর করে প্রটেকশন অফিসারকে কেন্দ্র করে। সুরক্ষা প্রদানের ভারপ্রাপ্ত অফিসারই আইনানুগ সবকিছু করে ওঠার মূল চালিকাশক্তি। কিন্তু কয়েকটি রাজ্য ছাড়া বাকি সব রাজ্য সুরক্ষা অফিসার নিয়োগ করেনি। যেখানে স্বতন্ত্র সুরক্ষা অফিসার নিয়োগ করা হয়েছে, তাদের বিভিন্ন জেলায়ও দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। যেমন ধরুন, হরিয়ানায় স্বাধীন সুরক্ষা কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়েছে, কিন্তু তাদের সংখ্যা খুবই অপ্রতুল। ফলে অনেক সংরক্ষিত কর্মকর্তাকে দুটি করে জেলার দায়িত্ব নিতে হচ্ছে। কিছু কিছু জায়গায় আবার অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে সুরক্ষা দেখার দায় সারা হচ্ছে বিডিও’দের মাধ্যমে।

মহারাষ্ট্রের শিবসেনা সাংসদ ডঃ শ্রীকান্ত একনাথ শিন্ডে লোকসভায় নারী ও শিশু উন্নয়ন মন্ত্রকের প্রতিনিধির উদ্দেশে প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন সুরক্ষা অফিসার নিয়োগের ব্যাপারে। তিনি জানতে চেয়েছিলেন রাজ্য ও কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলগুলি দ্বারা পর্যাপ্ত সুরক্ষা অফিসার নিয়োগ করা হয়েছে কিনা? তা না করা হয়ে থাকলে কেন্দ্রের তরফে এবিষয়ে রাজ্য সরকারগুলির কাছে উত্তর জানতে চাওয়া হয়েছে কিনা? রাজ্য সরকারগুলি কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে? কেন্দ্র কি রাজ্য সরকারগুলিকে সংরক্ষণ আধিকারিকদের সুস্পষ্টভাবে কাজ করার জন্য বাজেট বরাদ্দ করতে বলেছে? এই প্রশ্নের উত্তরে নারী ও শিশু উন্নয়ন দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী ডঃ বীরেন্দ্র কুমার উত্তর দেন, সমস্ত রাজ্যে সুরক্ষা অফিসার নিয়োগ করা হয়েছে। তাছাড়া বেশিরভাগ রাজ্যে অন্যান্য অফিসারদের এবিষয়ে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

অর্থাৎ বেশিরভাগ রাজ্যে সেই অফিসাররা সুরক্ষা অফিসারের দায়িত্ব পাচ্ছেন যারা ইতিমধ্যেই কাজের চাপে ভারাক্রান্ত। যেখানে সবাই বোঝেন যে, গার্হস্থ্য হিংসা বিষয়ে ভূমিকা পালনের ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের অতিরিক্ত সংবেদনশীলতা এবং শান্ত থাকা দরকার। যাতে তিনি সহানুভূতির সাথে ভিক্টিমদের কথা শুনতে পারেন। ভিক্টিম তাঁর দৃষ্টিভঙ্গী অনুযায়ী বর্ণনা রাখার সময় অনেক সময় অনেক মানসিক অশান্তির মধ্যে দিয়ে যান, কান্নায় ভেঙে পড়েন। সেখানে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালনের জন্য ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের কি সংবেদনশীলভাবে ভিক্টিমের কথা শোনার ধৈর্য্য থাকে? এনসিআরবি’র রিপোর্টে গার্হস্থ্য হিংসা সুরক্ষা আইন মোতাবেক প্রচেষ্টার অভাব থেকে যাওয়ার পিছনে কারণ হল সরকারি দুর্দশা।

- মূল হিন্দী প্রতিবেদন সূত্রঃ hindi.newsclick.in, ভাষান্তরঃ শুক্লা সেন

খণ্ড-28
সংখ্যা-45