প্রতিবেদন
‘মোদী হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়!’ সত্যি?
Modi hai

নিখুঁত চিত্রনাট্য! অপূর্ব অভিনয়! শুধু ‘'তদ্গত'’ অবস্থায় ক্যামেরার দিকে বার কয়েক ভুল করে তাকিয়ে ফেলা।

হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন। হচ্ছে ‘ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুরাষ্ট্রের’ স্বপ্নের ফেরিওলা নয়া ফ্যাসিবাদী সেই নেতা-অভিনেতার কথা। আজ কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরের নব কলেবরের ৩৩৯ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত প্রথম পর্যায়ের নির্মাণের উদ্বোধন করতে গিয়ে কীভাবে তিনি গঙ্গায় ডুব দিলেন, পূজার্চনা-আরতি করলেন, কী ভাবে গঙ্গাবক্ষে সুসজ্জিত বিলাসবহুল ক্রুজে বসে বিপুল অর্থব্যয়ে আয়োজিত ‘শিব দীপাবলির’ অপূর্ব আলোকমালায় উদ্ভাসিত নগরীর সৌন্দর্য অবলোকন করলেন, কীভাবে হিন্দুত্বের রাজসিক প্রচারে গোটা একটি দিন কাটালেন (আরও একটি দিন কাটাবেন ভোট প্রচারে) — গোদী মিডিয়ার দিনভর সবিস্তার গদগদ বর্ণনায় দেশবাসী তা জেনেছেন। শুনেছেন জাতির উদ্দেশে তার ভাষণে কীভাবে সাম্প্রদায়িক বিষোদগার করে বিশ্বনাথ মন্দিরের তথা দেশের এক ‘নয়া ইতিহাসের শুরুয়াত’ নিয়ে তিনি প্রায় বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে কী বলেছেন। জনতার কাছে চেয়ে ছেন-স্বচ্ছতা, সৃজনশীলতা আর আত্মনির্ভর ভারত গড়ার প্রচেষ্টা (সত্যিই কি চেয়েছেন? এই শব্দবন্ধগুলো তো মোদী জমানায় ক্রমবিলীয়মান!)। কিন্তু গোটা নগর ছিল নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তায় ঘেরা। মাছিটি গলার জো ছিল না। কোটি কোটি টাকার এই রাজসূয় যজ্ঞস্থলে আমজনতার প্রবেশ ছিল নিষিদ্ধ। বিশাল বিশাল জায়েন্ট স্ক্রিনে অবশ্য দেখার ব্যবস্থা ছিল। মোদী গর্বভরে বলেছেন তামাম দুনিয়া এক নয়া ইতিহাস শুরুর সাক্ষী রইলো।

হ্যাঁ সাক্ষী থাকলো বৈ কি — আরও একবার — ধর্মনিরপেক্ষ, বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের এক রাষ্ট্রপ্রধান কী নির্লজ্জ দম্ভে, স্পর্ধায় সংবিধানকে দু’পায়ে মাড়িয়ে গেলেন, একটা ক্রমবর্ধমান অসাম্যের দেশে এক রাজ্যের ভোটপ্রচারে সরকারি কোষাগারের টাকা অর্থাৎ আম জনতার টাকা কীভাবে জলের মতো অপচয়িত হল! সাক্ষী থাকলো — আরও একবার — হাজার হাজার বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্যকে নস্যাৎ করে আরএসএস-বিজেপি তথা মোদীর নিজেকে ‘নতুন ইতিহাসস্রষ্টা’ দাবি করার অপরিসীম মূঢ়তা ও অর্বাচীনত্বের!

কাশী বা বারাণসী পৃথিবীর প্রাচীনতম নগরগুলির একটি যাকে একসময় বলা হত দেশের ‘আধ্যাত্মিকতা ও সংস্কৃতির রাজধানী’। প্রাচীন বাণিজ্য নগরীও বটে — এখানকার রেশম ও মসলিন, হাতির দাঁতের কারুকার্য জগদ্বিখ্যাত। বহু গায়ক, বাদক, শিল্পী, সাহিত্যিক, বিভিন্ন ধর্মের প্রচারকদের জন্ম, কর্ম বা বাসে, সুপ্রাচীন বিদেশি জ্ঞানপিপাসু পর্যটকদের পদপাতে ধন্য এই নগর। ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অপূর্ব মেলবন্ধনের এই নগরের অন্যতম আকর্ষণ বিশ্বনাথ মন্দির সহ আরও বেশ কিছু মন্দির, যার জন্য একে ‘মন্দির নগরী’ও বলা হয়। হিন্দুদের বিশ্বাস ‘শিবভূমি’ পবিত্র এই জনপদে নাকি ‘মোক্ষলাভ’ হয়! তা তিনি কোন ‘মোক্ষ’ লাভের জন্য এখানে এসেছিলেন?

গত ২০১৯ এর ৫ আগস্ট অযোধ্যার বিতর্কিত স্থলে রাম মন্দিরের শিলান্যাস করে তিনি অবলীলায় বলেছিলেন সেই দিনটি নাকি ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা দিবস’! এবার হিন্দুদের ধর্মীয় আবেগের কেন্দ্রভূমি কাশীর বিশ্বনাথ মন্দির-চত্বরের সম্প্রসারণ ঘটিয়ে তিনি দাবি করলেন ভারতীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির (পড়ুন আরএসএস-এর মতাদর্শ ও সংস্কৃতির) ‘এক নতুন ইতিহাসের’ সূচনা হল! অর্থাৎ হিন্দু তীর্থপর্যটন ভূমির দখলদারি গেল হিন্দুত্ববাদী আরএসএস-এর হাতে! তৈরি হল তাদের পরিকল্পিত ‘হিন্দু রাষ্ট্রের’ আরেকটি সোপান! আগে মন্দির চত্বর ছিল ৩০০০ বর্গফুট জুড়ে। এখন প্রস্তাবিত মন্দির কমপ্লেক্সের আয়তন পাঁচ লক্ষ বর্গফুট যার প্রথম পর্যায়ের নির্মাণের উদ্বোধন করলেন তিনি হিন্দুত্বের ‘পোস্টার বয়’ যোগী আদিত্যনাথকে পাশে নিয়ে। এই সম্প্রসারণে যে কত বাড়ি ও দোকান ভাঙা পড়েছে, কত মানুষ উৎখাত হয়েছে তা সহজেই অনুমেয়। প্রাচীন জ্ঞানবাপী মসজিদকে কোণঠাসা করে উঠেছে নবনির্মাণের সুউচ্চ প্রাচীর। এটা তাদের পরিকল্পিত উদ্যোগেরই অংশ।

কিন্তু ঠিক এই মুহূর্তে এই ‘উদ্বোধন’ কেন? তার উত্তর কাশীবাসী এক পাঁচ বছরের শিশুও দিয়ে দেবে। ভোট বড় বালাই! উত্তর প্রদেশের বিধানসভা ভোটের সমীক্ষা মোটেই আশাব্যঞ্জক নয় বিজেপি’র পক্ষে। কেন? কৃষক আন্দোলন! যে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষকে হাতিয়ার করে গত নির্বাচনে বিজেপি জিতেছিল, কৃষক আন্দোলন তার বাড়া ভাতে ছাই দিয়েছে। বিজেপিরই ভুল চালে (কৃষক আন্দোলনে হামলা চালানো) পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের কৃষক, যারা তখনও আন্দোলনে যোগদানে দ্বিধান্বিত ছিল, তারাও এসে আন্দোলনের পাশে দাঁড়ালো। আর মুজাফ্ফর নগরের কৃষক মহাপঞ্চায়েতে ধ্বনি উঠল-হর হর মহাদেব, আল্লাহ্ আকবর! কৃষকদের অদম্য জেদ, অনন্য লড়াকু চেতনা সঞ্চারিত হল মহাপঞ্চায়েতে আগত সমাজের সর্বস্তরের মানুষের মনে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক দুর্ভেদ্য দুর্গ গড়ার অঙ্গীকার নিয়ে তারা ফিরলেন। আর কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের হাজারো অত্যাচার আক্রমণ কুৎসিত গালিগালাজ, দেশদ্রোহিতার জঘন্য মিথ্যা অপবাদ, শীত গ্রীষ্ম বর্ষায় প্রকৃতির রুদ্ররোষ, কোভিড-এর আতঙ্ক-সবকিছুর মধ্যে তিন কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে অনড় কৃষক সত্যাগ্রহ আজ বিশ্ব রাজনীতির চর্চার বিষয় হয়ে বিশ্ব ইতিহাসে ঠাঁই করে নিয়েছে। শেষ পর্যন্ত অন্নদাতাদের অনন্য দৃঢ়তা, দুর্জয় প্রতিরোধের কাছে কেন্দ্রীয় সরকারের হার মানা ও কৃষি আইন বাতিল করা — আম জনতার আত্মবিশ্বাসকে তুঙ্গে নিয়ে গেছে আর বিজেপি তথা মোদী সরকারের দম্ভ আর স্পর্ধাকে চূর্ণ বিচূর্ণ করেছে।

এই পরিস্থিতিতে ড্যামেজ কন্ট্রোলের জন্যে বিজেপি-কে কড়া হিন্দুত্বের তাস খেলতেই হবে শেষ ভরসা হিসেবে। আহত হিন্দুত্বের প্রতিনিধি মোদী নেমে পড়লেন হিন্দু ভাবাবেগকে উস্কে তুলতে। এই ঠাণ্ডায় ডুব দিলেন গঙ্গায়। ষোড়শোপচারে রাজসিক আড়ম্বরে পুজো করলেন বিগ্রহের! কিন্তু দেশের মানুষকে কি এত সহজেই ধোঁকা দিতে পারবেন-এই সংকীর্ণ, চূড়ান্ত স্বার্থান্বেষী, আগ্রাসী মনোভাব নিয়ে! নিছক অভিনয় দিয়ে! ভারতীয় সংস্কৃতি বহুত্ববাদের সংস্কৃতি। ‘দখলের’ মানসিকতা নিয়ে, বিদ্বেষের সওয়ার হয়ে কি তার পৃথিবীব্যাপ্ত ঐতিহ্য মুছে দেওয়া যাবে? মনে তো হয় না!

ভারতবর্ষের মানুষ মনে রেখেছে — যে মোদী নিজের সংসদীয় ক্ষেত্র বারাণসীতে হিন্দুত্বের প্রচারে গোটা একটা দিন কাটিয়ে দিলেন তিনি লখিমপুর খেরিতে তারই মন্ত্রীসভার সদস্যের প্ররোচনায় গাড়িতে পিষ্ট কৃষকদের সাথী ও পরিবারকে সমবেদনা জানাতে যাওয়া দূরে থাক (তখন তিনি লখনউয়ে ছিলেন) বার্তা পাঠাতে একটি সেকেন্ডও ব্যয় করেননি। কৃষক আন্দোলনের সাতশো শহীদের প্রতি শোক জানিয়ে একটা শব্দও উচ্চারণ করেননি! সব মানুষ মনে রেখেছে!

হ্যাঁ কৃষক আন্দোলনের ‘মহড়ার’ শিক্ষা ও প্রেরণা (কৃষক নেতা রাকেশ টিকায়েতের কথা ধার করে) এতটাই সংক্রামক যে তা ভারতের প্রতিটি কোণে ছড়িয়ে গেছে। তাই উত্তর পূর্ব কোণের নাগাল্যান্ডের ওটিং গ্রামের শোক সন্তপ্ত মানুষ অন্ত্যেষ্টির জন্য সরকারের দেওয়া প্রায় কুড়ি লাখ টাকা মুখের ওপর ফেরত দিতে পারেন ‘আফস্পা’ প্রত্যাহারের দাবিতে! যে আফস্পা অযথা প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল কাজ শেষে ঘরে ফেরার পথে ১৪ জন খনি শ্রমিকের। তাই ‘হিন্দুত্বে’ চিঁড়ে ভিজবে না — এটা নিশ্চিত! মানুষ সব মনে রেখেছে!

- জয়ন্তী দাশগুপ্ত

খণ্ড-28
সংখ্যা-44