প্রতিবেদন
এ কী প্রহসন!
What a farce

ভারতের নারীসমাজ চায় স্বাধীনতা মর্যাদা সমানাধিকার। চায় স্বাধিকার, ক্ষমতায়ন। তারজন্য প্রয়োজন নারীশিক্ষার হার বাড়ানো, প্রয়োজন সামাজিক, শিক্ষাগত ও আর্থিকভাবে মহিলাদের আত্মনির্ভর করে তোলা; প্রয়োজন নির্ভয় স্বাধীনতা; নিজের শরীর, মন ও মননের উপর নিজের নিরঙ্কুশ অধিকার, অন্যের দখলদারি নয়। প্রয়োজন সামাজিক উন্নয়ন তথা সামগ্রিক অর্থনৈতিক বিকাশ। সেসব প্রশ্নকে বিশবাঁও জলের তলায় ফেলে রেখে হঠাৎ মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স ১৮ থেকে বাড়িয়ে ২১ বছর করা হচ্ছে। এই সিদ্ধান্ত কতটা যুক্তিযুক্ত? আসুন খতিয়ে দেখা যাক।

প্রথমে দেশের শিক্ষার হাল হকিকত দেখা যাক। অ্যান্যুয়াল স্টেটাস অব এডুকেশন রিপোর্ট অনুযায়ী দেশের ৩৫ শতাংশ পড়ুয়ার বাড়িতে মোবাইল নেই। অনলাইন শিক্ষার দরুণ দেশের মাত্র ৩৬.২ শতাংশ পড়ুয়ার কাছে পৌঁছানো গেছে স্টাডি মেটিরিয়াল। অনলাইন পড়াশুনার অবস্থা তথৈবচ। বেড়েছে স্কুলছুটের সংখ্যা। যেখানে মেয়েদের ‘পরিবারের বোঝা’ হিসেবে ভাবা হয়, কন্যাভ্রূণ হত্যা করা হয় সেখানে এই পরিস্থিতিতে সবথেকে বেশি স্কুলছুট হবে মেয়েরাই। আর তাদের ঘাড় থেকে নামানোর জন্য দিয়ে দেওয়া হবে বিয়ে। কেন্দ্রীয় সরকারের ‘বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও’ প্রকল্প সম্পর্কে সরকারি তরফে ধুমধাম করে ঘোষণা করা হয়েছিল যে কন্যাভ্রূণ হত্যা ও লিঙ্গবৈষম্যের বিরুদ্ধে কাজ করবে এই প্রকল্প। কিন্তু কাজ করা তো দূরের কথা, সম্প্রতি প্রকাশিত সংসদীয় কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী এই প্রকল্পের ৮০ শতাংশ বরাদ্দই খরচ হয়েছে বিজ্ঞাপনে। ভাবুন একবার!

সরকারি ও সরকার পোষিত স্কুলগুলিতে পড়ুয়াদের স্কুলে আনা ও যথাযথ পুষ্টিবিধানের জন্য মিড-ডে-মিল প্রকল্পের সূচনা হয়েছিল। মেয়েদের ক্ষেত্রে বাড়িতে সবসময়ই শেষে যেটুকু খাবার বেঁচে থাকে সেটুকুই জোটে। স্বাস্থ্য এবং পুষ্টির ক্ষেত্রে মেয়েরা সবসময়েই পরিবারে সবচেয়ে অবহেলিত। কোভিডকালে স্কুল বন্ধ। গৃহবন্দী সব বয়সী মেয়েদের উপর অস্বাভাবিক হারে বেড়েছিল নির্যাতন।

অন্যদিকে জিনিসপত্রের দাম আকাশ ছুঁলেও বাড়েনি মিড-ডে-মিলের বাজেট। ফলে একে একে তালিকা থেকে বাদ পড়েছে ডিম, সয়াবিন ইত্যাদি। ২০০৪ থেকে ২০১৪-১৫ অর্থবর্ষ পর্যন্ত প্রতি বছর কেন্দ্রীয় সরকার মিড-ডে-মিল খাতে সাত শতাংশ হারে বরাদ্দ বাড়িয়েছে। ২০১৫-১৬ আর্থিক বছরে সামান্য বরাদ্দ বৃদ্ধির পরে আর তা বাড়েনি, উল্টে রেকর্ড হারে কমানো হয়েছে। আগে পড়ুয়া পিছু যেখানে বরাদ্দ ছিল ১৪৯ টাকা, এবছর সেপ্টেম্বরে সেই বরাদ্দ দাঁড়ায় ৭৮ টাকায়। বাংলাদেশের মতো ছোট দেশে যখন শিক্ষায় প্রায় ৬৪,০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ থাকে বাজেটে, সেখানে ভারতের মতো দেশে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ গত বাজেটের ৯৯,৩১২ কোটি টাকা থেকে ৬,০৮৪ কোটি টাকা কমিয়ে ৯৩,২২৪ কোটি টাকায় নিয়ে আসা হয়েছে। আরও বুজরুকি চলছে আইসিডিএস’এ। এই সামাজিক উন্নয়ন প্রকল্পটি মূলত শিশু ও প্রসূতি মায়েদের জন্য সার্বিক পুষ্টি, স্বাস্থ্য ও মহিলাদের আত্মনির্ভরতার কথা মাথায় রেখে চালু হয়েছিল। সেই ক্ষেত্রেও ক্রমাগত চলছে বরাদ্দ ছাঁটাই। পূর্বে আইসিডিএস ও সহযোগী খাতে বরাদ্দ ছিল ২৮,৫৫৭ কোটি টাকা; তাকে ২০,১০৫ কোটি টাকায় কমিয়ে আনা হয়েছে। সামগ্রিকভাবে নারীদের জন্য নির্দিষ্ট যে বাজেট বরাদ্দ তা গত বছরের বাজেট বরাদ্দ ২৮,৫৬২ কোটি টাকা থেকে কমিয়ে ২৫,২৬০ কোটি টাকা করা হয়েছে। মহিলারা যদি শিক্ষা, পুষ্টি, স্বাস্থ্য থেকে বঞ্চিত হন তাহলে আর্থিক ও সামাজিক দিক থেকে প্রতিষ্ঠিত হবেন কীভাবে, কীভাবে নিজেদের স্বর তুলে ধরবেন, কীভাবে নেবেন নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজেরা? তারা ‘বোঝা’ হিসেবেই চিহ্নিত হবেন বারবার এবং উল্টে বাড়বে আইন ভেঙ্গে লুকিয়ে বিয়ে দেওয়ার প্রবণতা। ১৮ বছর যখন বিয়ের বয়স তখনই আখছার ঘটছে এই ঘটনা। শুধু ২০২০ সালেই ৫০ শতাংশ বেড়েছে বাল্যবিবাহের ঘটনা — বলছে ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর রিপোর্ট।

দ্বিতীয়ত মহিলাদের উপর দিনের পর দিন বেড়েই চলছে অকথ্য নির্যাতন। একজন যুবতী নির্যাতিতা হওয়া মানে ‘তাকে আর বিয়ে করবে না কেউ’ — এই ধারণাই প্রতিষ্ঠিত এই সমাজে। ‘যদি কিছু হয়ে যায়’ এই ভয়ে মেয়েদের স্বাধীন চলাফেরাতেও আছে বেড়ি। সেখানে বোঝা বিদায় করাটাই দস্তুর পরিবারগুলোতে। আছে পণের মতো প্রথা যা এই বোঝাটাকে আরও ভারী করে।

ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর ২০২০ রিপোর্ট অনুযায়ী,

১) প্রতিদিন ভারতে ২৫৮ মহিলা যৌন নির্যাতন ও হেনস্থার শিকার হন।
২) প্রতিদিন ভারতে ৭৭ জন মহিলা ধর্ষণের শিকার হন।
৩) প্রতিদিন ভারতে ৩০৮ জন মহিলা তাদের সঙ্গী ও তার পরিবার দ্বারা নির্যাতিত হন।
৪) প্রতিদিন ভারতে ১৯ জন মহিলা তার সঙ্গী বা তার পরিবার দ্বারা পণজনিত কারণে খুন হন।

কী করেছে দেশের এই অপদার্থ সরকার এইসব সমস্যা সমাধানে? হাজার হাজার মাইল জুড়ে ছড়িয়ে থাকা অন্ধকারাচ্ছন্ন গ্রামগ্রামান্তরে নাবালিকা বিবাহ রুখতে এই আইন আদৌ কৃতকার্য হবে? পারবে কি নিজের মতামত অনুযায়ী কোনো একজন ভারতীয় নারীর অবিবাহিত থেকে জীবন এবং যৌনজীবন উপভোগের সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে? একটি মেয়ের নিজের শরীরের উপর অধিকার, যৌনতা এক্সপ্লোর করার, কনসেন্ট দেওয়ার বয়স কী করে মাপবেন ২১’র মাপকাঠিতে? সেটা ঠিক করে দেওয়ার রাষ্ট্র কে? কিশোর কিশোরীদের যৌন আকাঙ্ক্ষা, এক্সপ্লোরেশন, প্রেম করাকে রক্তচক্ষুর মুখে পড়তে হয় সমাজে। আর প্রেমের ক্ষেত্রে এখন জোর করেই যেখানে ফতোয়া জারি করে আরএসএস-বিজেপি, ভিন্ন ধর্ম বা জাতের কাউকে বিয়ে করলে জোর করে বিয়ে ভাঙা, গর্ভপাত করানো আকছার ঘটে চলেছে দেশে। বিয়ের বয়স ২১ করার আগে মেয়েদের জীবন ও নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নেওয়ার এই দিকগুলো নিয়ে কি কিছু করেছে সরকার? উল্টে খাপ পঞ্চায়েত বাহিনী খুলে রেখেছে হেনস্থা করার জন্য, প্রেম করলে খুন করার জন্য। যার নজির আমরা দেখেছি বিজেপি শাসিত উত্তরপ্রদেশ সহ গোটা দেশেই। পরিবারের সম্মান রক্ষার নামে তো গত ২০১৭ থেকে ২০১৯’র মধ্যে খুনই করা হয়েছে ১৪৫ জন ছেলে-মেয়েকে (ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো)। মনে রাখবেন এগুলো রেজিস্টার্ড কেস। এইসব ক্ষেত্রে বেশিরভাগ কেসই নথিভুক্ত হয় না।

সারা দেশ জুড়ে বাচ্চাদের যৌন শিক্ষা দেওয়া তো দূর বরং সিলেবাস জুড়ে ঢোকানো হচ্ছে পৌরাণিক, ধর্মীয় নানা উপাদান, মেয়েদের আরও শিকলবন্দী করার নানা উপকরণ। আর তার মাঝে, হঠাৎ, কিছুর মধ্যে কিছু নেই, নিয়ে আসা হল এই হঠকারী আইন! মহিলা ক্ষমতায়ন কোনও আইনের ছিপের জোরে অলীক নিয়মে ঘটানো যায় না, তারজন্য প্রয়োজন সামাজিক সংস্কার, সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পগুলো জোরদার করা, অর্থনৈতিক ও সামগ্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। উপরোক্ত প্রক্রিয়া ছাড়া এই হঠকারী সিদ্ধান্তের ফলে একদিকে যেমন নারী নির্যাতন বাড়বে তেমনই এই রকমভাবে দিনের পর দিন আইন ভেঙে, নাবালিকা মেয়েদের জোর করে হস্তান্তরকরণ প্রক্রিয়ার (বিয়ে দেওয়ার) পথই প্রশস্ত হবে, ক্ষমতায়ন নয়!

- সৌমি জানা

খণ্ড-28
সংখ্যা-45