সম্পাদকীয়
নির্বাচনী গণতন্ত্রের এই হাল কেন?
electoral democracy

সম্পন্ন হয়েছে কলকাতা কর্পোরেশন নির্বাচন।

কেন্দ্রে বিরোধী দল, এরাজ্যে শাসকদল এবং কলকাতা কর্পোরেশন পুনরায় ক্ষমতাসীন দল তৃণমূল। কেন্দ্রে শাসক, আর রাজ্যে বিরোধী দল ফ্যাসিবাদী বিজেপি।কেন্দ্র থেকে রাজ্যে বিরোধী দল অবস্থায় বিরাজমান দক্ষিণপন্থী কংগ্রেস। পক্ষান্তরে, বামপন্থীরা এরাজ্যের সর্বস্তরে বিরোধী শক্তি। মূলত এহেন বিন্যাসের পরিস্থিতিতে হল কলকাতার পৌর নির্বাচন।

দীর্ঘ বিলম্বিত কলকাতা কর্পোরেশন নির্বাচনে শাসক দল যে ক্ষমতায় ফের ফিরবে এটা প্রায় সব মহলেই মোটামুটি হিসাব ছিল। কিন্তু যেভাবে পেশীশক্তি ফলিয়ে গরিষ্ঠতার রেকর্ড করতে প্রমত্ত হল সেটা অবাধ নির্বাচন করতে যথেষ্ট শঙ্কায় থাকার প্রমাণ দিল। আধিপত্য কায়েম হয়েছে বটে, কিন্তু এ জয় কলঙ্কমুক্ত নয়। তৃণমূল ফের চলতে শুরু করেছে ২০১৫-র পৌর নির্বাচনের ঘরানাতেই। ক্ষমতার শুধু দখলদার হয়ে থাকলেই চলছে না, প্রতিটি ওয়ার্ড ভিত্তিক নির্বাচনকে পরিণত করতে হবে বিশাল সংখ্যার ব্যবধানে ও বিরোধীশূন্য একচেটিয়া দখলদারিতে। এটাই এখন রাজ্য রাজনীতিতে তৃণমূলের দস্তুর। আর এটা আড়াল করতে একে তৃণমূল চিত্রিত করছে ‘জনগণের উৎসব’। যদি অবাধ নির্বাচন হোত তাহলে নিশ্চিত নাগরিক ক্ষোভ যতটা তার বিরুদ্ধে যাওয়ার তার প্রতিফলন অবশ্যই দেখা যেত। দুর্নীতি-দলতন্ত্র আর চরম দুর্ভোগ, অবহেলা ও গাফিলতির শিকার হওয়া এমন অনেক তিক্ত ইস্যু রয়েছে, যা নিয়ে পুরবাসী জনতার এক উল্লেখযোগ্য অংশের গত বিধানসভা নির্বাচনের সময় তত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেনি, কারণ তখন সামনে ছিল রাজ্য বেদখল হয়ে যাওয়ার সবচেয়ে বড় বিপদ বিজেপি। কিন্তু পৌর নির্বাচনে বিজেপি ছিল না দখলদারের বিপদ ঘনিয়ে নিয়ে আসার অবস্থায়। এই অবস্থায় তৃণমূলকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার বহিঃপ্রকাশ ঘটার সম্ভাবনা ছিল। সেই চাপা অসন্তোষের প্রকাশ দাবিয়ে রাখতেই তৃণমূল ফের সন্ত্রাসের আশ্রয় নিল। এটা করল শাসকের ঔদ্ধত্য থেকে তো বটেই, আরও এই উদ্দেশ্যে যে, বিধানসভা নির্বাচনে আসনসংখ্যায় এবং প্রাপ্ত ভোট শতাংশে যে মাত্রায় তার সাফল্য এসেছে, সাত মাসের ব্যবধানে সেই তুলনায় যাতে অবনমন উন্মোচিত হতে না পারে। এই উদ্দেশ্য হাসিল করার জন্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগে থাকতে লোকদেখানো ‘অনুশাসনের’ কসরৎ প্রদর্শন শুরু করে দেওয়া হয়। আর নির্বাচন চুকে যাওয়ার পর যথারীতি দলনেত্রী ও দল চালানোর ক্ষমতায় উঠে আসা ‘পোস্টার বয়’ মায় পারিষদবর্গ মাতলেন স্বৈর উল্লাসে, বিরোধী মতপ্রকাশের অধিকার প্রসঙ্গে করতে লাগলেন কুৎসিত কদর্য ঠাট্টা, মশকরা, উপহাস। এইভাবে নির্বাচনী গণতন্ত্রকে পরিণত করা হল এক বিচিত্র প্রহসনে।

কলকাতা কর্পোরেশন নির্বাচনে দ্বিতীয় যে পরিঘটনা নজর কেড়েছে তা হল বিজেপি মোটেই হাওয়া তুলতে পারেনি, ব্যর্থই হয়েছে। এটা বিশেষ করে বাম ও গণতান্ত্রিক, উদারনৈতিক ও প্রগতিবাদী ভাবধারার জনমানসের কাছে খুশীর খবর। বিধানসভা নির্বাচনে ধাক্কা খাওয়ার পরে এবার মহানগরের পৌর নির্বাচনে তার ভোট শতাংশ কমেছে বেশ লক্ষ্যণীয় মাত্রায়। এরাজ্যে লোকে এখন ‘বিধানসভায় প্রধান বিরোধীপক্ষ’ হয়ে থাকা কর্পোরেটমুখী সাম্প্রদায়িক দলটিকে প্রত্যক্ষ করছে রোজকার অন্তর্দ্বন্দ্বে জর্জরিত ছন্নছাড়া পায়ের তলায় মাটি সরে যাওয়া, শুকিয়ে যেতে শুরু করেছে। এই পরিণতি যত বেশি হয় ততই ভালো। কিন্তু এটা বিজেপির নিজের পায়ে নিজে কুড়ুল মারার অপেক্ষায় ফেলে রাখলে চলবে না। আপনা আপনি খেয়োখেয়িতে দুর্বল হয়ে শেষ হয়ে যাবে তা ভাবলে চলবে না। কলকাতাই পশ্চিমবঙ্গ নয়, সামনে প্রচুর পৌর নির্বাচন আছে। সেই লড়াইয়ে বিজেপিকে পর্যুদস্ত করার চ্যালেঞ্জ জারি রাখতে হবে।

আর এই লড়াইয়ে সমস্ত দ্বিধাদ্বন্দ্ব হীনমন্যতা ঝেড়ে ফেলে সবচেয়ে সৎ নীতিনিষ্ঠ কার্যকরি বুদ্ধিদীপ্ত প্রত্যয়ী ভূমিকায় নামতে হবে বামপন্থীদের। কলকাতা পৌর নির্বাচনে বিজেপির ভোট শতাংশ কমা আর বামেদের ভোট শতাংশ কিছুটা পুনরুদ্ধার হওয়া, বিজেপিকে পিছনে ফেলে বামেদের উঠে আসা — এই আঁকবাঁক মোড় পরিবর্তন অবশ্যই স্বাগত জানানোর। কিন্তু এ থেকে এখনই ধরে নেওয়া সঙ্গত হবেনা যে, বিজেপির শেষের, আর বিপরীতে বামেদের ঘুরে দাঁড়ানো শুরু হয়ে গেছে। বরং এই পরস্পর বিপরীত প্রবাহকে লাগাতার ত্বরান্বিত করতে মানুষের সাথে থেকে জনমনে আস্থা অর্জনের অগ্নিপরীক্ষা দিয়ে চলতে হবে। সেটা সম্ভব রাস্তায় থাকতে পারলে। নাগরিক জীবনের ইস্যু নিয়ে, জাতীয় ও রাজ্য রাজনীতি নিয়ে।

খণ্ড-28
সংখ্যা-45