ভোটমুখী পাঞ্জাবে প্রথম নির্বাচনী প্রচারেই বিশাল ধাক্কা! কৃষক বিক্ষোভ প্রধানমন্ত্রীর হাই প্রোফাইল কনভয়কে শুধু আটকেই দিল না, মাঝরাস্তা থেকে ফিরিয়েও দিল!
তাই নিয়ে তরজা শেষ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্ট অবধি গড়িয়েছে। এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকারের আচরণে বিরক্ত শীর্ষ আদালতকে তদন্ত কমিটি পর্যন্ত গড়ে দিতে হয়েছে এবং কেন্দ্র-রাজ্য উভয়কেই প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তায় গাফিলতি সংক্রান্ত তদন্ত থেকে আপাতত নিরস্ত থাকার নির্দেশ দিতে হয়েছে।
কিন্তু সেদিন প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং যে আচরণ এবং মন্তব্য করলেন তা অত্যাশ্চর্য (তবে অপ্রত্যাশিত নয়)! কৃষকরা বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অজয় মিশ্র টেনির অপসারণ ও গ্রেপ্তারের দাবিতে, আন্দোলনকারী কৃষকদের বিরুদ্ধে অন্যায়ভাবে রুজু করা মিথ্যা অভিযোগ প্রত্যাহারের দাবিতে, শস্যের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের আইনি গ্যারান্টির দাবিতে। কিছু মানুষ সাধারণ নাগরিক হিসেবে তাদের রাষ্ট্রপ্রধানের উদ্দেশে ক্ষোভ জানাচ্ছিলেন। তারা তাদের প্রতিবাদ জানানোর পথ খুঁজবেন-এটাই স্বাভাবিক। তাদের একমাত্র অস্ত্র ছিল — কণ্ঠের শ্লোগান। তাতেই তিনি এত ভয় পেয়ে গেলেন? ছাপ্পান্ন ইঞ্চি ছাতি চুপসে গেল! প্রধানমন্ত্রীর সমস্ত সৌজন্য শিষ্টাচার জলাঞ্জলি দিয়ে তিনি 'প্রাণে বেঁচে ফিরতে পারার' জন্যে পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রীকে, পদস্থ আধিকারিকদের মাধ্যমে 'ধন্যবাদ' জানাতে গিয়ে কার্যত হুমকি দিয়ে রাখলেন! তার 'যোগচর্চিত' দেহে জীবনীশক্তি এত ক্ষীণ যে কৃষকদের শ্লোগানের ধাক্কায় 'প্রাণ সংশয়' হয়েছিল! এসপিজি'র ত্রিস্তরীয় কঠিন নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে থেকেও! যে নিরাপত্তার দৈনিক খরচ প্রায় দেড় কোটি টাকা! যে খরচ আসে ঐ বিক্ষোভকারী কৃষকসহ দেশবাসীর করের টাকায়।
বহু অভিধায় তিনি অভিহিত, আপন স্বভাববৈশিষ্ট্যে। কিন্তু কোনও এক অখ্যাত স্টেশনের 'চা-ওলা' হিসেবে 'আমি তোমাদেরই লোক' বলে জাহির করাটা আসলে নেহাতই কথার কথা। মোটেই তিনি আমজনতার নন। তার চলন বলেন ঠাট বাঁট মেজাজ মর্জি সবই, যাকে বলে, রাজকীয়। সব সময় আশা করেন, রাস্তার দুধারে মানুষ শুধু তাঁর জয়ধ্বনি দেবে, পুষ্পবৃষ্টি করবে। আর সেখানে কিনা 'খালিস্তানী' 'সন্ত্রাসবাদীদের' শ্লোগানবৃষ্টি! (আন্দোলনকারী কৃষকদের এমন অভিধাই দিয়ে থাকেন তিনি ও তাঁর অমাত্যবর্গ!)। তার ওপর আবার ফিরোজপুরের জনসভা লোকশূন্য — সে খবরও কানে এসেছে। সে জন্যে তার গরিমা ক্ষুন্ন হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তার জন্যে একেবারে 'জীবন হানির' শঙ্কা — এটা বাড়াবাড়ি শুধু নয়, নাটকীয় এবং অত্যন্ত রহস্যজনক! বিশেষ করে তার অব্যবহিত পরেই বিজেপি'র সর্বস্তরের নেতা-নেত্রীদের মন্দিরে মন্দিরে পুজো দেওয়ার ঘটনা দেখে সন্দেহ গাঢ়তর হল! নির্বাচনের আগে হিন্দুত্বের ঢেউ জাগানোর চেষ্টা!
সেই যে বার বছরের মেয়েটা, পেটের জ্বালায় ভিন রাজ্যের লঙ্কা ক্ষেতে খাটতে গিয়েছিল, তারপর ঘরে ফেরার জন্যে শ' শ' মাইল হেঁটে ঘরের দরজায় এসে মুখ থুবড়ে পড়েছিল — সেই যে অন্তঃসত্ত্বা হাঁটতে হাঁটতে রাস্তাতেই মৃত সন্তান প্রসব করে এলিয়ে পড়েছিল — সেই চোদ্দ জন, নাছোড় ক্লান্তিতে রেললাইনে ঘুমন্ত অবস্থায় ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গিয়েছিল—আরও অসংখ্য ঘরফিরতি মানুষ শুধু খিদে তেষ্টা কষ্টে পথেই মারা গিয়েছিল – তাদের পিছনে 'মৃত্যু' লেলিয়ে দিয়েছিল কে? আপনার চার ঘণ্টার নোটিশের লকডাউন! কোভিড দ্বিতীয় ঢেউয়ে ওষুধ অক্সিজেন হাসপাতালে শয্যা না পেয়ে লক্ষ লক্ষ লোক মারা গেল কেন? আপনার সীমাহীন ঔদ্ধত্যে এবং আপনার স্বাস্থ্য দপ্তরের দায়িত্বজ্ঞানহীনতা, ঔদাসীন্যে!
কোভিড-এর আগে থেকেই খাবি-খাওয়া অর্থনীতির প্রভাবে কাজ হারিয়েছ কোটি কোটি মানুষ। কোভিড তাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে মাত্র। কোভিড-এ হাজার হাজার শিশু ও কিশোর অনাথ। কোটি কোটি সংসার অনাহার, অপুষ্টি, রোগে ধুঁকছে। ২৮ শতাংশ স্কুল-ছুট পড়ুয়া আর কোন দিনও শিক্ষাঅঙ্গনে ফিরতে পারবে না। কী হবে তাদের? ওয়ার্ল্ড ইনইকোয়ালিটি রিপোর্ট বলছে, ভারত একই সঙ্গে গরিব এবং অতি বৈষম্যের দেশ। দেশের সবচেয়ে ধনী ১০ শতাংশের হাতে জাতীয় সম্পদের ৫৭ শতাংশ; বিত্তশালীদের একেবারে শীর্ষে থাকা ১ শতাংশের হাতে আছে ২২ শতাংশ সম্পদ। আর দরিদ্রতম ৫০ শতাংশের হাতে আছে সম্পদের মাত্র ১৩ শতাংশ! ভারত এখন দারিদ্র্য, খাদ্য, স্বাস্থ্য, গণতন্ত্র, মানবাধিকার — সব সূচকেই বিশ্বতালিকায় অনেক নিচে নেমে গেছে। সৌজন্যে — আপনার সরকারের ভ্রান্ত একপেশে নীতি, আপনাদের করপোরেট তোষণ, আপনাদের উগ্র হিন্দুত্ব ও জাতিবিদ্বেষ। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণার প্রাঙ্গণে যারা উৎকণ্ঠায় অসহায়ভাবে জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়টা কাটাতে বাধ্য হচ্ছেন তাদের সামনে শুধু অনিশ্চয়তার নীরন্ধ্র আঁধার। কারণ সব সরকারি সংস্থার দরজায় তালা পড়ে যাচ্ছে। দায়ী আপনার, আপনার সরকারের দেশ-বেচা নীতি। আন্দোলনকারী সাতশো কৃষকের হত্যার জন্য দায়ী আপনার সীমাহীন দম্ভ।
মান্যবর, এত অসংখ্য মৃত্যুর দায় যে আপনি কোনও দিন নেবেন না, ভুলক্রমেও সে চিন্তা কেউ করে না। কিন্তু আপনি যে কোন প্রতিবাদীর মুখেই আপনার 'সম্ভাব্য হত্যাকারী'র ছায়া খুঁজে পান এবং তাকে দানবীয় আইনে অভিযুক্ত করে কারান্তরালে পাঠাতে মুহূর্ত বিলম্ব হয় না। এ ব্যাপারে যে আপনার সরকারের ন্যূনতম নীতি নৈতিকতার বালাই নেই তা ভীমা কোরেগাঁও মামলায় জলের মত পরিষ্কার হয়ে গেছে! কতটা অমানবিক ও ক্রূর হতে পারে ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র তা অশীতিপর পার্কিনসন্স আক্রান্ত স্ট্যান স্বামীর প্রাতিষ্ঠানিক হত্যায় গোটা বিশ্বের কাছে উন্মোচিত। কতটা মিথ্যাচার আছে সেই ষড়যন্ত্রে তা পেগাসাস স্পাই ওয়্যার-এর ব্যবহারের নমুনায় ধরা পড়ে গেছে। তাই আপনার 'বেঁচে ফিরে আসা' শব্দবন্ধটি বিশেষ উদ্বেগজনক-এর মধ্যে 'কালপুরুষের সুগভীর পরামর্শ' নেই তো — নেই তো নতুন কোন ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত?
যাদের দিকে আপনার তর্জনী ইঙ্গিত, তারা কিন্তু দীর্ঘ এক বছর গনগনে গরমে, কনকনে ঠাণ্ডায়, অবিশ্রান্ত বর্ষণে কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবিতে সত্যাগ্রহে অনড় থেকেছেন, প্রাণপ্রিয় সাতশো সাথীকে হারিয়েছেন। কিন্তু আপনার দল ও সরকারের হাজার প্ররোচনাতেও কারও গায়ে একটি আঁচড়ও কাটেননি। কিন্তু সেই অনপনেয় দৃঢ়তা ও সহিষ্ণুতা আঘাত হেনেছে আপনার দম্ভে! যা আপনি ভুলতে পারছেন না কারণ আপনার ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে সেই দুর্জয় প্রতিরোধ আজ গণতন্ত্ররক্ষার প্রতিটি আন্দোলনের কাছে এক দিশা, অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছে। আর আপনার সামনে হয়ে উঠেছে ভোটমুখী রাজ্যগুলির ভোট বৈতরণী পারে এক কঠিনতম চ্যালেঞ্জ! তাই আপনি আরও বেশি প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে উঠছেন। কিন্তু ঐ জেদী মানুষগুলোর পাঁজরে যে শোকের আগুন জ্বালিয়ে তুলেছেন তাকে রুখবে কে?
- জয়ন্তী দাশগুপ্ত