প্রতিবেদন
যাত্রা কর যাত্রী দল এসেছে আদেশ বন্দরের কাল হল শেষ
Travel passenger group

— রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

সেই ১৯৫০ সাল, যেদিন আমার দাদু গোয়াল ভরা গরু, গোলা ভরা ধান, দীঘি ভরা মাছ, সবজি ভরা ক্ষেত, জোনাকি ভরা বাঁশ ঝাড়, উঠান ভরা পূর্ণিমা, আর — আর তাঁর প্রিয়তম গোবিন্দ, শুধু এই গোবিন্দ মাত্র বুকে বেঁধে নিয়ে চিরদিনের মতো তার চৌদ্দ পুরুষের অস্তিত্ব বিসর্জন দিয়ে “হিন্দুস্তান” নামক ভূ-খন্ডে উদ্বাস্তু হয়েছিলেন তখন তার টানটান শিরদাঁড়া কি হাঁটুতে নেমে গিয়েছিল? তিনি গোবিন্দ প্রাণ মানুষ। তিনি রোদনের লোক নন। কিন্তু আমার বুকে আজও রোদন সমুদ্রের ঢেউ। আমার কলিজার কান্না শতাব্দী ছুঁই ছুঁই। এখন আর রোদন নয়, জ্বলন।

অমিত শাহ বলছেন, এই তো, এই জন্যেই তো আমরা ‘সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন আনছি’ যাতে আর কারো জীবনে এরকম না ঘটে।

আমাদের এমনধারা বংশানুক্রমিক সর্বনাশ হল কোন মহামারিতে? সে এক বিষাক্ত বীজ আর এস এস। হিন্দু মহাসভা, শ্যামাপ্রসাদ — এদের প্রসাদ উদ্বাস্তুরা মহা আশ্বাসে খেল। আর ভারত, ভারতবর্ষ রইল না। হল হিন্দুস্তান। ধর্মান্তরি হওয়ার চাইতে দেশান্তরী হওয়া বেছে নিয়ে আমাদের পূর্বজরা কি পেলেন আর কি দিলেন দেখি। ধর্মাবেগের এই বিবেচনাহীন কাজের পরিণামে আমরা আমাদের প্রজন্মকেও অশেষ দুর্গতির মধ্যে টেনে নামাচ্ছি। চূড়ান্ত অনিশ্চয়তায় আমাদের তরুণ যুবকেরা তাড়িত হচ্ছে। স্বচ্ছ জীবন যাপন করতে পারছে।

বারো তেরো সদস্যের ভার নিয়ে আমার দাদু কোথায় কার কাঁধে ভর দিলেন? শ্যামাপ্রসাদের বাড়ীতে? ভর দিলেন লোকে গিজগিজ করা রিফিউজি ক্যাম্পের গহ্বরে। ভারত আর পাকিস্তানের সমস্ত বর্ডার এরিয়া জানে কী নারকীয় দিন তারা কাটিয়েছে। আর মাত্র একটি ছবি দেবো।

শিলচরে বারো ঘর এক উঠোনের একটা ঘরে মাস কয়েক বাস করার সুবাদে এক উদ্বাস্তু মহিলার কাহিনী শুনেছিলাম, সে কাহিনী যেমন মর্মান্তিক তেমনি বলা এত বছর বাদেও কঠিন। অথচ অমিত শাহরা বাধ্য করছেন আমার শোনা এক মর্মগাথা আবার শোনাতে। সে যেমন মর্মান্তিক, তেমনই করুণ। আমাদের জীবনে আর কোনো গোপন কথা রইল না। এই সরকার আমাদের একেবারে উলঙ্গ করে মুখটি চেপে দিতে চাইছে। দিলীপ ঘোষ বলছেন যাদের জন্মের ঠিক নেই তারাই কাগজ দেখাতে চাইছে না।

শিলচরের সেই বারো ঘরের একটি ঘরে একটি ন’মাসের বাচ্চা রাতভর কেঁদেই চললছে। মায়ের বুকে একফোঁটা দুধ নেই। দুধ না থাকা মায়ের বুকে বিশ্বের ক্ষুধা। হা করা মুখে ঢোক গিলবার রসটুকুও নেই। কোনো প্রতিবেশী একটুখানি বার্লি যোগাড় করে এনে দিয়েছেন বাচ্চার কান্নায় অতিষ্ঠ হয়ে। ছ্যাঁচড়াতে ছ্যাঁচড়াতে উঠে সন্তানটিকে খাওয়াবেন — মহিলার জবানীতে “জানো গো মা, সেই বার্লি খাওয়াতে বাটিটা মেয়েটার মুখে ধরেছি তো বাটি আমার মুখে উঠে এলো, এক চুমুকে সেটা আমি নিঃশেষ করে দিলাম”।

কী অমিত শাহ, দিলীপ ঘোষ এই তো আপনাদের হিন্দুস্তান না?

সে মায়েরই আরও এক ন'বছরের বালিকা ছিল। রিলিফ ক্যাম্প থেকে ঘরের কেউ কেউ দেওর সেজে সে-ঘরে আসতেন। উদ্বাস্তুকে সাহায্য করা হিন্দুস্তানের নৈতিক কর্তব্য কিনা। প্রতি সন্ধ্যায় একবার করে এসে বৌদিকে ভালোমন্দ শুধান, মেয়েটাকেও একটু আদরটাদর করেন। বাচ্চা তো। মহিলার জবানীতে — “রান্না করতে করতে আমি দেখি নীতুকে চাদরে ঢেকে কোলে তুলে নেয়। চাদর নড়াচড়া করে। মাথায় আমার আগুন জ্বলে। কিন্তু চুপ করে যাই, নইলে যে আবার বাচ্চার বার্লি খেয়ে নেব।”

কত হাততালি পেয়েছেন অমিত শাহ বাবা? এক কোটি ত্রিশ? ন'বছরের মেয়ে এখন বুড়ি। ডেকে এনে সাক্ষী দেওয়াবো? তদন্ত কমিটি গড়বেন? সে অনেক হ্যাপা, তার চেয়ে গুলি চালানো নিরাপদ। জনসংখ্যাও কমে। গৌরী লঙ্কেশ।

আমার শিলচরের সেই মা বেঁচে নেই। আমি তাঁর বস্ত্র হরণ করলাম। তাঁকে উলঙ্গ করে দিলাম। আমার পাপের সীমা নেই। ক্ষমাও হয় না। সেই তিনিই শেখালেন —

রাজা তোর কাপড় কোথায়?

- প্রতিমা ভট্টাচার্য
(লেখিকা দীর্ঘজীবন কাটিয়েছেন আসামে, অধুনা অবসরপ্রাপ্ত, শেয়ার করতে চেয়েছেন নিজের অনুভব, উপলব্ধি)

খণ্ড-28
সংখ্যা-43