প্রতিবেদন
ইনফর্মাল শ্রমিক — এক আর্থ-সামাজিক প্রোফাইল
Informal workers

গত ২৬ আগস্ট, কেন্দ্রীয় শ্রমমন্ত্রক দেশের অসংগঠিত শ্রমিকদের নথিভুক্ত করতে ই-শ্রম ওয়েব পোর্টালের উদ্বোধন করে। আনুমানিক ৭০৪ কোটি টাকার বিনিময়ে গড়ে উঠেছে এই ওয়েব পোর্টাল। দেশের মধ্যে এটি হল অসংগঠিত শ্রমিকদের জন্য এযাবত প্রথম কেন্দ্রীভূত ডেটাবেস বা তথ্যভান্ডার যাকে সংযুক্ত করা হয়েছে আধার’এর সঙ্গে। ১৬ থেকে ৫৯ বছরের যে কোনও অসংগঠিত শ্রমিক, যারা পিএফ/ইএসআইসি বা সরকারি তহবিলভুক্ত জাতীয় পেনশন স্কিম বা এনপিএস’এর আওতায় নেই, তাঁরাই এই পোর্টালে নাম নথিভুক্ত করতে পারবেন। নথিভুক্ত শ্রমিকদের দুর্ঘটনায় মৃত্যু বা স্থায়ীভাবে অঙ্গহানি হলে এককালীন তাঁর নিকটাত্মীয় পাবেন দু’লক্ষ টাকা আর আংশিক অঙ্গহানি হলে পাবেন একলক্ষ টাকা। নথিভুক্ত শ্রমিকরা পাবেন ১২ ডিজিটের এক ইউনিক পরিচয় কার্ড, আর ভবিষ্যতে কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকারগুলো যদি কোন ধরনের সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প চালু করে তবে তাঁরা তার সুযোগ পেতে পারেন। যেহেতু, চারটি শ্রমকোডের মধ্যে অন্যতম সামাজিক সুরক্ষা কোড দেশের সমস্ত অসংগঠিত শ্রমিকদের জন্য সর্বজনীন সামাজিক সুরক্ষা চালু করেনি, তাই বোঝাই যাচ্ছে, এখন পর্যন্ত বিভিন্ন অসংগঠিত ক্ষেত্রের জন্য যেটুকু ‘সামাজিক সুরক্ষার’ প্রকল্পগুলো আছে, তা বিলুপ্ত করে সবটাই আনা হবে একই ছাতার তলায়। সামাজিক সুরক্ষার এই খুড়োর কল দেখিয়ে আগামীদিনে আরও কত শ্রমিক নিজের নাম নথিভুক্ত করেন, সেটাই দেখার। শ্রম মন্ত্রকের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ই-শ্রম পোর্টালটি ২৬ আগস্ট উদ্বোধন হওয়ার পর থেকে ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১০.০৬ কোটিরও বেশি অসংগঠিত শ্রমিক নিজেদের নাম এখানে নথিভুক্ত করেছেন। কেন্দ্রীয় শ্রমমন্ত্রী ভূপেন্দ্র যাদব বলেছেন, এটা নাকি আগামীদিনে অসংগঠিত শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষার আওতায় আনতে ‘গেম চেঞ্জার’এর ভূমিকা পালন করবে এবং সরকারি সুযোগ-সুবিধা প্রাপকদের নির্দিষ্ট ও চিহ্নিত করতে প্রভূত সাহায্য করবে।

বিগত ১৩ সপ্তাহ ধরে যে চারটি রাজ্যের শ্রমিকরা সবচেয়ে বেশি নিজেদের নথিভুক্তি করিয়েছেন, সেই রাজ্যগুলি হল — পশ্চিমবাংলা (২.১৭ কোটির বেশি), উত্তরপ্রদেশ (১.৯৫ কোটি), উড়িষ্যা (১.২২ কোটি) এবং বিহার (১.০৮ কোটি)। একই সময়কালে সমগ্র নথিভুক্তির মধ্যে পুরুষ ও মহিলাদের সংখ্যা যথাক্রমে ৫২ শতাংশ ও ৪৮.৬ শতাংশ। নথিভূক্ত শ্রমিকদের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই হলেন তরুণ — ১৮ থেকে ৪০’র মধ্যে — আর, এরাই হলেন প্রায় ৬৩ শতাংশ। তারপরই রয়েছেন ৪০ থকে ৫০ বছর বয়সের শ্রমিকেরা, যারা হলেন সমগ্রের ২১.৫ শতাংশ।

দেখা যাচ্ছে, সমগ্র নথিভুক্ত শ্রমিকদের মধ্যে পশ্চিমবাংলা থেকেই প্রায় এক চতুর্থাংশ নিজেদের অন্তর্ভুক্ত করিয়েছেন। আর, উল্লিখিত চারটি রাজ্য বাদে, অন্যান্য রাজ্য থেকে গোটা শ্রমশক্তির দুই শতাংশেরও কম নথিভুক্ত হয়েছে। অনেক শ্রম বিশেষজ্ঞ বলেছেন, আধার কার্ডের সাথে নিজেদের মোবাইল ফোনের বাধ্যতামূলক সংযুক্তির শর্ত না থাকলে, আর ই-শ্রম পোর্টালে নাম তোলার প্রক্রিয়া-পদ্ধতি প্রকরণ অনেক সহজ সরল হলে এই সময়সীমার মধ্যে আরও অনেক বেশি শ্রমিক নিজেদের নাম নথিভুক্ত করাতেন।

Informal workers - a socio-economic profile

আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সামনে আসছে শ্রম মন্ত্রকের ওয়েবসাইট থেকে। দেখা যাচ্ছে, ২৫ নভেম্বরের মধ্যে নথিভুক্ত শ্রমিকদের প্রায় ৫৩ শতাংশই হলেন কৃষিক্ষেত্রে কর্মরত। এরপর রয়েছে উৎপাদন শিল্প (১৩ শতাংশ) এবং নির্মাণ (১২ শতাংশ)। বোঝাই যাচ্ছে, ভারতে এখনও বৃহত্তম নিয়োগকর্তা কৃষি ক্ষেত্র — যে ক্ষেত্রটি সবচেয়ে বঞ্চিত, উপেক্ষিত। শিল্পবিকাশ বা উন্নয়নের গালভরা স্লোগানের আড়ালে কেন্দ্রীয় সরকার যাদের দিয়ে যাচ্ছে বিপুল ভর্তুকি (ইন্সেন্টিভের নামে), কিন্তু কর্মসংস্থানে যারা পিছিয়ে রয়েছে অনেকটা। যাক সে কথা।

কোভিড অতিমারির প্রথম হানায়, মোদী সরকার অতর্কিতে দেশব্যাপী নির্দয় লকডাউন ঘোষণা করার পর গোটা দেশ এমনকি বিশ্ব দেখল পরিযায়ী শ্রমিকদের নিদারুণ যন্ত্রণা ও ট্রাজেডি। কাতারে কাতারে পরিযায়ী শ্রমিক রাতারাতি রুটি- রুজি ও মাথার উপর একচিলতে ছাদ খুইয়ে কিভাবে হয়ে গেলেন নেই-রাজ্যের বাসিন্দা তা আমরা বসে বসে শুধু দেখলাম। সংখ্যায় এরা কত, তার হিসাব তখন দিতে পারল না কোনও সরকার — না রাজ্য, না কেন্দ্র। দিল্লী সরকার তো শীর্ষ আদালতে জানিয়েই দিল যে তাদের খাতায় কারুর নাম বা সংখ্যা নেই। অথচ, তখনও দেশে লাগু ছিল পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে কেন্দ্রীয় আইন ‘ইন্টার স্টেট মাইগ্রেন্ট ওয়ার্কমেন অ্যাক্ট, ১৯৭৯’। যেখানে কোন সংস্থায় বা কোন ঠিকাদারের অধীনে কতজন পরিযায়ী শ্রমিক কোথায় কর্মরত, তার হিসাব রাখাটা সেই আইন অনুযায়ী বাধ্যতামূলক ছিল। এই পরিঘটনার উপর দাঁড়িয়ে, ২০২১’র জুন মাসে সুপ্রিমকোর্ট কেন্দ্রীয় সরকারকে নির্দেশ দেয়, পরিযায়ী শ্রমিকদের এক জাতীয় তথ্যভান্ডার তৈরি করতে। এই নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার নানা টালবাহানা করায় শীর্ষ আদালতের কাছে তীব্র ভৎর্সনার মুখে পড়ে অবশেষে এই ই-শ্রম পোর্টাল দিনের আলো দেখল। কিন্তু পরিহাস এটাই, ৭ নভেম্বর পর্যন্ত মাত্র ২.২৫ শতাংশ পরিযায়ী শ্রমিক নিজেদের নাম নথিভুক্ত করিয়েছেন।

কেন্দ্রীয় সরকারের লক্ষ্য, আনুমানিক ৪০ কোটি অসংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মরত শ্রমিকদের এই পোর্টালে নথিভুক্ত করাবে। কিন্তু, ইতিমধ্যেই যে সমস্ত তথ্য উঠে এল, তার শবব্যবচ্ছেদ করলে নির্মম ও কঠোর বাস্তবের ধূসর ছবি ফুটে ওঠে। দেখা যাচ্ছে, প্রায় ১০ কোটি নথিভুক্ত শ্রমিকদের মধ্যে ৯৪.৫ শতাংশের মাসিক আয় দশ হাজার টাকারও নীচে। এক শতাংশের মাসিক আয় ১৫ হাজার থেকে ১৮ হাজার টাকার মধ্যে, আর ০.৫ শতাংশের আয় ১৮ হাজার থেকে ২১ হাজারের মধ্যে। পাশাপাশি আরেকটি তথ্য উঠে এল — ৭০ শতাংশেরও বেশি অসংগঠিত শ্রমিকরা হলেন তপসিলি জাতি, উপজাতি ও অন্যান্য পিছিয়ে পড়া বর্গ থেকে আগত। অর্থাৎ, শেষোক্ত এই গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক স্তরটি সমস্ত মাপকাঠি থেকে বঞ্চিত, প্রান্তসীমায় নিক্ষিপ্ত। আর্থিক, সামাজিক ও মর্যাদার দিক থেকে। কিন্তু এই বিপুল অংশটি তো দেশের জিডিপি’তে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখে চলেছে। সেই ২০০৮ সালেই অর্জুন সেনগুপ্ত নেতৃত্বাধীন গড়ে ওঠা ‘ন্যাশনাল কমিশন ফর এন্টারপ্রাইজেস ইন দ্য আনঅর্গনাইজড সেক্টর’ (আজ পর্যন্ত যে সমীক্ষাটি সবচেয়ে তথ্যমূলক গবেষণাধর্মী ও আন্তর্জাতিকভাবে সমাদৃত) রিপোর্টে জানান যে এই ইনফর্মাল ক্ষেত্রটি দেশের জিডিপিতে ৫০-৫৫ শতাংশ অবদান রাখে। এরাই গোটা শ্রমশক্তির ৯২ শতাংশ! দেশের শাসকবর্গ যখন ৭৫ বছরের স্বাধীনতাকে বিপুল উদ্যমে উদযাপন করছে, তখন তারা আমাদের ভুলিয়ে দিতে চাইছেন যে সমাজের সবচেয়ে বঞ্চিত, অগণন, অগোচরে থাকা নামহীন, অবয়বহীন ইনফর্মাল শ্রমিকরাই জাতীয় আয়ে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখে চলেছেন। ভারতের বিপুল সংখ্যাধিক্য কর্মক্ষম এই তরুণ জনসংখ্যার যৎসামান্য আয় যথেষ্ট মাত্রায় বৃদ্ধি করতে না পারলে যে দেশের অর্থনীতির এই ঝিমুনি কাটবে না, তা রাষ্ট্রক্ষমতার অলিন্দে থাকা নীতিকারেরা কোনদিনই স্বীকার করলেন না। এদিকে, আইএলও তার প্রতিটি পলিসি ঘোষণায় স্বাক্ষরকারী দেশগুলোকে এই বার্তা নিরন্তর দিয়ে যাচ্ছে।

দিন কয়েক আগে, বিপরীত দুটো চিত্র দেখা গেল।

৪ঠা ডিসেম্বরে, একটি প্রথম সারির ইংরাজি সংবাদপত্র কর্তৃক আয়োজিত এক আলোচনাসভায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ দাবি করেন, কোভিড অতিমারির ধ্বংসাত্মক প্রভাব থেকে ভারতের অর্থনীতি নাকি গোটা বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে দ্রুততার সাথে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে মোদী সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্তের দৌলতে।

আর, ৫ ডিসেম্বর, গুজরাতের আমেদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের এক অনলাইন সমাবেশে নোবেল জয়ী অর্থশাস্ত্রী অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “দেশের অর্থনীতি বিধ্বস্ত। ভয়ংকর কষ্টে আছেন দেশবাসী। করোনা আঘাত হানার আগে দেশের অর্থনীতি যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, এখন তার থেকেও তা নীচে গড়িয়ে পড়েছে।”

১.৪৫ লক্ষ কোটি টাকার কর্পোরেট কর কেন্দ্রীয় সরকার মকুব করলেও শিল্পের মড়া গাঙে বান এলো না। উপরন্তু, সেই একই আলোচনাসভায় (ইংরেজি দৈনিকের) অর্থমন্ত্রী কর্পোরেটদের উদ্দেশ্যে বললেন, সহজে ব্যবসা-বাণিজ্য করার শর্ত, শিথিল কর্পোরেট কর কাঠামো ও আইন মানার বোঝা থেকে ক্রমে সরে এসেই দেশের অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করতে হবে।

যে নির্মম বাস্তবের মুখোমুখি এনে দাঁড় করালো ই-শ্রম পোর্টালের তথ্যভান্ডার, আগামীতে অনিচ্ছাকৃতভাবে যা আরও অনেক কিছু উদ্ঘাটিত করবে, তার উপর দাঁড়িয়ে সরকার — সে রাজ্যই হোক বা কেন্দ্রীয় — নতুন করে রচনা করবে কি নীতিমালা?

- অতনু চক্রবর্তী

খণ্ড-28
সংখ্যা-46