পরিবহন শিল্পে সকল ছাঁটাই কর্মীকে পুনর্বহালের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হোন
transport industry

পশ্চিমবাংলায় গত বিধানসভা ভোটের আগে ভোট পাওয়ার জন্য শাসক দলের পক্ষ থেকে পরিবহন সংস্থাগুলিতে প্রচার করা হয়েছিল —

(১) যে সকল পরিবহন কর্মী ডব্লিউবিটিসি-র অধীনে বিভিন্ন সংস্থায় (সিটিসি, সিএসটিসি, ডব্লিউবিএসটিসি) এবং এনবিএসটিসি, এসবিএসটিসি সংস্থাগুলিতে সরাসরি দীর্ঘদিন ধরে সরাসরি কন্ট্রাক্ট কর্মী হিসাবে কাজ করে এসেছেন এবার তাঁদের স্থায়ীকরণ করা হবে।

(২) যে সকল কর্মীরা অস্থায়ী বা এজেন্সির মাধ্যমে কাজ করে আসছেন তাঁদের কোম্পানির অধীনে সরাসরি কন্ট্রাক্ট কর্মী করা হবে এবং পরবর্তীকালে তাঁদেরকেও ধাপে ধাপে পার্মানেন্ট করে নেওয়া হবে।

(৩) মৃত কর্মীদের পরিবারের সদস্যদের চাকরি দেওয়া হবে।

(৪) কর্মীরা দলের হয়ে কাজ করলে এবং দলকে ভোট দিলে বাড়ির কাছের ডিপোতে ডিউটি দেওয়া হবে। ভালো রুট, ভালো গাড়ি দেওয়া হবে।

(৫) স্থায়ী কর্মীদের বেতন, ওভার টাইম, ইনসেন্টিভের পয়সা বাড়িয়ে দেওয়া হবে। কাজের বোঝা কমিয়ে দেওয়া হবে। ইত্যাদি ইত্যাদি।

স্বাভাবিকভাবেই কর্মীরা তখন সামনে পিছনে কোনো কিছুই ভাবতে চাননি। বামফ্রন্ট আমলে ১৫-২০ বছর ধরে ক্যাজুয়াল থাকার পর এআইসিসিটিইউ-র নেতৃত্বে ২০০৮-২০০৯ সালে বীরত্বপূর্ণ লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে ১০২৫ জন কর্মীর পার্মানেন্ট হওয়ার ইতিহাস মনে রাখেননি। সেই আমলে ‘চেকিং’এর নামে ড্রাইভার-কন্ডাক্টরদের রাজপথে, চলন্ত বাসে উলঙ্গ করে মর্যাদাহানী করার জঘন্য কর্মকাণ্ড বন্ধ করে দিতে পারা-কর্মীদের হিম্মতের ইতিহাস ভুলে গেলেন।

তৃণমূল আমলে দু’বার ডিপোগুলোকে স্তব্ধ করে, পরিবহন ভবন অভিযান চালিয়ে ম্যানেজমেন্টকে প্রতিটি কর্মীর ২০০০ টাকা বেতন বৃদ্ধি করতে এবং এজেন্সি কর্মীদেরও বোনাসের অনুদান হিসাবে সেই প্রথমবার ১৬০০ টাকা চালু করতে বাধ্য করার নজীরও ভুলে গেলেন। বিশ্বাস করলেন এবার বুঝি নরক যন্ত্রণা থেকে তাঁরা মুক্তি পাবেন।

দীর্ঘ ৮ মাস হয়ে গেল ভোট হয়ে গেছে। কোনো প্রতিশ্রুতিই কার্যকরি করা হয়নি। উপরন্তু, শুরু হয়েছে কর্মীদের বিভিন্ন অজুহাতে কাজ থেকে বেআইনিভাবে ছাঁটাই অভিযান। ইতিমধ্যে ডব্লিউবিটিসি তার সবকটি সংস্থায় ব্যাপক মাত্রায় কর্মী ছাঁটাই শুরু করেছে। যদিও বেশ কয়েক বছর ধরেই বিভিন্ন সংস্থায় বিভিন্ন অজুহাতে ছাঁটাই চলে আসছে। এমনকি রাজ্য শ্রম দপ্তর কর্তৃক ম্যানেজমেন্টের বেআইনি ছাঁটাই বিরোধী ত্রিপাক্ষিক চুক্তিও (সিটিসি-র ১৪ জন কর্মীকে ফিরিয়ে নেওয়া) ডব্লিউবিটিসি ম্যানেজমেন্ট অমান্য করছে।

ভয়ঙ্কর এক আক্রমণের মুখে আজ শত শত পরিবহন কর্মী। এসবিএসটিসি থেকে ৮৯ জন কর্মীকে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। সিটিসি, সিএসটিসি, ভুতল সংস্থাগুলি থেকে ইতিমধ্যেই শতাধিক কর্মীকে ছাঁটাই করা হয়েছে। শোনা যাচ্ছে সংখ্যাটা দ্রুতই প্রায় চার শতাধিকে পৌঁছাতে পারে। বেশ কিছু বছর আগে থেকেই ৮০, ৮১, ৬০, ৬১-র লট (ব্যাচ্ নাম্বার) সহ সহস্রাধিক কর্মীকে নিয়োগ করা হয়েছে। এই শিল্পে সহস্রাধিক স্থায়ীপদ শূন্য থাকা সত্ত্বেও এইসব কর্মীদের কন্ট্রাক্ট, অস্থায়ী বা এজেন্সি কর্মী হিসাবে নিয়োগ করে বছরের পর বছর স্থায়ী শ্রমিকদের মতো সমকাজ করালেও সম মজুরি দেওয়া হচ্ছে না। যা শ্রম আইন বিরুদ্ধ। আর যেসব এজেন্সি রাতারাতি গজিয়ে উঠেছে তাদের মালিকরা শাসকদলের কোন না কোনো নেতা বা প্রশাসনিক আমলার আত্মীয়স্বজন। এমনকি পরিবহন সংস্থাগুলির সাথে এদের চুক্তির বৈধতা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। আবার অপরদিকে এটা প্রমান করা কঠিন হলেও কান পাতলেই শোনা যায় (প্রাক্তন পরিবহনমন্ত্রীর আমলে) — এইসব নিয়োগের ক্ষেত্রে বেকার যুবকদের কাছ থেকে শাসকদলের এবং ম্যানেজমেন্টের এক অংশের নেতা কর্মকর্তারা সরকারি চাকরি পাইয়ে দেওয়ার নামে ১০ হাজার টাকা থেকে ১ লক্ষ টাকা পর্যন্ত আদায় করেছে। ঐ সকল কর্মীদের অনেকেই পূর্ব মেদিনীপুর জেলার গরিব ঘরের। আরো অমানবিক বিষয় হল, করোনা মহামারীর সময়কালে যেসব শত শত কর্মীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পরিবারকে নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে রেখে পরিবহন পরিষেবাকে সচল রেখেছিলেন আজ তাঁদের এক লহমায় অস্বীকার করে ডিপোর গেটের বাইরে বের করে দেওয়া হচ্ছে।

কেন্দ্রীয় সরকারের মতো রাজ্য সরকারও পরিবহন শিল্পকে আজ বেসরকারিকরণ করার পথেই হাঁটছে। এই পন্থা এই রাজ্যে প্রথম শুরু হয়েছিল বামফ্রন্ট আমল থেকেই (রুট, বাস ফ্রানঞ্চাইজের মাধ্যমে)। আজ তা আরো প্রকট আকার ধারণ করেছে — কন্ট্রাক্ট, এজেন্সির মাধ্যমে কর্মী নিয়োগ, শহরের প্রাইম এলাকার শত শত একর সরকারি জমি, বাস রুট তথাকথিত লিজের নামে ব্যক্তি বা কর্পোরেট সংস্থার কাছে জলের দরে (এ ক্ষেত্রেও চরম আর্থিক দুর্নীতির বিষয়টা শোনা যায়) বেচে দেওয়া হচ্ছে। লিজ বা বেচে দেওয়া সম্পদের কয়েকশো কোটি টাকা পরিবহন শিল্পের পুনরুজ্জীবনের জন্য খরচ করা হয়নি, সে টাকা কোথায় তার হদিস ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে। শ্রমিক সমবায়ের কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি নিয়ে ধূমায়িত হচ্ছে গণক্ষোভ। চর্চা চলছে পুকুর না সাগর চুরি!

ইতিমধ্যেই ছাঁটাই কর্মী ও অবসরপ্রাপ্ত কর্মীরা পরিবহন দপ্তরের গেটে বেআইনি ছাঁটাই ও নিয়মিত সঙ্গত পেনশনের দাবিতে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে পরিবহন শিল্পের সমস্ত ধরনের কর্মীদের ঐক্যবদ্ধ হতেই হবে। সরকারের ষড়যন্ত্রমূলক পরিকল্পনা এবং স্বৈরাচারী, অসৎ, দুর্নীতিগ্রস্ত ম্যানেজমেন্টের কর্মকাণ্ড আজ রাজ্য পরিবহন শিল্পকে ধ্বংসের মুখে এনে দাঁড় করিয়েছে। “এখন ওদেরকে ছাঁটাই করছে, আমাকে বা আমাদেরকে তো করছে না” — এই মনোভাব পরিবহন কর্মীদের ত্যাগ করতে হবে। আগামীদিনে কেউই সুরক্ষিত থাকবেন না। তাই, শিল্প এবং শ্রমিক স্বার্থে দলমত নির্বিশেষে এই শিল্পের সকল কর্মী এবং ইউনিয়নগুলিকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এর মোকাবিলা করতে হবে। সতর্ক থাকতে হবে ইউনিয়নগুলির মধ্যে সংঘর্ষ, গোষ্ঠী দ্বন্দ্ব এবং শ্রমিকে শ্রমিকে বিভেদের সমস্ত ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে — যা পরিণামে শ্রমিক বিরোধী ম্যানেজমেন্টের হাতকেই শক্তিশালী করবে।

তাই, আওয়াজ তুলতে হবে —

(১) করোনা মহামারী সময়কালে যে সকল কর্মী জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাজ্যের পরিবহন শিল্পকে সচল রেখেছিলেন তাঁদের ছাঁটাই করা চলবে না। ছাঁটাই প্রত্যাহার করে অবিলম্বে কাজে ফিরিয়ে নিতে হবে। (২) রাজ্য শ্রম দপ্তর কর্তৃক ম্যানেজমেন্টের বেআইনি ছাঁটাই বিরোধী ত্রিপাক্ষিক চুক্তিকে কার্যকরি করে অবিলম্বে ১৪ জনকে কাজে ফিরিয়ে নিতে হবে এবং বকেয়া বেতন দিতে হবে। (৩) পরিবহন শিল্পের শূন্য পদে সকল কন্ট্রাক্ট, অস্থায়ী ও এজেন্সি কর্মীদের স্থায়ী করতে হবে। (৪) শ্রমিক কো-অপারেটিভে গচ্ছিত লক্ষ লক্ষ টাকা আত্মসাৎ করা চলবে না। অবিলম্বে শ্রমিকদের টাকা ফেরত দিতে হবে। (৫) মৃত কর্মীর পরিবারের একজন সদস্যকে অবিলম্বে চাকরিতে নিয়োগ করতে হবে। (৬) বেআইনি ট্রান্সফার বন্ধ করতে হবে। বাড়ীর কাছের ডিপোতে কাজ দিতে হবে। (৭) সরকারি নির্দেশ মতো কর্মীদের ৪৫০০ টাকা বোনাস দিতে হবে। (৮) সম কাজে সম মজুরি দিতে হবে। (৯) পরিবহন শিল্পকে বাঁচাতে স্বৈরাচারী, অসৎ ও দুর্নীতিগ্রস্ত ম্যানেজমেন্টকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। (১০) সরকারি পরিবহন শিল্পকে বেসরকারিকরণ করা চলবে না। (১১) স্থায়ী পদ শূন্য থাকতে কন্ট্রাক্ট, অস্থায়ী ও এজেন্সির মাধ্যমে নিয়োগ বন্ধ করে সরাসরি স্থায়ী পদে নিয়োগ করতে হবে। সকল কন্ট্রাক্ট, অস্থায়ী ও এজেন্সি কর্মীদের স্থায়ীকরণ করতে হবে।

এআইসিসিটিইউ অন্তর্ভুক্ত সিটিসি-বিডিকেএস, সিএসটিসি-এসএসকেইউ, এডব্লিউবিএসটিসি-এসএসকেইউ ইউনিয়নগুলির পক্ষ থেকে সরকারের বেসরকারিকরণের পরিকল্পনা এবং কর্তৃপক্ষ কর্তৃক বেআইনি ছাঁটাইয়ের তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। আগামীদিনে বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তুলতে ডিপোয় ডিপোয় লিফলেটিং, পোস্টারিং শুরু হয়েছে। এআইসিসিটিইউ মনে করে কর্মীদের এবং ইউনিয়নগুলির ব্যাপক ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনই পারে রাজ্যের পরিবহন শিল্পকে বাঁচাতে এবং শ্রমিক কর্মচারীদের উপর নেমে আসা আক্রমনকে প্রতিহত করতে।

- দিবাকর ভট্টাচার্য

খণ্ড-28
সংখ্যা-43